কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম


জাতীয় বাজেট একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দলিল যাতে একদিকে যেমন দেশের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা ও পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটে অন্যদিকে এর প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক প্রভাব জাতীয় এবং ব্যক্তি জীবনের সর্বত্রই পড়ে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সোপানে পদার্পন করা বাংলাদেশের জন্য জাতীয় বাজেট নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা তাই অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আমরা জানি, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি, তৈরি পোশাক, আর র‌্যামিট্যন্সের উপর দাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথ পাড়ি দিচ্ছে। অন্য খাতগুলোর তুলনায় জিডিপিতে কৃষিখাতের ক্রমহ্রাসমান অবদান সত্তে¡ও বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান এখনও সর্বাধিক। বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে এখনো বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা কোন না কোন ভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) এর হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমমক্তির ৪০.৪ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত আছে যারা দেশের পিছিয়েপড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ এবং যাদের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কৃষির উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। কিন্তু প্রতিবছর জাতীয় বাজেটের আকার লম্ফ দিয়ে বাড়লেও তাতে কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাত সমূহের বরাদ্ধ ক্রমহ্রাসমান যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

দেশের অর্থনীতিতে করোনাজনিত ব্যাপক অভিঘাতের মধ্যে বিগত ২০২০-’২১ এবং ২০২১-’২২ এই দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হলেও এবারের বাজেট ঘোষণা করোনামুক্ত পরিবেশেই হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু করোনার অভিঘাত এখনও ব্যাপকভাবে বিরাজমান। তদুপরি, মরার উপর খাড়ার ঘা রূপে আবিভর্‚ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন কিংবা রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধ যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশসহ সারাবিশে^ই ব্যাপকতর হচ্ছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রভাব দেখা দিচ্ছে বিশ^ খাদ্য বাজারে। এমনিতেই খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবন অতিষ্ট। এমতাবস্থায়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তথা সম্ভাব্য খাদ্য সংকট বিবেচনায় আসন্ন বাজেটে কৃষিখাত বাড়তি মনোযোগ দাবী করে। কারণ, সকল সংকটকালে কৃষিই আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে ভ‚মিকা রেখে চলেছে। বহু গবেষণা ও নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুসারে করোনাকালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও বেশিরভাগ মানুষের আয় কমেছে, বেড়েছে দারিদ্র। লকডাউনকালে তৈরি পোষাকসহ রপ্তানি খাত, র‌্যমিট্যান্স আয়, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র যখন চরম মন্দা নেমে এসে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের অর্থনীতির চাকা, যখন দেশের শিল্প ও সেবাখাত থেকে কাজ হারিয়ে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্য থেকেও প্রচুর সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে কৃষির উপর বাড়তি চাপ নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল কৃষিখাত তখন দেশের অর্থনীতির ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিল। করোনাকালে একদিকে মহামারীতে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা অন্যদিকে চরম খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের আতঙ্কের মধ্যে একমাত্র আশার প্রদীপ জাগিয়ে রেখেছিল দেশের কৃষিখাত।

সঙ্গত কারণেই বিগত বছরগুলোর বাজেট বক্তৃতাসহ সকল অর্থনৈতিক দলিল এবং কেতাবি আলোচনায় কৃষিখাত এখনও নীতি নির্ধারক মহলে দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবেই বিবেচিত হতে দেখা যায়। কারণ, দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে কৃষির গুরুত্ব কম করে দেখার কোন সুযোগ নেই। অথচ বিগত বছরগুলোর বাজেট পর্যালোচনা করলে এক হতাশাজনক চিত্রই ফুটে উঠে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৯৪ হাজার কোটি টাকা যা ২০২১-২২ অর্থ বছরে বেড়ে দাড়িয়েছে ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাতের অংশ ছিল ১০.৯% যা চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে মাত্র ৫.৩ শতাংশে (লেখচিত্র-১ ও ২) নেমে এসেছে যার অবস্থান বাজেটের ১৫টি খাতের মধ্যে নবম। কাজেই, মুখে বা কেতাবে যাই বলা বা লেখা হউক না কেন জাতীয় বাজেটে কৃষিখাত বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত থেকেছে ক্ষুদ্র চাষীর (ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক একসাথে) স্বার্থ যারা কৃষক জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৯৬ ভাগ (লেখচিত্র-৩)।

অবশ্য এমন উপেক্ষার হয়ত সঙ্গত কারণও আছে। কারণ, এই শ্রেনীর কৃষকেরা অনেকটা প্রাচীনকালের দাসেদের মত কৃষিতে শ্রম দিয়ে গেলেও বিনিময়ে তাঁদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি খুব সামান্যই। তাদের অধিকার নিয়ে দরকষাকষি করার মত কোন সংগঠন নেই, নেতৃত্ব নেই যেমনটা আমরা দেখি ব্যবসায়িদের বেলায়। যেমন, করোনা লকডাউনকালে ব্যসায়িদের জন্য সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করলেও প্রথমদিকে কৃষকেরা ছিল সম্পূর্ণই উপেক্ষিত যদিও লকডাউনের অভিঘাত কৃষকদের উপর যথেষ্টই পড়েছিল। অসংখ্য কৃষক সব্জি বিক্রী করতে না পারায় ক্ষেতেই নষ্ট হতে দেখা গেছে। বিপুল সংখ্যক পোল্ট্রি ও লেয়ার খামারি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। পরপর দু’টি কোরবানি ঈদে গরুর দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখো কৃষক। অতপর সোশাল মিডিয়া, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াসহ নানান মহলের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত ৫০০০ কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করলেও তার তেমন কোন সুফল ক্ষুদ্র কৃষকের ঘরে যায়নি। অথচ দেশের প্রধান খাদ্য যোগানদাতা হলেও অদ্যাবধি, তাঁরা দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সিংহভাগের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাঁরাই সর্বাধিক খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে থাকে। দিনভর প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, উচ্চমূল্যে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তি ক্রয় করে, সকল প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা কাধে নিয়ে তারা যে ফসল ফলায়, দিনের পর দিন তার লাভজনক মূল্য না পাওয়ায় দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইলেও তাদের উন্নয়নের স্বপ্ন মাথাকুড়ে মরে। অন্যদিকে, দিনদিন কৃষির যে রূপান্তর পরলক্ষিত হচ্ছে তাতে এঁদের ব্যাপক অংশ ফিবছর কৃষি থেকে বিতারিত হয়ে দাসত্বের রূপ বদলে গ্রামবাসি থেকে বস্তিবাসীতে পরিণত হচ্ছে। জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এরূপ বৈষম্য দূরীকরণ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা হলেও জ্ঞাত বা অজ্ঞাত কারণে সেদিকটা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রণীত নির্বাচন মেনিফেস্টু এবং ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরবর্তী বাজেট থেকেই কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের বিকাশকে আগ্রাধিকার দেয় যা বেশ আশা জাগিয়েছিল। কারণ, জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক শীর্ষে থাকা গ্রামপ্রধান এবং কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জন্য কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং এসএমই খাতের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য নিরাপত্তাকেও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যার সুফল হিসেবে দেশ আজ খাদ্যে (যদিও মূলত দানাজাতীয় খাদ্যে এবং এখনও আমদানি নির্ভরতা আছে) স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং দেশে ফসল, ফল ও মৎস্যসহ কৃষি উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ^ব্যাংকের চাপে গৃহীত ভ্রান্ত নীতির ফলস্বরূপ দেশের মৃতপ্রায় পাটখাতের পূণরুজ্জীবনে বর্তমান সরকার বেশকিছু ভাল পদক্ষেপ নিয়েছিল। দেশের কৃষির স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে “একটি বাড়ি একটি খামার” ও “সমন্বিত কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি প্রকল্প”-এর মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে “বাংলাদেশ কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্লান (সিআইপি ২০০৯) প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। সরকারের এসব উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য হলেও প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের অভাবে সেগুলো যথেষ্ট পরিমাণ সুফল দিতে পারেনি।

এটা অনস্বীকার্য যে, সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষির বাণিজ্যিকায়নের নীতির ফলেই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এমন সাফল্য এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এরূপ সাফল্যের পিছনে কৃষকের প্রাণান্ত পরিশ্রম এবং অসামান্য অবদানকে অনেকসময় গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়না। তাছাড়া, সরকারি এসব নীতি কৃষিবান্ধব বলা হলেও কতটা কৃষকবান্ধব সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ, সমস্ত সরকারি নীতি ও পরিকল্পনার সুফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িদের ঘরে উঠতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে যাদের মূখ্য অবদান সেই ক্ষুদ্র কৃষক ক্রমাগতভাবে তার উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের ব্যবসায়ি মহল এবং বৈদেশিক দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর পরামর্শে বা চাপে গৃহীত নীতির (যেমন, ভর্তুকী দিতে বারণ করা এবং মুক্ত বাজার নীতি অনুসরণে বাধ্য করা যদিও তারা নিজেরাই তা করেনা) ফলে অবাধ বানিজ্যের প্রতিযোগীতায় ক্ষুদ্র কৃষকেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন বাড়লেও উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষক কৃষি থেকে কদাচিৎ লাভ পায়। সুখবর হচ্ছে গত দুই বছর যাবৎ উৎপাদন মৌসুমেও কৃষকরা ধানের ভালো দাম পেয়েছে। অবশ্য কৃষকদের এই সামান্য লাভের খেসারত দিতে হয়েছে দরিদ্র ভোক্তাদেরকেই। কারণ, চালের বাজার এখন আকাশচুম্বি যা ধানের বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে কৃষির সামগ্রিক নীতি ও পরিকল্পনায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নকল্পে খামার ভিত্তিক চাষাবাদকে উৎসাহিত করেছে যেমন: পোল্ট্রি খামার, মৎস্য খামার, দুগ্ধ খামার ইত্যাদি। বিদেশি ও হাইব্রিড জাত নির্ভর এরূপ খামারভিত্তিক চাষাবাদে (ইংরেজিতে যাকে মনোকালচার বলা হয়) বিপন্ন হচ্ছে দেশের হাজার বছরের স্থায়িত্বশীল, সমন্বিত এবং জৈব কৃষি। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র এবং ইকোসিস্টেম যা আমাদের জলবায়ু সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে তুলছে। বিপন্ন হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য। আজ আমাদের ক্রমবর্ধমান ও অপরিসীম ক্ষুধা মিটাতে গিয়ে যে কৃষিকে আমরা খোরপোশের কৃষি বা সাবসিস্টেন্স ফার্মিং আখ্যা দিয়ে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি তার খেসারত নিশ্চয় একদিন আমাদেরকে দিতে হবে যদিও সেদিন হয়ত করণীয়টা খুব বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। যাহোক, এরূপ বাণিজ্যিক কৃষির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা। একদিকে জলবায়ু সহনশীল ও স্থায়িত্বশীল কৃষির কথা বলা হলেও “হাই ইনপুট, হাই আউটপুট” কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কৃষি অর্থনীতির “ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি” বিবেচনায় নিলে এরূপ কৃষি স্বল্পমেয়াদে বেশি উৎপাদনশীল মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্বশীল নয়। কারণ, কৃষি উৎপাদন উপকরণ (যেমন: রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, হরমোন, ভিটামিন ইত্যাদি)-এর ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করার ফলে একটা পর্যায় পর্যন্ত উৎপাদন বাড়লেও একসময় স্থিতাবস্থায় পৌছানোর পর প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষি আর কৃষকের জন্য লাভজনক থাকেনা। এমন কৃষি ব্যবস্থায় কৃষি উপকরণ সরবরাহকারি কোম্পানি এবং ব্যবসায়িরা ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও খোদ কৃষক লাভবান হয় না।

অন্যদিকে, বাণিজ্যিক কৃষিতে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার কোথাও খোদ কৃষকের কোন নিয়ন্ত্রণ দূরে থাকুক সামান্য প্রভাবটুকুও দেখা যায় না। একমাত্র কৃষি ছাড়া অন্য সকল নিত্যভোগ্য এমনকি বিলাসপণ্যের মূল্যও উৎপাদক স্বয়ং কিংবা সরকার-উৎপাদক মিলে নির্ধারণ করলেও কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষকের কণামাত্র ভ‚মিকা থাকেনা। অথচ আজ আমরা যে কৃষি দেখছি সেটা মূলত শিল্পকৃষি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগ্রিকালচার) যদিও এটিই সম্ভবত একমাত্র শিল্প যেখানে উৎপাদক মালিক না হয়ে মূলত শ্রমিকের ভ‚মিকা পালন করে থাকে। কৃষির প্রাণপঙ্ক হলো বীজ যা আজ কোম্পানি-ব্যবসায়িদের নিয়ন্ত্রণে। সারের উৎপাদন ও আমদানি বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বালাইনাশকের বাজার পুরোপুরি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে পোল্ট্রির বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত। খাদ্যপণ্যের প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি বৃহৎ অটো রাইসমিলের আগ্রাসনে লক্ষ লক্ষ চাতালকল, যেখানে বিপুল পরিমাণ নারীরা কাজ করতো, আজ ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। এর ফল আমরা কি দেখছি? খাদ্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আজ খোদ সরকারের হাতেও নেই। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা বৃহৎ বা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত হলে তা কত ভয়াবহ হতে পারে তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে এই বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। অমর্ত্য সেন আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন কোম্পানি-ব্যবসায়িরা কিভাবে মুনাফার লোভে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতেও কুন্ঠিত হয়না।

কৃষির স্থায়িত্বশীলতা এবং ক্ষুদ্র কৃষকের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কৃষি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকাল বুঝার জন্য দেশের পোল্ট্রি খাতকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যায়। এদেশে কয়েক দশক আগে বিদেশি প্রজাতি নির্ভর পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র খামারিদের হাত ধরে যারা ম‚লত ৫০, ১০০ বা ২০০ মুরগীর ক্ষুদ্র খামার গড়ে তুলেছিল। তখন তা তাঁদের জন্য লাভজনকই ছিল। কিন্তু খাদ্য, ঔষধপত্র এবং অন্যান্য উপকরণের মূল্য এবং রোগব্যাধিসহ নানাবিধ সমস্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলাতে না পেরে তারা আজ বিলীন হয়ে গেছে। এরপর ক্রমেই মাঝারি উদ্যোক্তারা পোল্ট্রি শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারাও আজ টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। ক্রমেই দেশের পোল্ট্রি শিল্প সিপি বাংলাদেশ, নিউ হোপ-এর মত দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানির কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে। একইভাবে দেশের মৎস্যখাত এবং শস্যখাতও ক্রমশ কৃষকের হাত থেকে সরে গিয়ে দেশি-বিদেশি কোম্পানি কিংবা পুঁজিপতি কৃষি উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাচ্ছে আর প্রকৃত কৃষকেরা হয় কৃষিশ্রমিকে অথবা গ্রামীণ অকৃষি পেশা কিংবা শহরে নির্মাণ শ্রমিক কিংবা ভ্যান-রিক্সা-অটো চালকে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশ তার খাদ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ দেশি-বিদেশি কোম্পানির কুক্ষিগত হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুকির মধ্যে পতিত হতে যাচ্ছে। বস্তুত আমরা এখন তথাকথিত উন্নত দেশের কৃষির মডেল অনুসরণ করছি যা হাজার হাজার ডলার ভর্তুকী দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণেই দেড়-দুই দশকের ব্যবধানে দেশের পোল্ট্রি চাষীদেরকে এখন টিকে থাকার জন্য ভর্তুকী দাবি করতে হচ্ছে। ভর্তুকী না দিয়ে কৃষিকে কৃষকের জন্য লাভজনক করতে গেলে খাদ্যের দাম দরিদ্র ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ফলে, খাদ্যের যথেষ্ট যোগান থাকা সত্তে¡ও দরিদ্র মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। কিন্তু, বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ-এর চাপে কিংবা নিজেদের উদাসীনতায় গত এক দশকে কৃষিতে প্রকৃত ভর্তুকীর পরিমান ৬০০০-৯০০০ কোটি টাকার মধ্যে উঠানামা করছে (লেখচিত্র-৪) যদিও এই সময়ে বাজেটের আকার বেড়েছে ছয়গুণেরও বেশি। অথচ সরকারের সর্বোচ্চ মহলের কথাবার্তায় বুঝা যায় যে সরকার ভর্তুকী দিতে দিতে এখনি হাফিয়ে উঠেছে।

এটা সত্য যে, বর্তমানে যতসংখ্যক মানুষ কৃষিতে আছে তাদেরকে কৃষিতে রেখে সবার অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। কাজেই কৃষি থেকে অনেক মানুষ বিতারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা কৃষিতে থেকে যাবে কিংবা আগামী প্রজন্মের যারা কৃষিতে আসবে তাদের জন্য আকর্ষনীয় এবং সন্মানীয় পেশা হিসেবে কৃষিকে উপস্থাপন করতে না পারলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন তথা খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমশ আরও নাজুক অবস্থায় উপনীত হবে। কাজেই কৃষিকে কৃষকের জন্য লাভজনক করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত কৃষকেরা কৃষিতে আসতে চাইবেনা। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে কৃষিকে কৃষকের জন্য লাভজনক করাটা অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল ব্যাপার বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কেবল খাদ্য উৎপাদন বাড়ালেই যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না তেমনি কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও নিশ্চিত হয় না যদি না কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়। কিন্তু বিগত বাজেটগুলোতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবে ‘কৃষক বিপণন দল’ ও ‘কৃষক ক্লাব’ গঠন এবং গ্রোয়ার্স মার্কেট স্থাপনের যে সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে তা প্রকৃতপ্রস্তাবে কতটা সফল তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। কৃষির ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণের ফলে এবং ক্রুটিপূর্ণ বর্তমান মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক যা উৎপাদন করে তার লভ্যাংশটুকু লুটেপুটে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা যেখানে কৃষক তার উৎপাদন ব্যয়টাও উঠাতে পারে না। অন্যদিকে, ভর্তুকী বা ঋণ হিসেবে যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও লুটেপুটে নেয় একশ্রেণীর সুবিধাভোগীরা। কাজেই, শুধু কিছু গ্রোয়ার্স মার্কেট নির্মাণ করে কিংবা রাসায়নিক সারে কিছু ভর্তুকী দিয়েই এই জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বর্তমান বাজার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার যার কোন দিকনির্দেশনা বিগত বাজেটগুলোতে পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হলেও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা আজও সুদুর পরাহত। কারণ, খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার কিছুটা কমেছে বলে দাবী করা হলেও দেশের কৃষিতে এখনও প্রায় ৪০ লাখ টন রাসায়নিক সার ও প্রায় ৩৭ হাজার টন রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে । পক্ষান্তরে, মানুষ আজ পেট পুরে খেতে পারলেও “পুষ্টিহীনতাজনিত গুপ্ত ক্ষুধা (হিডেন হাঙ্গার)”-এ ভ‚গছে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ। আর বিষাক্ত খাবার খেয়ে বাড়ছে রোগব্যাধি, বিপন্ন হচ্ছে মানবস্বাস্থ্য। সরকার একটি জৈবকৃষি নীতি প্রণয়ন করলেও তা বাস্তবায়নের তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনা। দেশে আজও জৈব খাদ্যের কোন মানদন্ড প্রবর্তন করা হয়নি যা প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। দেশে একটি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও খাদ্যে বিষাক্ততা ও ভেজাল রোধে খাদ্যমান পরীক্ষা, প্রত্যয়ন এবং পরিবীক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং সক্ষমতা সৃষ্টির যথেষ্ট উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যত “না খেয়ে মরার চেয়ে খেয়ে মরাই ভালো” নীতিতে বিশ^াসী হয়ে ক্রমেই আমরা এক অনিশ্চিত এবং ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায় বলেই দেশে নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ক্রমবর্ধমান এই চাহিদার যোগান দিতে সারা দেশে প্রচুর সংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিরাপদ খাদ্য ভ্যালু-চেইন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে যা সরকার ঘোষিত ”এসএমই” উন্নয়নের একটা চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।

এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত এদেশের প্রান্তিক কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেবল বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানির হাতে সব ছেড়ে না দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের স্বার্থে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করা এবং সে অনুযায়ী জলবায়ু সহনশীল স্থায়িত্বশীল কৃষি পূণঃপ্রতিষ্ঠায় সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি, খাদ্য বাজারকে সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে রাখতে খাদ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেশনের কুক্ষিগত হতে না দিয়ে ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন উদ্যোগকে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। এর সুদূরপ্রসারী সুফল শুধু খাদ্য ব্যবস্থাতেই আসবে না, এতে ব্যাপক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। এজন্য বর্তমান কৃষির কাঠামোগত সংস্কার অত্যাবশ্যক।

জাতীয় কৃষিবাজেটে ক্ষুদ্র কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ১৫ দফা সুপারিশ:
১. জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্থায়িত্বশীল খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থে মাটির স্থায়িত্বশীল উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধিসহ জলবায়ু সহিঞ্চু স্থায়িত্বশীল কৃষি (ঈষরসধঃব জবংরষরবহঃ ঝঁংঃধরহধনষব অমৎরপঁষঃঁৎব-ঈজঝঅ) চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জলবায়ুসহিঞ্চু স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চার কৌশল ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণখাত এবং গবেষণাখাতে বরাদ্দ রাখা।

২. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য চলমান উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার সংস্কার সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এজন্য ’দাউদকান্দি মডেলে’ কৃষকদের ‘উৎপাদন ও বিপণন উদ্যোগ’ গড়ে তোলা। কৃষকের শিক্ষিত বেকার সন্তানদেরকে কাজে লাগিয়ে এসএমই আকারে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে “শস্য গুদাম ঋণ প্রকল্প”কে পূণরুজ্জীবিত করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ‘শস্য সংরক্ষণ ঋণ’ চালু করা।

৩. কৃষিপণ্যের আগাম মূল্য নির্ধারণে সরকার-উৎপাদক-ভোক্তা সমন্বয়ে মূল্য কমিশন গঠন করা। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের জন্য সুদবিহীন বা স্বল্পসুদে মৌসুমভিত্তিক কৃষিঋণ সহজলভ্য করা এবং নারী কৃষকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে ঋণসহ সকল সরকারি সেবা ও প্রণোদনায় নারী কৃষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

৪. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত “লাঙ্গল যার জমি তার” নীতির ভিত্তিতে দেশের ভূমি মালিকানা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা। এজন্য “ল্যান্ড ব্যাংকিং” ব্যবস্থা চালু করে অনুপস্থিত ভ‚মিমালিকদের কাছ থেকে জমি “ল্যান্ড ব্যাংকে” জমা নিয়ে তা প্রকৃত ক্ষুদ্র কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজলভ্য করা। পাশাপাশি, ভূমি জরিপ আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাইজেশন, ভ‚মি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও ভূমি সংস্কারে সরকারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

৫. দেশের মৃতপ্রায় নদীগুলোকে বাঁচাতে এবং নদীর পানিভিত্তিক সেচ ব্যবস্থাকে পূণরুজ্জীবিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রহণ করা। পাশাপাশি, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়সহ সকল সকল জলাশয়ে প্রকৃত মৎস্যজীবিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত “জাল যার জলা তার” নীতির আশু বাস্তবায়ন করা।

৬. সার, বীজ, সেচকাজে ভর্তুকী প্রদানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীল স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রযুক্তি তথা জৈব সার, বালাইনাশক, আইপিএম-এর মত জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তিসম্প্রসারণে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও ভর্তুকী প্রদান এবং এই ভর্তুকির সুবিধা যাতে সরাসরি নারী কৃষকসহ প্রকৃত কৃষকরা পায় তার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারী কৃষি শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় সেবা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও জামানতবিহীন ঋণ প্রদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান রাখা এবং নারীবান্ধব কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।

৭. স্বাধীন ও শক্তিশালী কৃষক সংগঠন তৈরির মাধ্যমে কৃষি সংশ্লিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রকৃত কৃষকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।

৮. কৃষি বাজারসমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাজারে প্রকৃত কৃষকদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম হ্রাস এবং রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ প্রহণ করা।

৯. সরকারীভাবে ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ডিলারের কাছে কৃষকেরা যাতে সরাসরি ধান কিংবা কৃষকদের সহযোগি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ তাদের প্রক্রিয়াকৃত চাল বিক্রি করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। ধান বা চালের সঠিক মূল্য নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং ধানের দাম সরাসরি কৃষকের বা সহযোগি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করা।

১০. দেশীয় গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া এবং হাস-মুরগীর বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনে সরকারি সেবা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, বিদ্যমান পোল্ট্রি শিল্প ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা বৃদ্ধি করা।

১১. জাটকা মাছ নিধন রোধসহ সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীদের দুর্যোগজনিত পুনর্বাসন কর্মসুচিতে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। ’দাউদকান্দি মডেলে’ হাওড়-বাওড়, বিলাঞ্চলে পরিকল্পিত মৎস চাষে উৎসাহিত করতে মৎসজীবীদের প্রণোদনা ও সক্ষমতা বাড়ানো। ইজারাকৃত মরা নদী ও বিলের পানি শুকিয়ে মাছ আহরণের ফলে ধীরে ধীরে মা মাছ ধ্বংস করে ফেলার প্রবণতা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১২. বীজসহ সকল প্রকার কৃষি উপকরণের বাণিজ্য একচেটিয়াভাবে কোম্পানির হাতে ছেড়ে না দিয়ে বৃহদাংশ বিএডিসির হাতে রাখার জন্য সংস্থাটিকে আরও শক্তিশালী করা।

১৩. জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ইকোসিস্টেমভিত্তিক অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বীজ ও কৌলিক সম্পদ সংরক্ষণে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা ও উদ্যোগ বৃদ্ধি করা।

১৪. মেধাপাচার রোধ করে গবেষণা কার্যক্রম আরও জোড়দার করার জন্য কৃষি গবেষণা ও কৃষি শিক্ষায় বরাদ্ধ বৃদ্ধি করা।

১৫. যে কোনো ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগ-ব্যাধি ও পোকামাকড় কর্তৃক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী, দক্ষ ও কার্যকর ’স্যাটেলাইট-বেজড ডিজিটাল সার্ভিলেন্স ও ফোরকাস্টিং ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের শস্য বীমার আওতায় আনা।

—0—

https://samakal.com/opinion/article/2205113557/