by শহীদুল ইসলাম | Mar 31, 2025 | প্রকৃতি কথা
বিশ্বব্যাপী কৃষি প্রযুক্তির বিস্তার এবং তার ফলস্বরূপ দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সাফল্যকে প্রকাশ করতে সবুজ বিপ্লব পরিভাষাটি ১৯৬৮ সালে প্রথম ব্যবহার করেন ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)-র তৎকালীন পরিচালক উইলিয়াম গাউড। ১৯৪৩ সাল থেকে সত্তরের দশকের শেষাবধি চলমান গবেষণা ও উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কর্মকান্ড যা কৃষির উৎপাদন অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয় তাই সবুজ বিপ্লব নামে খ্যাত। এসব কর্মকান্ডের মধ্যে ছিল প্রধানত দানা শস্যের উচ্চ ফলনশীল জাতের প্রবর্তন, সেচ অবকাঠামোর উন্নয়ন ও ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর সেচ ব্যবস্থার প্রচলন, রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতির বিস্তার ইত্যাদি। সবুজ বিপ্লবের জনক হিসেবে খ্যাত এবং শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী নরম্যান বোরলগ ১৯৪৩ সালে মেক্সিকোতে উচ্চফলনশীল গমের জাত প্রবর্তনের মাধ্যমে গমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে সাফল্য অর্জন করেন তা পরবর্তী কালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান রকফেলার ফাউন্ডেশন সারা বিশ্বে বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় এশিয়া অঞ্চলে ধানের উচ্চফলনশীল জাত প্রবর্তনের লক্ষ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশন ১৯৬০ সালে ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৬ সালে ইরি আইআর-৮ নামের একটি উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কার করে যা অতিদ্রুত ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে বিস্তার ঘটানো হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাংক, ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও), (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (ইফাদ) এবং (ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি)-র সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে ‘কনসালটেটিভ গ্রুপ অন ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (সিজিআইএআর)’ নামক কৃষি গবেষণার একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে যা পরবর্তীতে সারা বিশ্বে বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তি বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বিস্তারের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সরকারি পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তির বাজারজাতকরণে বহুজাতিক কোম্পানির পথ সুগম করে।
যাহোক এটা অনস্বীকার্য যে, সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে বিশ্বব্যাপী দানাদার শস্যের উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তা বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কতটা ভূমিকা রেখেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, গুটিকয়েক জাতের গম, ভূট্টা বা ধানের একক চাষের মাধ্যমে শর্করা জাতীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়লেও পুষ্টির জন্য অপরিহার্য অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বরং হ্রাস পেয়েছে যা ভিটামিন ও আয়রনের মতো অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদানগুলোর প্রাপ্যতাকে হ্রাস করেছে। আজও বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঁচ বছরের কম বয়সে মুত্যুবরণকারী শিশুদের প্রায় ৬০% মারা যায় এসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে। অন্যদিকে, ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক প্রয়োগ করার মাধ্যমে উৎপাদিত বিষাক্ত বাড়তি দানাদার খাদ্যও মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনা। বিশ্বের ক্ষুধা নিয়ে ১৯৮৬ সালে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণায় এই চরম সত্যটিকে স্বীকার করা হয়েছে যে, খাদ্য উৎপাদন বাড়লেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়না। অবশ্য বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যাংক দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। শুধু সুপারিশই করেনি এজন্য বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র ঋণ বিস্তারের মাধ্যমে মানুষের খাদ্য ক্রয়ের অর্থ যোগানোর বন্দোবস্তও করেছে।
বাংলাদেশের কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ১৯৬০ এর দশকে খাদ্যের অভাব পূরণের জন্য সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ব্যয়বহুল এই কৃষি ব্যবস্থায় মূলত দানা জাতীয় শস্য যেমন: ধান, গম ইত্যাদি উৎপাদনের ব্যাপক উদ্যোগ গৃহীত হয়। সার্বিকভাবে দানা জাতীয় শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জমির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে, অধিক হারে উচ্চ মূল্যে ক্রয়কৃত বিষাক্ত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক প্রয়োগের ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং লাভ কমে যাচ্ছে। দানা জাতীয় ফসল উৎপাদনের এলাকা বাড়াতে গিয়ে আমিষ ও ভিটামিন সরবরাহকারী নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য যেমন: ডাল, সরিষা (তেল), পেঁয়াজ, রসুন অন্যান্য মসলাজাতীয় ফসল এবং শাক-সব্জি ইত্যাদির চাষ কমেছে যা বর্তমানে কৃষকদেরকে উচ্চ মূল্যে বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। আজ বিদেশী ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি এসে আমাদের বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে বা চোরাই পথে আসছে। এতে আমাদের পরনির্ভরশীলতা বাড়ছে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, এসব ফসল মাটি থেকে ধানের চেয়ে অনেক কম খাদ্য গ্রহণ করে যা মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। কাজেই একই জমিতে উপর্যুপরি শুধু ধান চাষের ফলে জমির উর্বরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বহুবিধ ফসলের পরিবর্তে একক ফসল চাষের ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে এ দেশের সমৃদ্ধ ফসল ও জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও সভ্যতা। পরিবেশ দূষণের ফলে মৎস্য ও জলজ সম্পদ, গবাদী পশু-পাখি, বন্যপ্রাণী ও মাটিতে অবস্থানকারী অনুজীব তথা মাটির প্রাণ ধ্বংস হচ্ছে। মাটি, পানি, বাতাস ও খাদ্য দূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে, বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যাহোক, সবুজ বিপ্লব বাংলাদেশের কৃষিতে যে বৈপ্লবিক রপান্তর ঘটিয়েছে তার প্রভাবসহ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলে ধরা হল।
১. মাটির জৈব পদার্থ ও উর্বরতা হ্রাস
বর্তমানে জমিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার যেমন: ইউরিয়া, ফসফেট, পটাশ, জিপসাম, দস্তা সার ইত্যাদি প্রয়োগ করা হচ্ছে। কোন সারের কি কাজ এবং কোন সার কি পরিমাণে প্রয়োগ করা প্রয়োজন এসব সঠিকভাবে না জেনেই কৃষকরা যথেচ্ছা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এসব সার একদিকে যেমন মাটির স্বাভাবিক রাসায়নিক গঠনকে নষ্ট করে দিয়ে মাটিকে বিষাক্ত করে তুলে, অন্যদিকে তেমনি মাটির জৈব পদার্থ এবং অনুজীবের ক্রিয়া কমিয়ে দিয়ে জমির উর্বরতা হ্রাস করে।
সবুজ বিপ্লবের আগে জমিতে বছরে দুই-একটা ফসল ফলানো হতো এবং বাকি সময় জমি পতিত থাকতো। ফলে, পতিত জমিতে আগাছা এবং বিভিন্ন গাছ-গাছড়া জন্মাত। এগুলো মাটিতে মিশে যোগ হতো জৈব পদার্থ। তা ছাড়া সব কৃষকের বাড়িতেই প্রচুর গোবর, ছাই ও অন্যান্য জৈব আবর্জনা থাকতো যা তারা জমিতে প্রয়োগ করত। বর্তমানে শুধু রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাই মাটির জৈব পদার্থ দিন দিন কমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একটি উর্বর মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা অত্যাবশ্যক কিন্তু আমাদের অধিকাংশ মাটিতে তা ১% এর নিচে নেমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় হয়ত মাটি জৈব পদার্থশূন্য হয়ে পড়বে। তখন এই মাটিতে কোন ফসল ফলানোই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
২. উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের চাষ বৃদ্ধি
বর্তমানে অধিক ফলন পাওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের চাষ করা হচ্ছে। এসব উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাত মাটি থেকে কম ফলনশীল দেশীয় জাতের চেয়ে অধিক হারে খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে থাকে। ফলে, যত বেশি উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড ফসলের আবাদ করা হচ্ছে জমির খাদ্য ভাণ্ডার তত দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
৩. একক ফসলের আবাদ বৃদ্ধি
সব ফসলের শিকড় সমান বড় নয় এবং মাটির সমান গভীরতায় বিস্তার লাভ করে না। কাজেই, একই জমিতে ক্রমাগত একই ফসলের আবাদ করা হলে সে ফসল মাটির একটি নির্দিষ্ট স্তর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। ফলে, মাটির সেই নির্দিষ্ট স্তরের উর্বরতা দ্রুত হ্রাস পায়। যেমন: ধানের শিকড় মাটির খুব বেশি গভীরে যায় না। কাজেই, একই জমিতে বারবার ধান চাষ করা হলে উপরের দিকের মাটি থেকে ধান খাদ্য গ্রহণ করার ফলে উপরের স্তরের মাটি অধিক অনুর্বর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, পানিতে ধুয়ে যে খাদ্যোপাদান নিচে চলে যায় তা আর ধানের কোন কাজে লাগে না। এভাবে প্রয়োগকৃত সার এবং মাটির খাদ্যোপাদানেরও অপচয় ঘটে।
৪. শস্য চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি
এ দেশে মানুষ যখন কম ছিল তখন খাদ্যের চাহিদাও ছিল কম। তখন বছরে দু’একটা ফসল ফলানো হতো এবং বাকি সময় জমি পতিত থাকতো। বর্তমানে প্রায় সকল জমিতেই বছরে ৩-৪টি ফসল ফলানো হচ্ছে। বর্তমানে ফসল চাষের নিবিড়তা শতকরা প্রায় ২০০%-এ পৌছে গেছে। জমিকে কোনরকম বিশ্রামই দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে ফসল চাষের নিবিড়িতা যত বাড়ছে মাটির খাদ্য ভাণ্ডারও তত দ্রুত নিঃশেষ হয়ে মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ছে।
৫. পাটের চাষ হ্রাস
পাটকে একসময় সোনালি আঁশ বলা হতো। পাটের মৌসুমে মাঠে মাঠে শোভা পেত শুধু পাট আর পাট। পাট চাষে কোন রাসায়নিক সার, বালাইনাশক বা সেচের প্রয়োজন হতোনা। বীজ ও জমি চাষের খরচ ছাড়া অতিরিক্ত খরচ বলতে ছিল শুধু নিড়ানি খরচ। এভাবে প্রায় বিনা খরচে কৃষকেরা পাট ফলাত যা ছিল অত্যন্ত লাভজনক। তাছাড়া, পাট মাটি থেকে ধানের চেয়ে অনেক কম খাদ্য গ্রহণ করে। অন্যদিকে, পাটের পাতা পঁচে মাটিতে যোগ হতো জৈব পদার্থ যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। আজকাল ধানের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে পাট চাষ গুরুত্ব হারিয়েছে। পাশাপাশি, নিজেদের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট এবং ভারতের সাথে প্রতিযোগিতায় মার খেয়ে আমরা সারা বিশ্বে পাটের বাজার হারিয়েছি। একসময়ের সোনালি আশ গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। লোকসানের যুক্তি সামনে রেখে মূলত বিশ্বব্যাংকের চাপে আদমজীসহ দেশের অনেকগুলো পাটকল একে একে বন্ধ করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতদ্রব্যের রপ্তানি কমে যাওয়ায় পাটের মূল্য কমেছে। ফলে, কৃষকেরা পাট চাষ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
৬. রবিশস্যের চাষ হ্রাস
একসময় এ দেশের কৃষকের কাছে রবিশস্যের চাষ ছিল খুবই জনপ্রিয় এবং অপরিহার্য। সরিষা, তিল, তিষি ইত্যাদি তেলজাতীয় ফসল; মসুর, খেসারি, ছোলা, মুগ, মটর, মাসকলাই ইত্যাদি ডালজাতীয় ফসল ইত্যাদি রবিশস্যের চাষ মাটির জন্য খুবই উপকারী। কেননা, এগুলো মাটি থেকে ধানের চেয়ে অনেক কম পরিমানে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। কাজেই, জমিতে শুধু ধান চাষ না করে এসব ফসলের চাষ মাটির উর্বরতা রক্ষায় খুবই সহায়ক। অথচ বর্তমানে কৃষকেরা অধিক লাভের আশায় শুধু ধান চাষ করতেই বেশি আগ্রহী।
৭. সেচের সংখ্যা ও খরচ বৃদ্ধি
বর্তমানে বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে প্রায় প্রতিদিন বা একদিন পর পর সেচ দিতে হচ্ছে। এমনকি বর্তমানে সেচ ছাড়া আমন ধান চাষও সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হল একদিকে, আধুনিক উচ্চফনশীল ও হাইব্রিড জাতগুলোর পানির চাহিদা খুব বেশি অন্যদিকে, জৈব পদার্থ খুব কমে যাওয়ায় মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে গেছে। কারণ, জৈব পদার্থ মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়। কাজেই, সেচ দেওয়ার পর তা দ্রুত নিচের দিকে চলে যায়। আবার ডিজেলের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। সুতরাং একদিকে সেচের চাহিদা বৃদ্ধি অন্যদিকে ডিজেলের মূল্য অত্যাধিক বৃদ্ধি, প্রধানত এই দুই কারণে বর্তমানে সেচ বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় উৎপাদিত ফসলের একতৃতীয়াংশ শুধু সেচ খাতেই ব্যয় হচ্ছে।
৮. খরায় ফসলহানি এবং পানীয় জলের সংকট বৃদ্ধি
আমাদের অনেক দেশী জাত ছিল যেগুলোর খরা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল বেশি এবং সেচের পানির প্রয়োজনও হতো কম। পক্ষান্তরে, উফশী ও হাইব্রিড জাতগুলো অতিমাত্রায় সেচনির্ভর। আজকাল খরা মৌসুমে নদী নালায় সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকছে না। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্ষাকালেও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না বিধায় আমন মৌসুমেও সেচ দিয়ে ধান চাষ করতে হচ্ছে। তাই গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে মাটির নিচের পানি তুলে সেচ দিতে হচ্ছে। ক্রমাগতভাবে সেচের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ভ‚গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে, সেচের ভরা মৌসুমে দেশের অনেক স্থানে গভীর ও অগভীর নলকূপে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। তাই সেচকাজ ব্যাহত হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে টিউবয়েলে পানি উঠছেনা। দেখা দিচ্ছে পানীয় জলের সংকট। পাশাপাশি, ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহারের কারণে অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে আর্সেনিক সমস্যা।
৯. বন্যায় ফসলহানির ঝুঁকি বৃদ্ধি
আামাদের কিছু দেশী জাত ছিল যেগুলো বন্যার পানির সাথে সাথে বেড়ে উঠতো। নিচু জমিতে যেখানে বন্যার পানি উঠে সেখানে এগুলোর চাষ করা হলে ফলন কিছুটা কম হলেও ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল কম। কিন্তু বর্তমান জাতগুলোর সে ক্ষমতা নেই। তাই প্রতিবছর বন্যায় প্রচুর ধান নষ্ট হয়। তাছাড়া, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বাড়ছে যা আরও বাড়বে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আজ তাই বন্যা সহনশীল জাতগুলোর চাহিদা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু উফশী জাতের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই জাতগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়।
১০. পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি
আমাদের দেশী জাতে রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ হতো কম। কারণ, তখন ইকোসিস্টেমের মধ্যে ভারসাম্য বজায় ছিল বলে ক্ষতিকর পোকা প্রাকৃতিকভাবেই দমিত থাকতো। কিন্তু এখন নির্বিচারে রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগের ফলে ফসলের মাঠের ইকোসিস্টেম আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। অন্যদিকে, আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতগুলোতে রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ দিন দিন এত বাড়ছে যে, দফায় দফায় বালাইনাশক প্রয়োগ করেও তাদের দমন করা যাচ্ছে না। ফলে, বালাইনাশক বাবদ প্রচুর খরচ করেও ফসল রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের রোগব্যাধি ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ছে। এরূপ অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য রোগ ও পোকা প্রতিরোধী জাতগুলো আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু সেসব জাতের অনেকগুলোই আজ বিলুপ্ত।
১১. ফসলবৈচিত্র্য হ্রাস
একসময় কৃষকরা দানাদার ফসল, ডালজাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল, মসলা জাতীয় ফসল এবং নানারকম শাক-সব্জি ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করতেন। অথচ, আজকাল হাতেগোনা কয়েকটি জাতের শস্য চাষ করা হচ্ছে যা আমাদের সমৃদ্ধ ফসলবৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, কৃষকদেরকে উচ্চ মূল্যে এসব শস্য বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। তাছাড়া, এসব ফসল মাটি থেকে ধানের চেয়ে অনেক কম খাদ্য গ্রহণ করে যা জমির উর্বরতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি, ধবংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ।
১২. কৃষকরে সমস্যা ও সংকট বৃদ্ধি
সম্পূর্ণ বাজারনির্ভর বর্তমান রাসায়নিক কৃষি কৃষককে নানাবিধ সংকটে নিপতিত করেছে। বীজ, সার, বালাইনাশক, ডিজেল ইত্যাদি সকল কৃষি উপকরণের মূল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেক সময় উচ্চ মূল্য দিয়েও কৃষক এসব কিনতে পারে না। কারণ, বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকেনা। তা ছাড়া, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা অনেক সময় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এসব উপকরণের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, ভেজাল বীজ, সার ও কীটনাশকে আজ বাজার সয়লাব। এসব ভেজাল উপকরণ ব্যবহার করে কৃষক একদিকে যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি ফসলটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এরূপ নানা সমস্যা ও সংকটের কারণে কৃষকেরা আজ দিশেহারা।
১৩. কৃষকের নিজস্ব জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিলুপ্তি
হাজার বছর ধরে এ দেশের কৃষকেরা তাদের নিজস্ব জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেই চাষবাস করে আসছে। তারা বংশানুক্রমে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে বা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে এসব জ্ঞান লাভ করেছে। একসময় এ দেশে যে ১২,৫০০ জাতের ধান চাষ করা হত তার সবই ছিল কৃষকের নিজের আবিষ্কার। কৃষক যেমন ফসলের ভাষা বুঁঝতো তেমনি ফসলও বুঁঝতো কৃষকের মনে কথা। ফসলের কখন কি দরকার সবই ছিল তাদের নখদর্পনে। আজ যেসব প্রযুক্তি আসছে তার কলাকৌশল কৃষকের অজানা। তারা এর-তার কাছ থেকে শুনে সেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায়শই ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সার ও কীটনাশকের ডিলার বা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে গিয়ে তাঁরা প্রায়শই প্রতারিত হচ্ছে। আগে ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ, সার, বালাইনাশক বা অন্য কোন উপকরণের জন্য কৃষকের বাজারমুখী হতে হতোনা, নিজস্ব সম্পদ ও প্রযুক্তি দিয়েই ফসল ফলাত। নিজে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করত। সারের প্রয়োজন ছিল না কারণ, তাদের ছিল প্রচুর জৈব সার। আর কীটনাশকের প্রয়োজনই হতো না। কৃষক ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল। আজ কৃষক সবদিক থেকেই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছে যা তাদের জন্য খুবই বিপদজ্জনক।
যাহোক, একথা সত্য যে সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তিনির্ভর রাসায়নিক কৃষি দেশের খাদ্য উৎপাদন অনেকগুণ বাড়িয়েছে। কিন্তু এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকের কতটুকু লাভ হয়েছে তা ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এ দেশের মাটি, পানি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানবস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে রাসায়নিক কৃষির উপরে বর্ণিত ক্ষতিকর প্রভাবগুলোকে বাদ দিয়ে যদি শুধু কৃষকের প্রত্যক্ষ লাভটাকেই বিবেচনায় নেয়া হয় তবুও যে চিত্র পাওয়া যাবে তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বাস্তব সত্য এই যে, সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে কৃষির যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার সিংহভাগই চলে গেছে বহুজাতিক কোম্পানি, তাদের দেশীয় এজেন্ট এবং ব্যবসায়িদের পকেটে। হিসেব করে দেখা গেছে যে, ধানের উৎপাদন খরচের সাথে কৃষকের নিজস্ব শ্রম ও জমির মূল্য বিবেচনায় নিলে ধান চাষে লাভ দুরে থাকুক উৎপাদন খরচটাই কৃষক উঠাতে পারে না। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য। এভাবে লোকসান দিয়েই কৃষক এই জাতির মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। অথচ, রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সার-বীজ-বালাইনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রেতা কোম্পানি ও ব্যবসায়ি এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা।
আজ রাসায়নিক সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ব্যাঙের ছাতার মতো গজাচ্ছে ভেজাল সারের কোম্পানি। কৃষকের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত করে তারা দেদারছে মুনাফা লুটছে। দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বালাইনাশক ও বীজ কোম্পানি। তারা দেদারছে ব্যবসা করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, কৃষক ধার-দেনা করে, নিজের সর্বস্ব খুইয়ে সার, ডিজেল, বালাইনাশক কিনে যে ফসল ফলাচ্ছে তারও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মৌসুমে কম দামে ফসল বিক্রি করে ধার-দেনা শোধ করতে গিয়ে নিজের খাওয়ার মতো ধানও ঘরে রাখতে পারছে না। ডাল, তেল, পেয়াজ, রসুন – এসব কিনতে গিয়ে সে আরও দেনাদার হচ্ছে। এটাই যদি হয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ট ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকের প্রকৃত অবস্থা তবে কেন এই রাসায়নিক কৃষি, কেনইবা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে নিজের বিপদ ডেকে আনা – তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
রাসায়নিক সারের ক্ষতিকর প্রভাব
বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, যেকোন ফসলের জন্য ১৬টি পুষ্টি উপাদান অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ এই ১৬টি পুষ্টি উপাদানের যে কোন একটিরও যদি অভাব ঘটে তবে সে ফসল আশানুরূপ ফলন দিতে পারবে না। যেমনঃ মানুষের জন্য আয়রন একটি অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান। কারও শরীরে এই আয়রনের অভাব হলে সে সুস্থ থাকতে পারে না; রক্তশূণ্যতায় ভোগে। বেশি অভাব হলে মারাও যেতে পারে। গাছের বা ফসলের অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদানগুলো হল কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, লৌহ, মলিবডেনাম, বোরন, কপার ও ক্লোরিন। এ ছাড়া ডাল জাতীয় ফসলের জন্য একটি অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন হয়, তা হল কোবান্ট। এগুলোর মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন বাতাস ও পানি থেকে গাছ পেয়ে থাকে। বাকি ১৩ টি পুষ্টি উপাদান গাছ নেয় মাটি থেকে। অর্থাৎ কোন মাটিতে এই ১৩ টি পুষ্টি উপাদানের একটিরও অভাব থাকলে সে মাটি থেকে ভাল ফসল পাওয়া সম্ভব নয়।
কোন মাটিতে ফসলের চাহিদা মোতাবেক সব ধরণের পুষ্টি উপাদান সুষম মাত্রায় বিদ্যমান থাকলে তাকে উর্বর মাটি বলা হয়। আর যদি কোন একটি পুষ্টি উপাদানেরও ঘাটতি থাকে তবে তাকে উর্বর মাটি বলা যায় না। অনেকে বলেন যে, এ দেশের মাটি খুব উর্বর যা বর্তমানে মোটেও সত্য নয়। কারণ, এ দেশের প্রায় সব মাটিতেই এযাবৎ নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটামিয়াম, সালফার, দস্তা ও বোরন – এই ছয়টি পুষ্টি উপাদানের মারাত্মক অভাব দেখা দিয়েছে। কোন কোন জমিতে এই ছয়টি ছাড়াও অন্য আরও কয়েকটি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কাজেই, এসব পুষ্টি উপাদানগুলো রাসায়নিক সার হিসেবে কৃত্রিমভাবে মাটিতে দিয়ে ফসল ফলানো হচ্ছে। এমন দিন দূরে নয় যখন মাটিতে ১৩টি পুষ্টি উপাদানেরই ঘাটতি দেখা দিবে। তখন ফসল চাষ করতে গেলে তের রকম সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে একথা অবশ্যই সত্য যে, এক সময় এ দেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর ছিল। তখন মাটিতে কোন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি ছিল না। তখন কোন সার ছাড়াই ফসল ফলানো সম্ভব ছিল।
আমরা জমিতে যেসব সার দিই সেগুলোতে এক বা একাধিক অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান থাকে। যেমনঃ ইউরিয়া সারে থাকে নাইট্রোজেন, টিএসপি সারে থাকে ফসফরাস, এমপি সারে থাকে পটাশিয়াম, জিপসাম সারে থাকে ক্যালসিয়াম ও সালফার ইত্যাদি। এভাবে গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যোগান দেওয়ার জন্য বাইরে থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য আমরা জমিতে দিই তাই রাসায়নিক সার। তবে, শুধু কোন একটি পুষ্টি উপাদানকে সরাসরি মাটিতে প্রয়োগ করা যায়না। যেমনঃ নাইট্রেজেন এক প্রকার গ্যাসীয় পদার্থ। বাতাসের শতকরা প্রায় ৭৮ ভাগই নাইট্রোজেন। কিন্তু এই নাইট্রোজেন গাছ সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না বা এটাকে সার হিসেবে মাটিতে দেওয়া যায় না। তাই নাইট্রোজেন মাটিতে দেওয়া হয় ইউরিয়া আকারে। এই ইউরিয়ায় নাইট্রোজেন থাকে মাত্র শতকরা ৪৬ ভাগ। বাকী শতকরা ৫৪ ভাগে থাকে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। কাজেই কোন জমিতে যদি ১০০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয় তবে ৪৬ কেজি নাইট্রোজেনের সাথে সাথে ৫৪ কেজি কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মাটিতে যুক্ত হয়। আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি যে, কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গাছ বাতাস ও পানি থেকে নিয়ে থাকে। কাজেই, ইউরিয়ার সাথে যে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মাটিতে যুক্ত হয় তা মাটিতেই জমা থাকে। এভাবে অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান মাটিতে জমে জমে মাটির স্বাভাবিক রাসায়নিক গঠনকে পাল্টে দেয় যা মাটির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
রাসায়নিক সারকে কৃত্রিম ঔষধের সাথে তুলনা করা যায়। ভিটামিন বা আয়রনসমৃদ্ধ খাদ্য থেকেই আমরা আমাদের শরীরের প্রতিদিনকার চাহিদামত ভিটামিন বা আয়রন পেয়ে থাকি। কিন্তু যদি কখনও শরীরে ভিটামিন বা আয়রনের অভাব দেখা দেয় তবে ঔষধের দোকান থেকে কেনা ভিটামিন বা আয়রন সিরাপ খেয়ে সে অভাব পূরণ করা যায়। এখন যদি কেউ মনে করে যে, সে ভিটামিন বা আয়রনসমৃদ্ধ খাদ্য না খেয়ে শুধু সিরাপ খেয়েই বেঁচে থাকবে তবে সেটা কি সম্ভব হবে না সুবিচেনাপ্রসূত কাজ হবে? নিশ্চয়ই না। কাজেই, আমরা যেমন শুধু সিরাপ খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব না তেমনি রাসায়নিক সার খাইয়েও মাটিকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন খাদ্যের। আর মাটির এরূপ খাদ্য হল জৈব সার।
আমাদের মাটিতে যেটুকু জৈব পদার্থ এখনও অবশিষ্ট আছে তা থেকে উপরোক্ত ছয়টি ছাড়া বাকি খাদ্য উপাদাগুলো এখনও গাছ পাচ্ছে, তাই সেগুলো সার হিসেবে প্রয়োগ করা ছাড়াই এখনও ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে এমন দিন দূরে নয় যখন মাটি জৈবপদার্থশূন্য হয়ে পড়বে। আর তখন ১৩ প্রকার সার দিয়েও আশানুরূপ ফসল ফলানো সম্ভব হবে না।
বর্তমানে সারের পরিমাণ বাড়ানোর পরও ফসলের ফলন স্থবির রয়েছে বা দিন দিন কমছে। এরূপ দিন দিন সার বেশি লাগা এবং ফলন কমে যাওয়ার মূল কারণ হল মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়া। আগে যেসব ফসল চাষ করা হত, যেমন লম্বা জাতের ধান, সেগুলোর একটা বড় অংশ মাঠেই থেকে যেত যা জমিতে জৈব পদার্থ যোগ করত। পাশাপাশি, জমিতে বছরে দুএকটা ফসল ফলানো হতো এবং বাকি সময় জমি পতিত থাকতো। ফলে পতিত জমিতে আগাছা এবং বিভিন্ন গাছ-গাছড়া জন্মাত। এগুলো মাটিতে মিশে যোগ হতো জৈব সার। তা ছাড়া সব কৃষকের বাড়িতেই প্রচুর গোবর ও ছাই হতো যা তারা জমিতে প্রয়োগ করত। কিন্তু আজকাল যান্ত্রিক চাষাবাদ করতে গিয়ে গবাদি পশুপাখির সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে, জৈব সারের প্রধান উৎস গোবরের সহজলভ্যতা অনেক কমেছে। গোবর যেটুকু আছে জ্বালানির অভাবে তাও রান্নার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে, জমিতে জৈব সারের ব্যবহার মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে জমিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার যেমনঃ ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, জিপসাম, দস্তা সার ইত্যাদি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব সার মাটির স্বাভাবিক রাসায়নিক গঠনকে নষ্ট করে দিয়ে মাটিকে বিষাক্ত করে তুলছে। ফলে, মাটির জৈব পদার্থ এবং অনুজীবের ক্রিয়া কমে গিয়ে জমির উর্বরতা মারাতœভাবে হ্রাস পাচ্ছে। উর্বর মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা দরকার কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতে তা ১%-এরও নীচে নেমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় মাটি জৈব পদার্থশূন্য হয়ে পড়বে। তখন এ মাটিতে কোন ফসল ফলানো সম্ভব হবে না। কারণ-
১. জৈব পদার্থ মাটিতে গাছের জন্য খাদ্যের ভাণ্ডার বা গোলা হিসেবে কাজ করে। আমরা যেমন গোলায় ধান বা চাল জমা করে রাখি এবং সারাবছর সেখান থেকে প্রয়োজনমতো নিয়ে নিয়ে খাই ঠিক তেমনি জৈব পদার্থও মাটিতে গাছের জন্য খাদ্য জমা করে রাখে এবং গাছ সেখান থেকে তার প্রয়োজনমতো খাদ্য নিয়ে খায়। জমিতে যে সার দেওয়া হয় সেটাও গাছের জন্য সহজলভ্য হতে গেলে মাটিতে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। কাজেই মাটিতে জৈব পদার্থ না থাকলে প্রয়োগকৃত সেসব সারের বেশির ভাগ অংশই মাটি থেকে পানির সাথে ধূয়ে নীচের দিকে চলে যায়।
২. জৈব পদার্থ মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়। যে মাটিতে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ থাকে সে মাটিতে পানি দিলে তাতে অনেক দিন পর্যন্ত পানি থাকে। মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গেলে সে মাটিতে ভাল ফসল ফলানো সম্ভব নয়।
কাজেই জৈবপদার্থশূন্য মাটিতে ভাল ফসল ফলানো সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, বেলে মাটির কথা ধরা যাক। বেলে মাটি পানি ধরে রাখতে পারে না তাই এরূপ মাটিতে ফসলও ভাল হয়না। এর একমাত্র কারণ হল বেলে মাটিতে জৈব পদার্থ থাকে খুবই কম।
জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। জৈব পদার্থ কমতে কমতে আমাদের মাটি ক্রমেই নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। আমরা শুধু কৃত্রিম স্যালাইন (রাসায়নিক সার) খাইয়ে মাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছি। আজ আমাদেরকে ভাবতে হবে, আমরা আমাদের মাটিকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছি তা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের খাদ্যের যোগান দিতে পারবে কিনা। যেখানে ২০২০ সালে এ দেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাড়াবে ১৮ কোটি অথচ এখনই ফলন কমতির দিকে। মাটির প্রাণ যদি মারা যায়, যতই রাসায়নিক সার আর উন্নত জাত চাষ করা হউক না কেন ফলন কিছুতেই বাড়বেনা, বরং কমবে। তা হলে আগামী বংশধরদের খাবার আসবে কোথা থেকে? সময় থাকতে বিষয়টি ভেবে দেখা অত্যন্ত জরুরী।
by শহীদুল ইসলাম | Mar 30, 2025 | প্রকৃতি কথা
খাদ্য নিরাপত্তা শুধু ক্ষুধা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সহজলভ্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য প্রয়োজনীয় দুষণমুক্ত খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তাই হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। অর্থাৎ একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক এবং অন্য কোন দুষণ থেকে মুক্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য পাবে। অন্যদিকে, খাদ্য শুধু একটি পণ্য নয় বরং এটি কোন একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি তথা জীবনাচারের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাকে অনেকে একটি স্থিতিশীল খাদ্য উৎপাদন ও সুষম বন্টন ব্যবস্থা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি একটি শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পৃক্ত বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। এরূপ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের (যেমনঃ কৃষি জমি, বীজ, সার, পানি, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, জ্ঞান ইত্যাদি) উপর উৎপাদকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারকে নিশ্চিত করবে। অথচ আজকাল বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে কেবল দানাদার খাদ্যশস্যের সহজলভ্যতাকেই বুঝানো হচ্ছে। শুধু দানাদার খাদ্য দিয়ে যেমন মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় তেমনি বর্তমান রাসায়নিক কৃষির মাধ্যমে বিষমুক্ত খাদ্যের যোগান দেওয়াও সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে, বর্তমান কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিজমি, বীজ, সেচের পানি, কৃষকের নিজস্ব জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্যান্য উপকরণ ইত্যাদি সবই আজ কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। প্রকারান্তরে গোটা কৃষি ব্যবস্থাই আজ কৃষকের হাতছাড়া যাচ্ছে যা শুধু কৃষকেরই নয় গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাতœক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
কৃষি ও খাদ্যের বাণিজ্যিকীকরণ কার স্বার্থে
খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য এসবই মানুষের মৌলিক অধিকার। ধনী-গরীব নির্বিশেষে এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার মত ন্যুনতম পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ খাদ্য ও পানি পাওয়ার অধিকার আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অথচ প্রায় ৬০০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ পৃথিবীর ১০০ কোটির বেশি মানুষই তাদের খাদ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। তদুপরি, আজ খাদ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। খাদ্যের উপর কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে কোম্পানির মুনাফার অনন্ত ক্ষুধার আগুনে কোটি মানুষের খেয়ে বাঁচার অধিকার যে দগ্ধ হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
খাদ্য প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান। আর মানুষ প্রকৃতিরই সন্তান। সকল যুগেই এই বিশ্বের সকল মানুষ এবং অন্য সকল প্রাণির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রকৃতির মধ্যেই ছিল, প্রকৃতির মধ্যেই আছে। কিন্তু খাদ্যের অসম বন্টন ব্যবস্থার কারণেই সকল দেশে সকল যুগে বিপুল সংখ্যক মানুষ খাদ্য থেকে বঞ্চিত থেকেছে। একসময় মানুষ কোনরূপ উৎপাদন ছাড়াই প্রকৃতি থেকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতো। কিন্তু জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির কারণে মানুষকে খাদ্য উৎপাদন শুরু করতে হয়েছে এবং কালক্রমে তা বাণিজ্যের পণ্য হয়ে উঠেছে। আগে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই অধিকাংশ খাদ্য উৎপাদিত ও ক্রয়-বিক্রয় হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে খাদ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে খাদ্য শুধু নিছক বাণিজ্যের পণ্য নয় বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিরই একটি বড় নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। কৃষিপ্রধান দেশ না হয়েও খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে উত্তরের ধনী দেশগুলো। আর এ কাজে মূল ভূমিকা পালন করছে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সংস্করণ সেসব দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। যেহেতু কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন তাই খাদ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণভার এসব বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ও বন্টন পরিস্থিতি
এদেশে খাদ্য বলতে শুধু দানাজাতীয় খাদ্যকেই (চাল ও গম) হিসেবের মধ্যে ধরা হয় যা একটি চরম ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, দানাদার খাদ্যশস্য মানুষের প্রধান খাদ্য হলেও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে মানবদেহের পুষ্টির জন্য অত্যাবশ্যক সকল খাদ্যকেই বিবেচনায় নেওয়া জরুরী। তদুপরি, দেশের দানাজাতীয় খাদ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিসংখ্যানগত তথ্য নিয়েও মারাতœক বিভ্রাট লক্ষ করা যায় যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। প্রথমতঃ হালনাগাদ তথ্যের প্রাপ্যতা বিশেষ করে খাদ্য চাহিদাগত তথ্য মোটেও সহজলভ্য নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইট এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের ওয়েবসাইটের কোথাও খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদাগতÍ কোন তথ্য সহজলভ্য নয় যা এদেশের পরিকল্পনা প্রণয়নে দৈন্যদশার চিত্রই ফুটে উঠে। দ্বিতীয়তঃ যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় সেখানে কোন একটি উৎসের তথ্যের সাথে অপর কোন উৎসের তথ্যের ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তৃতীয়তঃ নির্দিষ্ট বছরের জনসংখ্যা এবং মাথাপিছু খাদ্যের চাহিদা থেকে দেশের মোট খাদ্য চাহিদা হিসাব করা হয়। কিন্তু, জনসংখ্যা ও মাথাপিছু খাদ্য চাহিদা নিয়েও রয়েছে বিরাট তথ্য বিভ্রাট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ২০১০ সালে দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬০ লক্ষ যদিও অনেকের মতে এটা ১৫ কোটি, কারও মতে ১৬ কোটি। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আদর্শ মান অনুসারে মাথাপিছু দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রতিদিন ৩৯৭ গ্রাম এবং প্রকৃত গ্রহণ ৫০০ গ্রাম। পক্ষান্তরে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসেবমতে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু ৫০৪ গ্রাম (যদি মোট ২৪০০ কিলোক্যালরির ৭৫% দানাদার খাদ্য থেকে পেতে হয়) দানাদার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে যদিও কোন কোন হিসাব মতে এই পরিমাণ আরও অনেক বেশি। এখন আমরা যদি দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি এবং মাথাপিছু দানাদার খাদ্যের চাহিদা ৫০৪ গ্রাম ধরি তবে ২০০৯-১০ অর্থ বছরের জন্য দেশের খাদ্য চাহিদা দাড়ায় ২৯৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অথচ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০ অনুসারে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল ৩৬৯ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ব থাকার কথা। অথচ ঐ বছরেই আরও প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য আমদানী করা হয়েছে এবং বিদেশী সাহায্য হিসেবে এসেছে আরও ৬০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য। অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে দানাদার খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল সর্বমোট ৩৯৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এই পরিমাণ খাদ্য যদি বাংলাদেশের মানুষ খেয়ে থাকে তবে প্রত্যেক মানুষ প্রতিদিন ৬৭৪ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করেছে যা থেকে প্রত্যেকে ২৪০৬ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়ার কথা যেখানে দারিদ্রসীমা হল ২১২২ কিলোক্যালরি !!! এই হিসাব যদি সত্য হয় তবে বাংলাদেশের দারিদ্র সত্যি সত্যিই যাদুঘরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তবুও পরিসংখ্যানের হিসাবে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৪০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। খাদ্যের অসম বন্টন ব্যবস্থাই এর মূল কারণ। সুতরাং এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, খাদ্য থাকলেই সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। কাজেই এ মুহুর্তে যেকোন প্রকারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষযুক্ত দানাদার খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে বন্টন ব্যবস্থাকে ক্রুটিমুক্ত করা এবং শস্য বহুমুখীকরণের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপরোক্ত হিসাব যদি সঠিক হয় তবে আগামী ৩০-৩৫ বছর উৎপাদন না বাড়লেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য নিরাপত্তা
আমাদের খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত, অবৈজ্ঞানিক ও হাজারো ভুল অভ্যাসে ঠাসা। যদিও খাদ্য গ্রহণের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা, কিন্তু এ দেশের মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে একেবারেই উদরপূর্তি ও রসনা তৃপ্তিকে প্রাধান্য দিয়ে। পুষ্টি সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবে যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এদেশের মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, শিক্ষিত এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও পুষ্টি জ্ঞান ও পুষ্টি সচেতনতার অভাব লক্ষণীয়।
আমরা ভেতো বাঙ্গালি, খাদ্য বলতে শুধু ভাতকেই বুঝে থাকি। বার্মা ও ভিয়েতনামের পর আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাতখেকো জাতি। অন্যান্য দেশ, যেখানে ভাত প্রধান খাদ্য, সেখানেও মানুষ ভাত বেশি খায় তবে আমাদের থেকে অনেক কম। ইন্দেনেশিয়ায় একজন লোক বছরে গড়ে ১৫২ কেজি, ফিলিপাইনে ১১০ কেজি, চীনে ১০৩ কেজি এবং ভারতে ৭৯ কেজি চালের ভাত খায়। আর আমরা খাই ১৮৩ কেজি চালের ভাত। আমাদের খাদ্য গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য থাকে কী করে মুখরোচক উপকরণ মিশিয়ে উদরপূর্তি করে ভাত খাওয়া যায়। আমাদের দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রতিদিন মাথাপিছু ৩৯৭ গ্রাম চালের ভাত অথচ আমরা খাই ৫০৪ গ্রামেরও বেশী। অন্যদিকে, আমাদের শাক-সব্জির চাহিদা প্রতিদিন মাথাপিছু ২১৩ গ্রাম অথচ আমরা খাই মাত্র ৫৩ গ্রাম। এক্ষেত্রে শুধু শাক-সব্জির অভাব বা দারিদ্রতা নয়, আমাদের সচেতনতার অভাবই প্রধানত দায়ী।
পুষ্টিকর ভাল খাদ্য বলতে আমরা মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বিদেশী জাতের শাক-সব্জি ও ফলমূল ইত্যাদি দামী খাবারকেই বুঝে থাকি যা একবারেই সঠিক নয়। আমরা যেদিন ভাল খাবারের আয়োজন করি সেখানে মাছ, কয়েক ধরণের মাংস, ডিম, দুধ বা দই এসবকিছু একসাথে খেয়ে উদর ঠেসে পূর্ণ করি যা একদিকে অর্থের অপচয় অন্যদিকে তেমনি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই আমরা মনে করে থাকি যে, বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের পক্ষে এসব খাবার কিনে খাওয়া সম্ভব নয় তাই তারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। প্রকৃত প্রস্তাবে, পুষ্টিকর খাদ্য বা ক্রয় ক্ষমতার অভাব নয় বরং পুষ্টি সম্পর্কে আমাদের চরম অজ্ঞতা ও অসচেতনতা এবং মিথ্যা আভিজাত্যের ভড়ংই এদেশের মানুষের পুষ্টিহীনতার প্রধান কারণ। খাদ্য সাহায্যের জন্য বিদেশীদের কাছে ভিক্ষা মাগতে আমাদের লজ্জাবোধ হয়না কিন্তু কচুর মত অত্যন্ত পুষ্টিকর শাক খেলে আমাদের মান-সন্মান থাকে না। বিভিন্ন প্রকার কচু ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে থানকুনি, তেলাকুচা, পিপুল, আমরুল, সজনে পাতা, বথুয়া, পুনর্ণভা, শান্তি শাক, নটে শাক, হেলেঞ্চা, গনোরি, কলমি, গ্যাটকল ইত্যাদি অসংখ্য শাক-সব্জি পাওয়া যায় যেগুলো চাষ করতে হয়না এবং এসব শাক-সব্জিতে কোন প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক সার বা কীটনাশকও থাকে না। অথচ পুষ্টি মানের দিক থেকে যেকোন দামী শাক-সব্জি থেকে এগুলো কোন অংশে কম নয়। তদুপরি এগুলোর রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। অথচ, আজ এদেশের মানুষের ভিটামিনের অভাব দূর করে অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ধানের মধ্যে ভিটামিন-এ ঢুকিয়ে আমাদের ভিটামিনের অভাব দূর করার এক হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে ‘গোল্ডেন রাইস’ তৈরি করা হচ্ছে। গোল্ডেন রাইসের ভাত খেয়ে যদি ভিটামিন-এ এর অভাব দূর করতে হয় তবে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে প্রায় ৭.৫ কেজি চালের ভাত খেতে হবে তাও যদি শরীর সবটা হজম করতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম গোল্ডেন রাইস থেকে মাত্র ৩০ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন বা ভিটামিন-এ পাওয়া যাবে। অথচ, আমাদের দেশী জাতের লাল চালেও এর চেয়ে আনেক বেশি বিটাক্যারোটিন আছে যেসব ধান আজ বিলুপ্তির পথে। বনে-বাদাড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা ১০০ গ্রাম হেলেঞ্চা শাকে ১৩৭০০ মাইক্রোগ্রাম, থানকুনি শাকে ১৩১০০ মাইক্রোগ্রাম, কলমী শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম, কালোকচু শাকে ১২০০০ মাইক্রোগ্রাম এবং সবুজকচু শাকে ১০২৭৮ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন আছে। যেসব গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে গোল্ডেন রাইস তৈরি করা হচ্ছে তাদের আশেপাশে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এরূপ অসংখ্য খাদ্যবস্তু রয়েছে যা অসচেতনতার জন্য মানুষ খায়না।
অনুরূপভাবে আতা, শরিফা, বেল, কদবেল, পেয়ারা, আমড়া, কামরাঙ্গা, কাঠাল, পেপে, জাম, জামরুল, সফেদা, আমলকি, তেতুল, কুল, ডালিম ইত্যাদি বহু ধরণের দেশী ফল পুষ্টিমানের বিচারে কমলা, আপেল, আঙ্গুর, বেদানা ইত্যাদি যেকোন বিদেশী ফল থেকে কোন অংশেই কম নয়। তা ছাড়া এসব বিদেশী ফলমূল সংরক্ষণে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করা হয় যা আমরা সবাই জানি। অথচ আমরা আভিজাত্যের মিথ্যা অহংকার দেখাতে গিয়ে এসব দেশী ফলগুলোকে হেলাফেলা করি যা একবারে মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আজ এরূপ মিথ্যা অহংকারভরা মুর্খতা আমাদের মন-মগজে চেপে বসেছে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে অযথাই হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, তুলে দিচ্ছে কোম্পানির হাতে। কাজেই আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষের পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া।
খাদ্যের ঘাতক রূপ এবং খাদ্য নিরাপত্তা
যে খাদ্য আমাদেরকে সুস্থ্য রাখবে, আমাদের জীবন বাঁচাবে সে খাদ্যই আজ আমাদের নানারকম রোগ-ব্যাধি ও প্রাণনাশের বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেহের পুষ্টির চাহিদা মিটানোর জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক-সব্জি ও ফলমূলসহ সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু আমরা খাদ্য গ্রহণের নামে প্রতিদিন জেনে বা না জেনে বিষ সেবন করে চলেছি। কারণ, শাক-সব্জি ও ফলমূলসহ এসব খাদ্যে উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মিশানো হচ্ছে নানাবিধ বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য। আধুনিক জাতের উচ্চফলনশীল, হাইব্রিড ও জিএম শাক-সব্জিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদন করতে গিয়ে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি। খাদ্যের সাথে এসবই আমাদের দেহে ঢুকছে। আবার, এসব শাকসব্জি ও ফলমূল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ এবং ফলমূল পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বাইড ও ইথারেলসহ নানাবিধ বিষাক্ত পদার্থ। মাছ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য শাকসব্জি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রঞ্জক দ্রব্য। ফলে, একদিকে যেমন আমাদের দেহে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি দেখা দিচ্ছে অন্যদিকে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কালও হ্রাস পাচ্ছে। আজ আমরা বাধ্য হচ্ছি বাবা বা মা হয়ে প্রাণপ্রিয় সন্তানের মুখে স্বহস্থে বিষ তুলে দিতে-এর চেয়ে অসহায় অবস্থা আর কী হতে পারে!
পানির বাণিজ্যিকীকরণ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আরেক হুমকি
খাদ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি। তাই, খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করাও জরুরী। অথচ, নিরাপদ পানির ক্রমবর্ধমান সংকট আজ সারাবিশ্বে কোটি কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। চিন্তাবিদদের এই আশংকা মোটেই অমূলক নয় যে, পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে তা হবে পানি নিয়েই। প্রকৃতির পানিকে দুষিত করে বিত্তশালীরা এখন মিনারেল ওয়াটারের দিকে ঝুঁকছে। আগামী দিনে পানিই হবে মহামূল্যবান পণ্য। এই গরীব দেশেই পানি আজ দুধের দামকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ পেটের দায়ে নিজের গাভীর দুধ নিজেই খেতে পারেনা সে উচ্চমূল্যে পানি কিনে খেতে পারবে এমনটা ভাবাই অবান্তর। অথচ বাস্তবে তাই ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমানে আর্সেনিক দুষণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে যে পানি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত খাচ্ছে। দুষিত পানি পান করে ধুকে ধুকে মরা অথবা পানিবিহীন মরা অর্থাৎ মৃত্যুই যেন আমাদের নিশ্চিত পরিণতি।
পানি সংকট এখন জলবায়ুগত ও রাজনৈতিক ইস্যু। বিজ্ঞানীদের ধারণা বিশ্বব্যাপী পানি স্বল্পতার শতকরা ২০ ভাগের জন্য দায়ী হবে জলবায়ু পরিবর্তন। বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই নিরাপদ পানির মারাতœক সংকট দেখা দিবে। নিরাপদ পানি স্বল্পতার আর একটি প্রধান কারণ পরিবেশ দুষণ। কারণ, প্রতিবছর দুই মিলিয়ন টন শিল্পবর্জ্য ও রাসায়নিক দ্রব্য, মানববর্জ্য, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পানিতে মিশছে (ইউএন/ডব্লিওডব্লিওএপি ২০০৩)। গরীবরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। কারণ, উন্নয়নশীল দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই এই দুষিত পানি ব্যবহার করছে।
বর্তমানে পানি ব্যবসায়ী কোম্পানীগুলো বিশ্বের মাত্র ৫% জনসংখ্যার পানির চাহিদা মেটাচ্ছে আর তাতেই মাত্র চারটি বৃহৎ কোম্পানির ২০০১ সালের মোট আয় ছিল ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই সারা বিশ্বের পানিখাত বেসরকারীকরণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বহুজাতিক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। উন্নয়নশীল দেশসমূহের পানি নীতিকে বেসরকারীকরণের অনুকূল করার জন্য ঋণের সাথে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়ে এসব সংস্থা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। আর সেবাখাত উদারীকরণ চুক্তির (গ্যাটস) মাধ্যমে পানিখাত বেসরকারীকরণের সকল বাধা দূর করছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর চাপে মোজাম্বিক, বেনিন, নাইজার, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, ক্যামেরুন এবং কেনিয়াসহ বেশকিছু দেশ ইতোমধ্যেই তাদের পানিখাত বেসরকারীকরণ করতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই, এ ব্যাপারে সময়মত সাবধান হওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বশীল কৃষি
আজ এদেশের কৃষি ও কৃষকের এরূপ সংকট মোকাবেলা করা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যার কারিগরি কৌশল হবে জৈব কৃষি চর্চা। কিন্তু বাংলাদেশের মত একটি জনবহুল দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া জৈব কৃষির পক্ষে আদৌ সম্ভব কি-না তা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে অনেকের মাঝেই যথেষ্ট সন্দেহ লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে, গত ৩-৫ মে ২০০৭ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) আয়োজিত “ঙৎমধহরপ অমৎরপঁষঃঁৎব ধহফ ঋড়ড়ফ ঝবপঁৎরঃু” শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞদের অভিব্যক্তি প্রনিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে যে, জৈব কৃষি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। বিজ্ঞানী ইধফমষবু বঃ. ধষ. ২০০৭; এবং ঐধষনবৎম বঃ. ধষ. ২০০৬ সা¤প্রতিককালে একটি তাত্তি¡ক মডেল দিয়েছেন যাতে দেখানো হয়েছে যে, এই মডেলের ব্যবহার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বর্তমানের মোট আবাদী জমির পরিমান ও ফলন না বাড়িয়েও জৈব কৃষির মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিদিন ২৬৪০ থেকে ৪৩৮০ কিলোক্যালরি খাদ্য যোগান দেওয়া সম্ভব।
জৈব কৃষি চর্চার মাধ্যমে এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় – এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তারা প্রকৃতপক্ষে চলমান ভোগবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটেই এমনটি করেন। যেমনঃ রোজার শিক্ষা হল সংযম বা ভোগকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাই যদি হয় তবে সঙ্গত কারণেই রমজান মাসে ভোগ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, রমজান মাসে আমাদের ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। অথচ দ্রব্যমূল্য নিয়ে হৈচৈ করার চেয়ে আমাদের ভোগ নিয়ন্ত্রণ করা অধিক জরুরী।
অন্যদিকে, আমরা জানি, উদ্ভিদই কেবল নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে। কাজেই এই বিশ্বভ্রহ্মান্ডের সকল জীবই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এখন যে পোকামাকড় এই উদ্ভিদ (মাঠ ফসল, ফলজ ও বনজ বৃক্ষ ইত্যাদি) থেকে খাদ্য শিকলে খাদ্য সরবরাহের কাজটি করে তাকে শক্রু জ্ঞান করে কীটনাশক প্রয়োগ করে ধ্বংস করার ফলে গোটা খাদ্য-জাল বিঘ্নিত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বিশ্বভ্রহ্মান্ডের জীববৈচিত্র্য। কাজেই, ফসল রক্ষার প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করছে তা একমাত্র মানুষের ভোগের জন্যই নয়। কাজেই, স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রকৃতপক্ষে একটি দর্শন যা সাদামাটাভাবে ফসলের ফলন বা পরিমানগত উৎপাদন দিয়ে বিচার করলে চলবে না।
তা ছাড়া, জৈব কৃষি চর্চায় ফসলের ফলন কমবে সে ধারণাও অমূলক। আজকে যারা জৈব কৃষিকে অসম্ভব মনে করছেন তারা আসলে বর্তমান প্রচলিত কৃষির ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও সংকটের প্রেক্ষাপটেই এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন। গত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে রাসায়নিক কৃষি চর্চার ফলে আমাদের মাটি, পরিবেশ, ইকো-সিস্টেম এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার যে রূপান্তর ঘটেছে সেখানে শুধু টনের হিসেবে জৈব সার প্রয়োগ করেই রাতারাতি ফলাফল প্রত্যাশা করাটাই অযৌক্তিক। এজন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও ফসলের ইকোসিস্টেম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জৈব কৃষি চর্চায় উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে ফসলের সার্বিক ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার উপর। মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, ফসল ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, পোকা-মাকড় ও অন্যান্য বালাই ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজগুলো দক্ষতার সাথে করতে পারলে জৈব কৃষিতে শুধু স্থায়িত্বশীল ফলনই নিশ্চিত হবেনা, উৎপাদনশীলতা এবং সার্বিক লাভও বৃদ্ধি পাবে। আর এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
by শহীদুল ইসলাম | Mar 30, 2025 | প্রকৃতি কথা
বীজ কেবল ফসল চাষের একটি উপকরণই নয় বরং তা সমগ্র কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষক জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিসহ সমগ্র জীবন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই, বীজের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি এ দেশের কৃষক এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপ্রধান এ দেশের বীজের বিশাল বাজার দখলের মাধ্যমে গোটা কৃষি ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুদুরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রবর্তন করছে তাদের প্যাটেন্ট করা হাইব্রিড ও জেনিটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) বীজ।
বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলে আজ বহু কোম্পানি হাইব্রিড ও জিএম বীজ বাজারজাত করছে। হাইব্রিড, জিএম ও টার্মিনেটর বীজ (টার্মিনেটর প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরিকৃত বন্ধ্যা বীজ) বর্তমান বিশ্বের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের কৃষিতে এক দানবীয় রূপে আর্বিভূত হয়েছে। সারা বিশ্বের কৃষি ও খাদ্য নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করা ও কাড়ি কাড়ি মুনাফা লুটার ফন্দি এটেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এসব বীজ বাজারে ছাড়ার পেছনে কোম্পানির মূল লক্ষ্য হল কৃষকের নিজস্ব বীজগুলোকে সরিয়ে দিয়ে তাদের বীজের একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর দিকে কোম্পানিগুলোর নজর পড়েছে। কারণ, প্রযুক্তির দিক থেকে দূর্বল এসব দেশগুলোই হতে পারে তাদের একচেটিয়া ব্যবসার অবাধ ক্ষেত্র।
যতই খাদ্য নিরাপত্তার বুলি আওড়ানো হউক না কেন, কোম্পানির মূল লক্ষ্য নিশ্চয় মুনাফা অর্জন। আর কোম্পানির মুনাফা অর্জনের পথ তখনই নিরঙ্কুশ হবে যখন কৃষক প্রতি বছর সে কোম্পানির বীজ কিনবে। কোম্পানি যদি এমন বীজ বাজারে ছাড়ে যে বীজ থেকে কৃষক নিজে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে পরের বছর চাষ করতে পারবে সেরকম বীজ দিয়ে কোম্পানির মুনাফা অর্জনের পথ নিরঙ্কুশ হবে না। কারণ, ঐতিহ্যগতভাবেই এ দেশের কৃষক পরস্পরের মধ্যে বীজের আদান-প্রদান করে থাকে। ধরা যাক, একটা গ্রামে একজন কৃষক কোম্পানির কোন একটি জাতের বীজ বাজার থেকে কিনে এনে চাষ করল। এখন ধরা যাক, সেই কৃষকের কাছ থেকে বীজ নিয়ে পরের বছর আরও ১০ জন কৃষক ঐ জাতটি চাষ করল। তার পরের বার সেই ১০ জন থেকে আরও ১০০ জন কৃষক ঐ বীজ নিয়ে চাষ করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে কৃষকদের মাধ্যমে সারা গ্রামেই সে বীজ ছড়িয়ে পড়বে। কোম্পানির কাছ থেকে প্রতিবছর কৃষক আর বীজ কিনবে না। ফলে, কোম্পানির বীজ ব্যবসাও আর জমবে না।
তাই কোম্পানির ব্যবসা নিরঙ্কুশ করতে হলে এমন বীজ কৃষককে দিতে হবে যে বীজ থেকে কৃষক নিজে বীজ উৎপাদন করে পরের বছর চাষ করতে পারবে না। প্রতিবছর কোম্পানির কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য হবে। ঠিক এমন বীজই হল হাইব্রিড ও জিএম (টার্মিনেটর প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত) বীজ। এই টার্মিনেটর প্রযুক্তি সম্পর্কে পূর্বেই ট্রিপস চুক্তি চ্যাপ্টারে আলোচিত হয়েছে।
একসময় এ দেশের মাঠে মাঠে চাষ হতো প্রায় ১২,৫০০ জাতের ধান, আজ সেগুলো বিলুপ্ত প্রায়। আজ যদি আমাদের কৃষকরা হাইব্রিড ও জিএম জাতের চাষ শুরু করে তবে বর্তমানে যে জাতগুলো আছে (যেগুলোর বীজ কৃষক নিজে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারে) সেগুলো হারিয়ে যাবে। তখন কৃষক বীজের জন্য সম্পূর্ণরূপে কোম্পানির নিকট জিম্মি হয়ে পড়বে। আর তখন বীজ সংকট বর্তমানের চেয়ে আরও মারাতœক আকার ধারণ করবে। রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, ডিজেল ইত্যাদি উপকরণগুলোর সংকট সৃষ্টি হলে ফলন কম হলেও বিকল্প উপায়ে ফসল ফলানো সম্ভব হতে পারে কিন্তু বীজ ছাড়া তা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, বর্তমানে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জাতগুলোর গুরুত্ব আজ নতুনভাবে অনুভ‚ত হচ্ছে। কাজেই কোন নতুন জাত প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব ফসল বৈচিত্র্য তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত। পাশাপাশি বীজ যাতে সম্পূর্ণভাবে কৃষকের হাতছাড়া না হয়ে যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র কৃষকেরা তাদের বীজের জন্য ক্রমেই কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং নিজেদের হাতের বীজ হারিয়ে জিম্মি হয়ে পড়ছে কোম্পানির হাতে। বাংলাদেশের কৃষকেরা এখনই মারাত্মক বীজ সংকটের সন্মুখীন। ২০০৫ সালের পাট বীজের মারাত্মক সংকট এর জলন্ত উদাহরণ। পাট বীজ উৎপাদন একটু সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় এবং মোটামুটি সুবিধাজনক দামে বাজারে উচ্চ ফলনশীল জাতের পাট বীজ পাওয়ায় কৃষকরা পাট বীজ উৎপাদন প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। কাজেই কৃষকের হাতে এখন আর কোন পাট বীজ নেই এবং তারা বীজের জন্য পুরোপুরি বাজরের উপর নির্ভরশীল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ২০০৫ সালে ব্যবসায়ী মহল পাট বীজের কৃত্রিম সংকট কৃষ্টি করে। ফলে, আগের বছর যে বীজের দাম ছিল প্রতি কেজি মাত্র ৩০-৩৫ টাকা, ২০০৫ সালে তা প্রতি কেজি ৭০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করে এবং কৃষককে বাধ্য হয়ে এ দাম দিয়েই বীজ কিনতে হয়। অনেক কৃষক বীজ কিনতে না পেরে ঐ বছর পাট চাষ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। গত ২০০৯ সালের বোরো মৌসুমে ব্যবসায়িরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ৩০০ টাকার ধান বীজ ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রী করেছে। বীজের ক্ষেত্রে এ ধরণের ঘটনা সারাদেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে। এ দেশের দরিদ্র কৃষকদের জন্য এটি একটি ভয়াবহ সংকট যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
কাজেই এ দেশের দরিদ্র কৃষকদেরকে কৃষিতে টিকে থাকতে হলে বীজের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে কৃষকেরই হাতে। বীজ কৃষকের অধিকার যা কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ অধিকার সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে কৃষকদেরকেই। এ ব্যাপারে সরকারের উপর সর্বাত্মক চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সরকারি নীতি কৃষকের এই অধিকারকে সংরক্ষণ করে। হাইব্রিড ও জিএম বীজ কৃষকের বীজ অধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নিন্মে হাইব্রিড ও জিএম বীজ সম্পর্কে আলোচিত হল।
হাইব্রিড বীজ
দুটি ভিন্ন জাতের উদ্ভিদের মধ্যে কৃত্রিম মিলন ঘটিয়ে নতুন জাত সৃষ্টি করার পদ্ধতিকে বলে শংকরায়ন বা হাইব্রিডাইজেশন। এরূপ শংকরায়নের মাধ্যমেই উচ্চফলনশীল (উফশী) ও হাইব্রিড জাত তৈরি করা হয়। দুটি ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে শংকরায়নের ফলে প্রথম যে বংশধর সৃষ্টি হয় তাকে হাইব্রিড বলা হয়। ধরা যাক, জাত-১ ও জাত-২-এর মধ্যে শংকরায়নের ফলে প্রথম বংশধর ফিলিয়াল-১ (এফ-১) পাওয়া গেল। এখন যদি এই এফ-১ এর বৈশিষ্ট্য বা ফলন জাত-১ ও জাত-২ থেকে উৎকৃষ্টতর হয় তবে তাকে হাইব্রিড জাত হিসেবে বাজারে ছাড়া হয়। এরূপ শংকরায়নের ফলে যে নতুন জাতের (হাইব্রিড) সৃষ্টি হয় তার বৈশিষ্ট্যগুলো হয় সম্পূর্ণ অস্থায়ী। কারণ, এই জাতের অর্ধেক বৈশিষ্ট্য আসে মাতৃজাত থেকে আর বাকি অর্ধেক আসে পিতৃজাত থেকে। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যেগুলো প্রকট শুধু সেগুলোই প্রথম বংশধরের (হাইব্রিড) মধ্যে প্রকাশ পায়। বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো প্রথম বংশধরের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে থেকে যায় অর্থাৎ সেগুলো প্রকাশ পায় না। কিন্তু পরবর্তী বংশধরগুলোতে সেসব প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো আবার প্রকাশ পায়। এই এফ-১কে নিজেদের মধ্যে শংকরায়ন (সেল্ফ ক্রসিং) করা হলে দ্বিতীয় বংশধর এফ-২ পাওয়া যাবে। একইভাবে সেল্ফ ক্রসিং-এর মাধ্যমে এফ-৩, এফ-৪ ইত্যাদি অসংখ্য বংশধর পাওয়া যাবে। এভাবে সেল্ফ ক্রসিং-এর মাধ্যমে প্রতিবার যে বংশধর পাওয়া যাবে তা থেকে যদি কাংখিত বৈশিষ্ট্যের গাছগুলোকে বাছাই করে তাদের মধ্যে সেল্ফ ক্রসিং করা হয় তবে সাধারণত ৭/৮ বংশধরের মধ্যে স্থায়ী কাংখিত বৈশিষ্ট্যের গাছ পাওয়া যায়। এভাবেই উচ্চফলনশীল বা উফশী জাত তৈরি করা হয় যেগুলোকে কম্পোজিট জাত বলা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ দেশের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ধানসহ বিভিন্ন ফসলের অনেকগুলো উচ্চফলনশীল বা উফশী জাত আবিষ্কার করেছে এবং কৃষকদের কাছে দিয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিআর-১০, বিআর-১১, ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৯ ইত্যাদি নামে এযাবৎ ৪৬টি উফশী ধানের জাত কৃষকদের মাঝে দিয়েছে। এই জাতগুলো নিয়ে তেমন-কোন বিতর্ক নেই। কারণ, এই জাতগুলো প্রথম পর্যায়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাঠে ৮-১০ বছর ধরে চাষ করে তার ফলাফল দেখা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে চাষ করে এ দেশের মাটি, পরিবেশ ও ইকোসিস্টেমের উপর এর প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়। সর্বোপরি বৈশিষ্ট্যগুলো স্থায়ী হওয়ার ফলে এসব বীজ থেকে কৃষক নিজে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারে এবং পরের বছর চাষ করতে পারে।
কিন্তু হাইব্রিড জাত নিয়ে নানা বিতর্ক প্রচলিত আছে। হাইব্রিড নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিতর্কটি রয়েছে তা হল উফশী জাতের মত বাংলাদেশের মাটি, পরিবেশ ও ইকোসিস্টেমের উপর এর প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করে এনে চাষের জন্য কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। হাইব্রিড নিয়ে অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কটি রয়েছে তা হল হাইব্রিড বীজ কৃষক নিজে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারেনা। কারণ, শংকরায়নের ফলে যে নতুন জাতের (হাইব্রিড) সৃষ্টি হয় তার বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পূর্ণ অস্থায়ী হয়ে থাকে। ধরা যাক জাত-১ এর ফলন একরে ৭০ মন আর জাত-২ এর ফলন একরে ৮০ মন। এই দুটি জাতের মধ্যে শংকরায়ন করার ফলে প্রথম যে বংশধর হল (হাইব্রিড) তার ফলন হল একরে ১০০ মন। এখন এই ধান থেকে বীজ রেখে যদি পরের বছর চাষ করা হয় তবে তা হবে দ্বিতীয় বংশধর। এই দ্বিতীয় বংশধরে গিয়ে প্রথম বংশধরের মধ্যে থাকা প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়। যার ফলে পরের বছর এই জাত কতটা ফলন দিবে তা নিশ্চিভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে ফলন যে কমবে এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ, দ্বিতীয় বংশধরের বীজ চাষ করলে তা থেকে নানান বৈশিষ্ট্যের গাছ হয়। তাই হাইব্রিড জাতের ধান থেকে বীজ রেখে পরের বছর চাষ করা যায়না। প্রতিবার মাতৃজাত ও পিতৃজাত -এর মধ্যে শংকরায়ন করে প্রথম বংশধর (হাইব্রিড) বীজ তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। এরূপ শংকরায়ন কৃষকের পক্ষে করা সম্ভব হয় না বিধায় কৃষক এই বীজ তৈরি করতে পারে না।
উল্লেখ্য যে, সব এফ-১ হাইব্রিডকেই হাইব্রিড জাত হিসেবে বাজারে ছাড়া হয় না। সেই এফ-১ হাইব্রিডকেই হাইব্রিড জাত হিসেবে বাজারে ছাড়া হয় যার ফলন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মাতৃ বা পিতৃজাত থেকে উৎকৃষ্টতর। তা ছাড়া, যেকোন দুটি জাতের মধ্যে শংকরায়ন করলেই হাইব্রিড জাত পাওয়া যায় না। এরূপ হাইব্রিড জাত বহুবার বহু জাতের মধ্যে শংকরায়ন করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়। কাজেই যে দুটো জাতের মধ্যে শংকরায়ন ঘটিয়ে হাইব্রিড জাত পাওয়া যায় প্রতিবার সে দুটো জাত থেকেই হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে হবে। ফলে, এই মাতৃজাত ও পিতৃজাত যার কাছে থাকবে (যা সব সময় গোপন রাখা হয়) কেবল সেই এই বীজ উৎপাদন করতে পারবে এবং প্রতিবার তার কাছ থেকেই বীজ নিতে হবে। আমাদের দেশে যেসব হাইব্রিড জাত আসছে তার প্রায় সবই আসে চীন ও ভারত থেকে। যেসব চীনা ও ভারতীয় কোম্পানি এই বীজ এ দেশে বিক্রী করে তারা কখনই মাতৃজাত ও পিতৃজাত আমাদেরকে দেয়না বা কোনদিন দিবেওনা। ফলে, আমাদের বীজের জন্য চিরদিন চীন বা ভারতের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। স¤প্রতি পত্রপত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যাতে বলা হয়েছিল যে, চীন সরকার বাংলাদেশে হাইব্রিড বীজ বিক্রী বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক চাল।
কাজেই বিদেশী হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের সাথে এক মারাতœক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট নিহিত রয়েছে। ধরা যাক, বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হাইব্রিড ধান চাষ করা শুরু হল এবং বাংলাদেশ বীজের জন্য চীনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। পক্ষান্তরে, ব্যাপকভাবে হাইব্রিড চাষ করার ফলে কৃষকের হাতেও কোন বীজ রইলনা। এমতাবস্থায়, যদি রাজনৈতিক কারণে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং চীন যদি হাইব্রিড বীজ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তবে দেশে ধান চাষ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। ফলে, বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সর্বোপরি খাদ্য নিরাপত্তা মারাতœক সংকটের মধ্যে পড়বে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের এরূপ নাজুক ও সংবেদনশীল অবস্থার সুযোগ নিয়ে চীন নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হবে যেমনটি বর্তমানে করছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ আমাদের ঋণ নির্ভরশীলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে।
বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বীজ অনুমোদন কমিটি ১৯৯৮ সালে প্রথম যে হাইব্রিড জাত আমদানির অনুমতি দেয় তার নাম আলোক-৬২০১। ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর দেশের বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী, শস্য ও উদ্ভিদ রোগতত্ব বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা এক সেমিনারে হাইব্রিড বীজ সম্বন্ধে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। তারা বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানির কুফল সম্পর্কে বলেন যে, বিনা পরীক্ষায় বিদেশ থেকে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানি বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক আত্মঘাতি পদক্ষেপ হবে। এর মাধ্যমে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষি ও কৃষককে চিরস্থায়িভাবে পঙ্গু করে ফেলা হবে। তারা আরও বলেন যে, হাইব্রিড আমদানির ফলে দেশের কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন পোকামাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আর্বিভাব ঘটবে যা আমাদের কৃষিকে আরও বিপদগ্রস্ত করে তুলবে। পক্ষান্তরে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বালাইনাশক ব্যবসার হবে পোয়াবারো। কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের এসব আপত্তি উপেক্ষা করেই তখন হাইব্রিড জাত আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। অবশ্য তখন কোম্পানিগুলোকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে দেশেই এই বীজ উৎপাদন করতে হবে যা অদ্যাবধিও কোন কোম্পানি পূরণ করে নি। অথচ তারা দিব্যি বিদেশ থেকে বীজ আমদানি ও ব্যবসা করে যাচ্ছে।
পক্ষান্তরে, হাইব্রিড ধান একটি অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর সংবেদনশীল ধান। হাইব্রিড জাতের ধান চাষ আমাদের মাটি, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষকের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ইত্যাদি কোন দিক থেকেই মানানসই নয়। অধিক সংবেদনশীল হওয়ার কারণে এসব জাতে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয় ব্যাপকভাবে। কৃষকরা হাইব্রিড জাত চাষ করলেই ভাল ফলন পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। হাইব্রিড জাতে যতেœর সামান্য ত্র“টি হলেই ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। সঠিক সময় ও সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ, দফায় দফায় বালাইনাশক প্রয়োগ, পর্যাপ্ত সেচ দেওয়া, নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করা ইত্যাদি সকল কাজগুলো যথাযথভাবে করতে না পারলে ফলন কমে যায়। ধরা যাক, একটা হাইব্রিড ধানের জমিতে আজকে সার প্রয়োগ করা দরকার কিন্তু কৃষকের আর্থিক সংকট বা বাজারে সারের সংকটের (যা আমাদের কৃষকদের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা) কারণে সার দিতে যদি কিছুদিন দেরি হয় তা হলে আর আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে প্রথম প্রবর্তিত হাইব্রিড আলোক ৬২০১ জাতটি নিয়ে তখন ব্যাপক প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালানো হয় যে অতি উচ্চ ফলনের এই ধান চাষ করলে দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হবে সময়ের ব্যাপারমাত্র। আজ এটা প্রমাণিত যে, ব্র্যাক ও আইসিআই-এর মাধ্যমে বাজারজাতকৃত প্রথম হাইব্রিড জাত আলোক ৬২০১ ধানের উচ্চ ফলনের দাবি ছিল নিতান্তই মিথ্যা। বহু কৃষক আলোক ৬২০১ ব্যবহার করে প্রতারিত হয়েছেন, সর্বশান্ত হয়েছেন। সারা দেশে এরকম অনেক উদাহরণ আছে। অথচ ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে আমদানি করা এই বীজ তখন কৃষকের কাছে ২০০-২৫০ টাকা দরে বিক্রী করে প্রচুর মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে এই কোম্পানিগুলো। ব্র্যাকসহ কোম্পানিরা হাইব্রিড ধানের পক্ষে একটি যুক্তি বারবার তুলে ধরেন যে হাইব্রিড বীজ যদি খারাপই হবে তবে কেন কৃষকরা নেয়? আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিটা প্রণিধানযোগ্য মনে হলেও বাস্তবতা এই যে, ব্র্যাক যখন তার সদস্যদের ঋণ দেয় তখন ঋণের টাকা দিয়ে হাইব্রিড বীজ নিতে বাধ্য করে। অন্যদিকে, কোম্পানিগুলো নানান প্রচার-প্রোপাগান্ডা ও কৌশলে কৃষকদেরকে হাইব্রিড বীজ গ্রহণ করতে প্ররোচিত করে থাকে। অনেকসময় কোম্পানির প্রতিনিধিরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কৃষকদেরকে বিভ্রান্ত করে হাইব্রিড বীজ বিক্রি করে থাকে। ২০০৮ সালের বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচির নামে সরকারও কোম্পানির হাইব্রিড বীজ কৃষকের হাতে তুলে দিয়েছিল। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, অনেক কৃষক বিশেষ করে ধনী কৃষকরা হাইব্রিড ধান চাষ করে অনেকসময় ভাল ফলন পায়। কারণ তারা হাইব্রিড ধানের জন্য যে অতিরিক্ত খরচ ও পরিচর্যা প্রয়োজন তা ঠিকমতো করতে পারে। কোম্পানিও তাদেরকে প্রদর্শনীর জন্য নানান প্রনোদনা ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। ফলে, কিছুসংখ্যক কৃষক হাইব্রিড ধান চাষ করে ভাল ফলন পায়। তাই দেখে বাকি কৃষকরাও হাইব্রিড চাষে সহজে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, সব কৃষকের জন্য বিশেষ করে দরিদ্র বা হতদরিদ্র কৃষকদের জন্য হাইব্রিড জাত মোটেও উপযোগি নয়।
আলোক ধানের পর বর্তমানে যেসব হাইব্রিড বীজ বাজারে আসছে সেগুলোর ফলাফলও খুব ভাল নয়। প্রথমবার খুব ভাল ফলন দিলেও সোনার বাংলা, জাগরণ, হীরা এগুলো যারা পরপর কয়েকবার চাষ করেছেন তাঁদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত কৃষকের প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাস্তবতা এই যে, আমাদের দেশের কৃষকরা শুধু বাড়তি ফলনটাই বিবেচনায় নেয়। উৎপাদন ব্যয়ের বিবেচনায় লাভ-ক্ষতির সঠিক হিসেব তাঁরা করে না। মাটির উর্বরতা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাবগুলোকেতো আমলেই নেয় না। অন্যদিকে, কোম্পানিগুলো তাদের বীজ বিক্রির কৌশল হিসেবে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি কৃষকদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। কোম্পানিগুলো মাঠ পর্যায়ে যেসব প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করে সেখানে সার্বক্ষণিক কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি বিনামূল্যে সার, সেচ, বালাইনাশকসহ বিভিন্ন উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কাজেই এসব প্রদর্শনী প্লটে কৃষকের মাঠে চাষকৃত অন্যান্য জাতের তুলনায় বেশি ফলন পাওয়া যায়। ফলে, অধিক ফলনের আশায় কৃষক হাইব্রিড ধানের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।
হাইব্রিড বীজের সমস্যাসমূহ
মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের অভিজ্ঞতা থেকে হাইব্রিড বীজের বা জাতের যেসব সমস্যার কথা জানা যায় এবং যেসব কারণে হাইব্রিড বীজ/জাত বিতর্কিত সেগুলো নিন্মে তুলে ধরা হলঃ
১. হাইব্রিড বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল বিধায় কৃষকরা ব্যক্তিগতভাবে এই বীজ উৎপাদন করতে পারে না;
২. বীজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃজাতগুলো প্রতিবছর কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হয়। ফলে, বীজের উপর কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে;
৩. কৃষকরা এই বীজ থেকে বীজ রেখে পরের বছর চাষ করতে পারে না। তাই প্রতিবছর বীজ কিনতে হয় ফলে কৃষকরা বীজের জন্য কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে;
৪. হাইব্রিড বীজের বৈশিষ্ট্যগুলো খুবই অস্থায়ী হয়ে থাকে। তাই ফলন সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
৫. পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিড জাতে অত্যধিক বেশি।
৬. বীজের মূল্য অত্যন্ত বেশি যা গরীব কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
৭. হাইব্রিড জাতে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক লাগে। অনেক ক্ষেত্রে বালাইনাশক দিয়েও পোকা দমন করা যায় না।
৮. বীজের ভেজাল হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে তাই কৃষকরা প্রায়শঃই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
৯. একই জমিতে প্রথমবার বেশি ফলন দিলেও দ্বিতীয়/তৃতীয় বছর থেকে ফলন কমতে থাকে।
১০. হাইব্রিড ধানের ফসল উফশী ধানের তুলনায় ২০-৩০ শতাংশ বেশি দাবি করা হলেও এ বীজের মূল্য উফশী বীজের চেয়ে ১৫-২০ গুণ বেশি।
১১. দেশীয় হাইব্রিড বীজের উদ্ভাবন না করে এ ধরনের বিদেশী বীজ আমদানি এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদের উদ্যোগ কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনবে।
১২. ধানের প্রচলিত অনেক হাইব্রিড জাতের গাছ খুবই নরম হয়। তাই একটু জোরে বৃষ্টি বা বাতাস হলে হেলে পড়ে। ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৩. ধানের প্রচলিত অনেক হাইব্রিড জাতে চিটার পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে ৫০ ভাগেরও বেশি এবং পাকা ধান ঝরে পড়ার হারও বেশি।
১৪. অন্যান্য ধানের তুলনায় এসব ধানে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও শ্রমিকসহ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি।
১৫. এসব ধানের জমিতে সব সময় পানি থাকতে হয়। অর্থাৎ সেচ বেশি লাগে এবং সেচ খরচও বেশি হয়।
১৬. এসব ধান কাঁচা অবস্থায় কেটে নিতে হয় কারণ নিচের ধান পাকতে পাকতে উপরের ধান ঝরতে শুরু করে।
১৭. এসব ধানের ভাতের স্বাদ কম। অনেক জাতের ভাত খুব আঠালো হয় এবং ঠাণ্ডা হওয়ার পর তা প্লাস্টিকের মতো হয়ে যায়।
১৮. বাজারে এসব ধানের চাহিদা ও বাজার মূল্যও কম।
পরিশেষে উল্লেখ্য যে, এ দেশে হাইব্রিড ধান প্রবর্তিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর হাত দিয়ে যিনি কৃষক-বান্ধব মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে, হাইব্রিড জাতের যেহেতু এতসব ক্ষতিকর দিক রয়েছে তা হলে মতিয়া চৌধুরীর মতো এমন একজন ব্যক্তি কেন হাইব্রিড জাত প্রবর্তন করলেন? এর পশ্চাতে প্রধান যে যুক্তিটি খুঁজে পাওয়া যায় তা হল বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রæতহারে বাড়ছে আর তেমনি দ্রæতহারে কমছে ফসলি জমি। এমতাবস্থায়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে একক পরিমান জমিতে ফলন বৃদ্ধির কোন বিকল্প পথ খোলা নেই। হাইব্রিড জাত যেহেতু প্রচলিত উফশী জাতগুলো থেকে অধিক ফলনশীল তাই হাইব্রিড জাত প্রবর্তন করা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। যুক্তিটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য কারণ বেশকিছু সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও প্রযুক্তি হিসেবে এটি প্রবর্তন করা যে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য তা নয়। তবে, কোন বাছ-বিচার ছাড়াই ঢালাওভারে এবং যে প্রক্রিয়ায় বিদেশী হাইব্রিড জাত প্রবর্তন করা হচ্ছে তা কখনই দেশের গোটা কৃষি ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, মাটি, পরিবেশ এমনকি খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও যে কল্যাণকর নয় তা ইতোপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের খাদ্যশস্যের (প্রধানত দানাদার) উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যদি হাইব্রিড জাত প্রবর্তন করতেই হয় তবে আমাদের নিজস্ব হাইব্রিড জাত আবিষ্কার করা উচিত। যদি সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয় এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হয় তবে আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষে হাইব্রিড জাত আবিষ্কার করা মোটেও অসম্ভব নয়। তবে, ধানের হাইব্রিড জাত যেহেতু মাটি থেকে অধিক পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে, বেশি সেচ লাগে এবং অনেক বেশি সংবেদনশীল তাই সারাদেশে ঢালাওভাবে হাইব্রিড জাত ছড়িয়ে না দিয়ে তা কেবল নিচু ও একফসলী বোরো ধানের জমিতে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।
জিএম বীজ
জিএম বীজ কি তা বুঝতে হলে প্রথমে জিন এবং ডিএনএ সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। নিম্নে এ দুটি বিষয় সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
১. জিন (Gene)
জিন হল বংশগতির ধারক ও বাহক। এই পৃথিবীতে হাজারো রকমের জীব অথচ কোন জীবের সাথে অন্য কোন জীবের হুবহু মিল নেই। একেকটি জীবের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। এমনকি শুধু মানুষের কথা ধরা হলেও দেখা যাবে যে, একই বাবা মার সন্তানদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবের এরূপ বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে জিন। প্রত্যেক জীবের দেহে থাকে কোষ; কোষে থাকে নিউক্লিয়াস; নিউক্লিয়াসে থাকে ক্রমোসোম; আর ক্রমোসোমে থাকে এই জীন।
২. ডিএনএ (DNA)
ডিএনএ থাকে জিনের মধ্যে র্অথাৎ জিন গঠিত হয় ডিএনএ দ্বারা। জিনের মধ্যে যে ডিএনএ থাকে তার গঠনের উপরই জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে। কাজেই ডিএনএ-এর গঠনের পরিবর্তন করা হলে জীবের গঠনেরও পরিবর্তন ঘটে।
আজকাল এক বিশেষ ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিএনএ-এর গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন নতুন জাত তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির নাম জৈব প্রযুক্তি বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে ডিএনএ তথা জিনের গঠন পরিবর্তন করে যেসব নতুন জীব তৈরি করা হয় তাদের বলা হয় জিএমও (GMO=Genetically Modified Organism) এবং এভাবে যে উদ্ভিদ তৈরি করা হয় তাকে বলা হয় জিএম উদ্ভিদ এবং এসব উদ্ভিদ থেকে যে বীজ হয় তাকে জিএম [Genetically Modified (GM)] বীজ বলা হয়। জিএম বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্য প্রজাতির উদ্ভিদ এমনকি প্রাণীর ডিএনএ-এর অংশ বিশেষ কেটে এনে এক জটিল প্রক্রিয়ায় কাংখিত উদ্ভিদের দেহে ঢুকিয়ে তার জিনের স্বাভাবিক গঠনকে রূপান্তরিত করে জিএম উদ্ভিদ বা ফসল তৈরি করা হয়।
বিশ্বব্যাপী জিএম বীজের বিতর্ক
নানা কারণে জিএম শস্য আজ বিশ্বব্যাপী বিতর্কিত। জিএম শস্যের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও দরিদ্র কৃষকের বীজ নিরাপত্তার প্রশ্নে সারাবিশ্বের পরিবেশবাদী বিজ্ঞানীসহ সর্বস্তরের সচেতন মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। পাশাপাশি কোন জীবের জীনের গঠন পরিবর্তন করার নৈতিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। কারণ, জিনের গঠনই জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে অর্থাৎ জিনের গঠনের ভিন্নতার কারণেই একটি জীব বা কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীর একটি জাত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। কাজেই, জিনের গঠনগত পরিবর্তন সাধন করার ফলে জীবের আসল বৈশিষ্ট্যই আর অক্ষুন্ন থাকে না। তা ছাড়া, জীনের গঠনের এরূপ পরিবর্তনের ফলে নতুন যে জাত তৈরি হয় তা আর সেই প্রজাতি থাকবে কি-না তাই প্রশ্ন সাপেক্ষ।
অন্যদিকে, জিনের গঠনের এরূপ রূপান্তরের ফলে পরিবেশ দূষণের বড় ধরণের ঝুঁকি থেকে যায়। তা ছাড়া, টার্মিনেটর প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব বীজকে বন্ধ্যা করে দেওয়া হয় যাতে কৃষকরা এরূপ বীজ একবারের বেশি ব্যবহার করতে না পারে। কাজেই জিএম বীজ-এর ব্যবহার বিশ্বের বিশেষ করে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের কৃষি ব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব বীজ ব্যবহার করে কৃষকেরা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা লাভবান হলেও নানাভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগানোর জন্য জিএম শস্য প্রবর্তনের কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত এমন কোন জিএম জাত আবিষ্কৃত হয় নি যা ফলন বাড়াতে পারে। ভবিষ্যতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোন উচ্চ ফলনশীল জাত আবিষ্কার করা যাবে কি-না সন্দেহ কারণ কোন ফসলের ফলন একক কোন জিন নিয়ন্ত্রণ করেনা। জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু জাতের কিছু গুণাগুণের পরিবর্তন করা হয়। যেমনঃ বর্তমানে বাংলাদেশে জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ততা প্রতিরোধী, রোগ ও পোকা প্রতিরোধী জাত আবিস্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। সাধারণ শংকরায়নের মাধ্যমেও এসব গুণাবলী পাওয়া সম্ভব।
জিএম শস্যের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, জিএম খাদ্য থেকে অপ্রত্যাশিত এলার্জি ও বিষাক্ততা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মাটিস্থ অনুজীবের উপর জিএম ফসলের সুদুরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। ২০০৩ সালে বৃটেনে দেশব্যাপী এক বিতর্কে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সেদেশে জিএম ফসল প্রবর্তন একেবারে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেয়। বাকি অর্ধেকের অধিকাংশই যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জিএম ফসল প্রবর্তনের পক্ষে মত দেন।
২০০৩ সালে ভারতে ‘বিটি কটন’ নামক জিএম তুলার জাত প্রবর্তন করা হয়েছিল যা চাষ করে হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেক কৃষক আতœহত্যার পথ বেছে নেয়। এটা ইতোমধ্যেই প্রমানিত যে, জিএম শস্য ফসলের স্থানীয় জাতগুলোতে কৌলিক দূষণ ঘটায়। ইটিসি গ্র“পের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেক্সিকোর স্থানীয় ভূট্টার মধ্যে মোনমান্টো কোম্পানি প্রবর্তিত জিএম ভূট্টার জিন পাওয়া গেছে যা ঐসব জাতের আদি বৈশিষ্ট্যগুলোকে নষ্ট করে দিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের মতো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশের জন্য বিদেশী কোম্পানির জিএম শস্য প্রবর্তন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে।
সর্বোপরি, জিএম বীজ কৃষক নিজেরা উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে না। ফলে, এসব বীজের ফসল চাষ করা হলে এখনও কৃষকের হাতে যেসব বীজ আছে সেগুলোও একসময় অবধারিতভাবেই হারিয়ে যাবে। বীজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে কোম্পানির হাতে। তখন, কৃষক কী ফসল চাষ করবে না করবে তা নির্ধারণ করবে কোম্পানি। একদা যে নীল চাষ করানোর জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অমানুষিক নির্যাতনের আশ্রয় নিতে হয়েছে নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তা করতে মোটেও বেগ পেতে হবেনা। উদাহরণস্বরূপ তামাক ও ভূট্টা চাষের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ দেশে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য জমি কমছে তখন তামাক চাষের জমি বেড়ে চলেছে। ধুমপান এবং তামাক চাষের নানারকম ক্ষতিকর প্রভাবের কথা আমরা সবাই জানি এমনকি কৃষক নিজেরাও জানে। তামাক চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, তামাক চাষ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য, ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ, স্বাস্থ্যের ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর – এসবই তাঁদের জানা। তবুও তাঁরা তামাক চাষ করে কারণ তামাক চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা। অর্থাৎ কোম্পানি কৃষকের উৎপাদিত সব তামাক ভাল দামে কিনে নেয় যে সুবিধা অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে কৃষক পায় না। তা ছাড়া, কোম্পানি বীজ (যে বীজ কোন কৃষকের কাছে নেই) সার, বালাইনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ কৃষককে সরবরাহ করে থাকে। কাজেই কৃষক তামাক চাষ করতে অধিক আগ্রহী। কোম্পানি যদি চায় এ দেশের অর্ধেক জমিতে শুধু তামাক চাষ হবে তবে তাই কৃষকরা করবে। এখন ভূট্টার কথা ধরা যাক। শিল্পোন্নত দেশগুলো ইদানিং ভূট্টা থেকে গাড়ির জন্য জ্বালানি তৈরি করছে। এখন যদি কোম্পানি এ দেশের কৃষকদেরকে দেখায় যে, ভ‚ট্টা চাষ অন্য সকল ফসল থেকে বেশি লাভজনক। তা ছাড়া, কোম্পানি ভূট্টা চাষের জন্য অতি উচ্চফলনশীল বীজ দিবে যা ঐ কোম্পানি ছাড়া অন্য কারও কাছে নেই। এছাড়া, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ইত্যাদি উপকরণগুলোও কোম্পানি সরবরাহ করবে এবং প্রয়োজনে কৃষককে স্বল্পসুদে বা বিনাসুদে ঋণও দিবে। এবং সর্বোপরি ভাল দামে সেই ভ‚ট্টা কৃষকের কাছ থেকে কোম্পানি কিনে নিবে। এমতাবস্থায়, সব ফসল ফেলে কৃষক যে ভ‚ট্টা চাষের দিকে ঝুঁকবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
যাহোক, যেসব কারণে জিএম বীজ নিয়ে সারা বিশ্বে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা নিন্মে তুলে ধরা হল।
যেসব কারণে জিএম বীজ বিতর্কিত
১. জিএম বীজের রূপান্তরিত জিনের প্রভাবে মাটির অনুজীব, মানুষ এবং প্রাণীদেহে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স সৃষ্টি হয়।
২. জিএম শস্যের প্রভাবে জীবদেহে নানারকম অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য জন্ম নিতে পারে।
৩. জিএম খাদ্য মানুষ ও প্রাণিদেহে বিষাক্ত দ্রব্য তৈরি করে এবং এলার্জির লক্ষণ দেখা যায়।
৪. জিএম ফসলের ফুলের রেণু আশেপাশের অন্য ফসলে গিয়ে পড়লে তার কৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
৫. এসব ফসল প্রাকৃতিক ইকো-সিস্টেম, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
৬. এসব ফসল অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল প্রযুক্তিনির্ভর।
৭. এ পর্যন্ত এমন কোন জিএম জাত আবিষ্কৃত হয় নি যা ফলন বাড়াতে পারে। জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু জাতের কিছু গুণাগুণের পরিবর্তন করা হয়।
৮. এসব ফসলের ক্ষতিকর প্রভাব, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিসমূহ পরীক্ষা না করেই বাজারজাত করা হচ্ছে।
৯. জিএম প্রযুক্তির একচ্ছত্র মলিক গুটিকয় বহুজাতিক কোম্পানি। ফলে, সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।
১০. জিএম বীজ প্যাটেন্টকৃত হওয়ায় তা উচ্চমূল্যের হয়ে থাকে যা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
১১. জিএমও-র দূষণ একবার পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে তা রোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
জিএম ও প্যাটেন্ট বিতর্ক
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তি অনুযায়ী জিএম জাত প্যাটেন্টযোগ্য। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির প্যাটেন্ট আইনের আর্টিকেল ২৭.৩ (বি) ধারা এবং উপোভ চুক্তিতে নতুন উদ্ভাবিত জাতের উপর বাণিজ্যিক প্রজননবিদদের একচ্ছত্র মালিকানা লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে যা আমাদের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও কৌলিক সম্পদের (জেনেটিক রিসোর্স) উপর বহুজাতিক কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করছে। এরূপ প্যাটেন্ট কৃষক এবং রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রজননবিদদের জন্য বীজ ও কৌলিক সম্পদের সহজপ্রাপ্যতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ এই প্যাটেন্ট আইন বীজ সম্পদের উপর কোম্পানির একক মালিকানা ও একচেটিয়া বাণিজ্যের গ্যারান্টি দেয়। ফলে বীজের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকায় বীজের মূল্য সাধারণ কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অথচ কৃষক এসব বীজ থেকে নিজেরা বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে না বিধায় প্রতিবছর কোম্পানির কাছ থেকেই বীজ কিনতে বাধ্য হবে।
বিশ্বব্যাপী জিএম শস্য প্রতিরোধ সংগ্রাম
আজ সারা বিশ্বেই জিএম ফসল প্রবর্তন প্রতিরোধের জন্য সংগ্রাম চলছে। জিএম ফসল প্রবর্তক বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, ভোক্তা ও সচেতন নাগরিক সমাজ কর্তৃক বিক্ষোভ প্রদর্শন, প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। স¤প্রতি শুধুমাত্র বৃটেনেই জিএম ফসল ধ্বংস ও পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে ৩০০ টিরও বেশি। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রভাব এতটাই যে, তাদের টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতা বিশ্বের বেশিরভাগ সরকারেরও নেই। তাই এত বিতর্ক, এত প্রতিবাদ সত্বেও আইন করে জিএম শস্য প্রবর্তন রোধ করতে আগ্রহী নয় অনেকেই। কারণটাও খুবই সুস্পষ্ট। মার্কিন কোম্পানি মোনসান্টো একাই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের প্রায় ৯১% জিএম বীজের বাজার। তবুও আশার কথা এই যে, জনতার শক্তি ও জনপ্রতিরোধের মুখে আজ হউক কাল হউক সকল শক্তিই পরাভূত হয়। যেমন, ১৯৯৪ সালে মোনসান্টো ‘ফ্ল্যাভার সেভার’ নামক একটি জিএম টম্যাটোর জাত বাজারজাত করে যা দীর্ঘদিন যাবৎ রেখে দিলেও পঁচন ধরেনা। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ভোক্তাদের প্রতিবাদের মুখে ১৯৯৬ সালে এ জাতের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কাজেই, কৃষকের বীজের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দেশের জীববৈচিত্র্য ও কৌলিক সম্পদ রক্ষা এবং এ দেশের কৃষি ব্যবস্থার আশু বিপর্যয় রোধে সময় থাকতে সোচ্চার হওয়া জরুরী। এ ব্যাপারে কৃষক এবং সচেতন মহলের সোচ্চার ও জোড়ালো ভূমিকা গ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
বাংলাদেশে জিএম বীজ প্রবর্তন ও ‘গোল্ডেন রাইস’ বিতর্ক
বাংলাদেশে বৈধভাবে এখনও কোন জিএম শস্য প্রবর্তিত হয় নি। তবে, অবৈধভাবে কোন জিএম বীজ বাংলাদেশে ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে কি-না তা বলা মুশকিল। কারণ, বাংলাদেশ বিভিন্ন ফসলের বিশেষ করে শাক-সব্জির প্রচুর বীজ বাইরে থেকে ঢুকছে। এসব বীজের সাথে কোন জিএম বীজ ঢুকছে কি-না এবং তা যথাযথভাবে রোধ করা হচ্ছে কি-না তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। তবে, কোন জিএম খাদ্য যে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেনা তা নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব নয়।
যাহোক, সম্প্রতি দেশে জিএম ধান “গোল্ডেন রাইস” প্রবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) যৌথভাবে একটি গবেষেণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমরা জানি যে, ধানে ভিটামিন-এ খুব একটা থাকেনা। ভিটামিন-এ এর ধারক হল বিটা কেরোটিন। সবুজ শাক-সব্জি ও হলুদ ফলমূলে প্রচুর পরিমানে এই বিটা কেরোটিন বা ভিটামিন-এ থাকে। ডেফোডিল নামক ফুলেও এই বিটা কেরোটিন থাকে। কোন উদ্ভিদে এই বিটা কেরোটিন থাকবে কি থাকবেনা তা নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট এক জিন। ডেফোডিল ফুলের বিটা কেরোটিন নিয়ন্ত্রণকারী এই জিনের ডিএনএ’র নির্দিষ্ট অংশ কেটে নিয়ে ধানের কোন জাতের জিনের মধ্যে সেই অংশটি ঢুকিয়ে দিয়ে এই নতুন একটি জাত সৃষ্টি করা হয় যার নাম দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন রাইস। গবেষেণাকর্মটি পরিচালিত হচ্ছে বহজাতিক কোম্পানি সিনজেন্টার টাকায় ইরির মাধ্যমে। সামনে ইরি পেছনে সিনজেন্টা। এ দেশের মানুষের ভিটামিনের অভাব দূর করে অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সিনজেন্টার যেন ঘুম হারাম। আমরা বেশি ভাত খাই বলে ধানের মধ্যে ভিটামিন-এ ঢুকিয়ে আমাদের ভিটামিনের অভাব দূর করার এক হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে এই গোল্ডেন রাইস তৈরি করা হচ্ছে। গোল্ডেন রাইসের ভাত খেয়ে যদি ভিটামিন-এ এর অভাব দূর করতে হয় তবে একজন পূর্ণবয়স্ক মহিলার প্রতিদিন ৭.৫ কেজি ভাত খেতে হবে তাও যদি শরীর সবটা হজম করতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম গোল্ডেন রাইস থেকে মাত্র ৩০ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন বা ভিটামিন-এ পাওয়া যাবে। অথচ, আমাদের দেশী জাতের লাল চালে এর চেয়ে আনেক বেশি বিটাক্যারোটিন আছে যেসব ধান আজ বিলুপ্তির পথে। বনে-বাদাড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা ১০০ গ্রাম হেলেঞ্চা শাকে ১৩৭০০ মাইক্রোগ্রাম, থানকুনি শাকে ১৩১০০ মাইক্রোগ্রাম, কলমী শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম, কালোকচু শাকে ১২০০০ মাইক্রোগ্রাম এবং সবুজকচু শাকে ১০২৭৮ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন আছে। যেসব গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে গোল্ডেন রাইস তৈরি করা হচ্ছে তাদের আশেপাশে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এমন অসংখ্য খাদ্যবস্তু রয়েছে যা নিতান্ত অসচেতনতার জন্য তারা খায়না। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন ছিল সচেতনতা সৃষ্টির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। তা না করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ফলনশীল জাত ব্রিধান-২৯(কৃষকের মাঠে যার ফলন অনেক ক্ষেত্রে হাইব্রিডের ফলনকেও ছাড়িয়ে গেছে)-কে জিএম ধানে রুপান্তরের চেষ্টা চলছে যা কোম্পানি পেটেন্ট করে নিতে পারবে। কারণ, এই ‘গোল্ডেন রাইস’ প্রযুক্তি কোম্পানির প্যাটেন্ট করা। যদিও বলা হচ্ছে যে, এই গোল্ডেন রাইস মানব কল্যাণে সিনজেন্টার দান তাই এটি প্যাটেন্ট করা হবেনা।
অন্যদিকে, দেশে চারটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) শস্য প্রবর্তনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করনেল ইউনিভার্সিটি এবং মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID=United States Agency for International Development)-এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এই গবেষণার উদ্দেশ্য হল, ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী বেগুন ও মটর, লেইট বøাইট রোগ প্রতিরোধী গোলআলু এবং লবণাক্ততা প্রতিরোধী ধানের জিএম জাত উদ্ভাবন করা। সন্দেহ নেই যে, উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের জাত আবিষ্কার করা আমাদের জন্য খুবই দরকারী। তবে তা জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করেই করতে হবে তা বোধহয় ঠিক নয়। কারণ, সাধারণ শংকরায়ন বা মিউটেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এমন জাত আবিষ্কার করা সম্ভব। তা ছাড়া, এসব নতুন আবিষ্কৃত জাতের মালিকানার ব্যাপারে চুক্তিতে কি ধরণের শর্ত রয়েছে তা সুস্পষ্ট নয়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, একদা ‘বন্ধাকরণ’ প্রক্রিয়ায় পোকামাকড় দমনের জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল যা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের জন্য কোন কোম্পানিই আগ্রহ দেখায়নি। কারণ একটাই, এখানে মুনাফা অর্জনের সুযোগ ছিল কম। সুতরাং কোম্পানি পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গলদঘর্ম হবে – এমনটা ভাবা আর বোকার স্বর্গে বাস করা একই কথা। বরং ক্ষুধা নিয়ে বাণিজ্য করাই যে কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য এতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। কাজেই কোম্পানির মোটা অংকের বেতনভোগী দেশী-বিদেশী গবেষক-বিজ্ঞানীদের চটকদার যুক্তিতে ভুলে জিএম শস্য প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত হবে একেবারেই আতœঘাতী। কারণ, আমাদের এখনও যেসব নীতি আছে তাতে জিএম বীজ এ দেশে ঢুকতে পারেনা। কাজেই, বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের দেশী-বিদেশী এজেন্টরা আজ উঠে-পড়ে লেগেছে যাতে বাংলাদেশ জিএম শস্য প্রবর্তনের জন্য আশু উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য একদিকে রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক কার্যকর সুই জেনেরিস সিস্টেম হিসেবে উপভ চুক্তি গ্রহণের চাপ আর অন্যদিকে রয়েছে উপরোল্লেখিত গবেষণার মাধ্যমে দেশে জিএম শস্য প্রবর্তনের গবেষণা পর্যায়ের উদ্যোগ। এসব গবেষণার ফলাফল যাই হোক না কেন বহুজাতিক কোম্পানি বা তাদের এজেন্টদের উপরোল্লেখিত বিনিয়োগের আসল উদ্দেশ্য যে বাংলাদেশের বাজারে তাদের জিএম প্রযুক্তি প্রবেশের পথ পরিষ্কার করা তাতে বোধহয় সন্দেহের অবকাশ নেই।
কৃষির যেকোন নীতি এখন আর দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার ফলে স্বাধীনভাবে নীতি প্রণয়ের সুযোগ এখন সীমিত। কিন্তু তবুও আমাদের স্বার্থবিরোধি কোন অন্যায় নীতি যাতে আমাদের উপর চেপে না বসে তা প্রতিরোধ ও তার জন্য দরকষাকষি করার সুয়োগ এখনও আমাদের রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের বীজ নীতিতে এ দেশের বাজারে বহুজাতিক কোম্পানির অবাধ অনুপ্রবেশকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি “প্ল্যান্ট ভ্যারাইটি অ্যাক্ট অব বাংলাদেশ” নামক একটি বিধিমালা প্রস্তাব করে যাতে এ দেশে জিএম শস্যের অনুপ্রবেশ রোধে সুস্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। এই বিধিতে বলা হয়েছে যে, যদি কোন জাত জেনেটিক ও সাংস্কৃতিক দুষণ ঘটায় তবে তা সংরক্ষণ করা যাবেনা। কিস্তু প্রস্তাবিত এই আইনটি কার্যকর করার কোন উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছেনা। এর প্রধান কারণ, এ দেশে জিএম বীজ প্রবর্তনের জন্য অনুক‚ল নীতি গ্রহণের জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ এবং তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের নীতি নির্ধারক মহলের উপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার ও চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে যাতে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তিতে বর্ণিত “সুই জেনেরিস সিস্টেম” হিসেবে “উপভ” গ্রহণ করে।
আজ থেকে প্রায় চলিশ বছর আগে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন এবং সেচ, রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের ম্যাধমে পৃথিবীর দক্ষিণ ভূখণ্ডে তথাকথিত যে ‘সবুজ বিপ্লব’ সূচীত হয়েছিল জিএম-ফসল তাতে নতুন সংযোজন। আজ বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও কৃষি ব্যবসায়ী মহল কৃষির সকল সমস্যা সমাধান, বিশ্ব থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়াস পাচ্ছেন। কিছু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন নানাবিধ ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপকরণের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এমন অস্থায়িত্বশীল কৃষি প্রযুক্তির দ্বারা কৃষির বর্তমান অবস্থায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কতটা সম্ভব তা বর্তমানে পরিবেশ ও মানবতাবাদী কৃষি বিজ্ঞানী এবং সচেতন মহলের কাছে এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
এটা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান বিশ্বের বিপুল সংখ্যক নিরন্ন মানুষের খাদ্যের যোগান দেওয়া কৃষিখাতের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন কৃষকনির্ভর একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা। অথচ আর্তমানবতার এরূপ সংকটকে পুঁজি করে জনগোষ্ঠীর স্বার্থ, কৃষকের অধিকার, পরিবেশের ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ও ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে একদল অর্থলোভী তথাকথিত বিজ্ঞানী অর্থের বিনিময়ে নিজেদেরকে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিয়ে কোম্পানির ফরমায়েশে এমন ধরণের কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন যাতে কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা নিশ্চিত হয়। এজন্য শুধু প্রযুক্তির চটকদার কারিশমায় না ভুলে প্রযুক্তির পশ্চাতের মানুষ এবং তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সতর্ক হওয়া জরুরী। কারণ, যেকোন প্রযুক্তিরই ভাল-মন্দ দুটো দিকই থাকে যা হাইব্রিড ও জিএম প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও আছে নিঃসন্দেহে। কোন প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে, না ধ্বংসাতœক কাজে ব্যবহৃত হবে তা নির্ভর করে কে কোন উদ্দেশ্যে সে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করছে। হাইব্রিডাইজেশন এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রায় যুগান্তকারী সংযোজন। কিন্তু এই প্রযুক্তিগুলো যেভাবে গুটিকতক দৈত্যসম বহুজাতিক কোম্পানির কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে তা বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের দরিদ্রতর কৃষকদের জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। কাজেই প্রযুক্তির এরূপ কুক্ষিগত হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যেমন জরুরী তেমনি জরুরী ঢালাওভাবে এসব প্রযুক্তি আমদানি না করে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে অধিকতর নজর দেওয়া।
প্রকৃতপক্ষে, তড়িঘড়ি করে ঢালাওভাবে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড ও জিএম ফসলের প্রবর্তন আমাদের জন্য একেবারেই অপরিহার্য নয়। তদুপরি, আমাদের নিজস্ব হাইব্রিড ও জিএম ফসল উদ্ভাবনের সম্ভাবনাও রয়েছে। এজন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনে গত কয়েক দশক যাবৎ আমাদের প্রচেষ্টা একটি চরম ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে যার ফলে আমাদের নিজস্ব একটি সমন্বিত ও স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। আজ আমরা জোর গলায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বলি অথচ, দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠী তাদের প্রয়োজনীয় ক্যালরি থেকে বঞ্চিত। বিষাক্ত খাদ্য আমাদেরকে নীরব ঘাতকের মত ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কেবল বিদেশী সাহায্য ও প্রযুক্তির মুখাপেক্ষি হয়ে থেকেছি। এ দেশের মাটি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে উঠে এমন লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আমাদের মনোযোগ ছিল চরম হতাশাব্যঞ্জক। এখনও যদি আমাদের বোধোদয় হয় তবে এ মুহূর্তে করণীয় হবে-
১. ভোক্তা, কৃষক, ব্যবসায়ী, নীতি নির্ধারক, সুশীল সমাজসহ সকলকে কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড ও জিএম বীজ ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
২. রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশী সাহায্য এবং বহুজাতিক কোম্পানির টাকায় পরিচালিত গবেষণা নয়, সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে জনকল্যাণমুখি, স্থায়িত্বশীল ও লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা কর্মকাণ্ড জোরদার করা।
৩. কৃষকদেরকে তাদের নিজস্ব বীজ এবং স্থানীয় জাত সংরক্ষণে উদ্যোগী করে তোলা এবং বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা।
৪. পরিবেশগত ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া এ দেশের কৃষিতে বিদেশী হাইব্রিড ও জিএম বীজের ঢালাও প্রবর্তন বন্ধ করা।
৫. বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি থেকে কৃষিকে বাদ দেওয়া এবং ট্রিপস চুক্তি থেকে জীবের উপর প্যাটেন্ট বাতিল করার জন্য উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া।
বীজ ছাড়া ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। কাজেই বীজের নিয়ন্ত্রণ যদি কোম্পানির হাতে চলে যায় তবে আমাদের কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তা দুটোই চলে যাবে কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। কোম্পানি থেকে বীজ পেলে আমাদের চাষাবাদ হবে এবং পেটের ভাত জুটবে, অন্যথায় নয়। এরূপ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিশ্চয় আমাদের কাম্য নয়। যদি তাই হয় তবে এখনই সময় এই বহুজাতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া; প্রয়োজন রুখে দাঁড়ানোর। কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে যদি আমাদের আহার না জুটে তবে না খেয়ে মরাও ঢের ভাল।
বর্তমান বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের ফলে মানুষের সকল মৌলিক অধিকারগুলোও কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আজ আামাদের খাওয়া-পরা, সুস্থভাবে বেঁচে থাকা, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা সবই নিশ্চিত করবে কোম্পানি এবং তা করবে অবশ্যই অর্থের বিনিমিয়ে। কাজেই অবস্থা এমন দাড়াবে যে, অর্থ আছে তো বাঁচো, র্অথ নেই তো মরো। আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন-শোষণ দেখেছি। আমরা দেখেছি কৃত্রিমভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে দুহাতে মুনাফা লুটতে। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মুনাফা যেখানে মুখ্য মানবতা সেখানে উপেক্ষিত। আজ নতুন করে ফিরে আসছে নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। সুতরাং সময় থাকতে আমাদেরকে সাবধান হতে হবে।
by শহীদুল ইসলাম | Mar 30, 2025 | প্রকৃতি কথা
নয়াউদারনীতির বাজার অর্থনীতির গ্যারাকলে পড়ে এ দেশের কৃষির উপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই শিথিল হচ্ছে। ক্রমেই এ নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে বাজার নিয়ন্তাদের হাতে যেখানে কৃষকের কোন স্থান নেই। অথচ একসময় কৃষি ছিল সম্পূর্ণভাবে কৃষকের নিয়ন্ত্রণাধীন। ১৯৫০ সালের দিকে জমিদারদের হাত থেকে কৃষক তার জমির মালিকানা পুণরায় ফিরে পাওয়ার পর থেকে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা আবারও কৃষকের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে। কিন্তু মাত্র এক দশকের মাথাতেই অর্থাৎ ষাটের দশকের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া ‘সবুজ বিপ্লব’ কৃষি ব্যবস্থাকে আবারও কৃষকের কব্জা থেকে বাজারে তুলে এনেছে। কৃষি এখন বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। কৃষকের স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থাকে ‘মান্ধাতার আমলের’ আখ্যা দিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের নামে সবুজ বিপ্লবের স্রোতধারায় যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল তা আজ কৃষকের জীবন ব্যবস্থাকেই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। আর এ বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছিল বীজের মাধ্যমেই।
বীজের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি তাই এ দেশের কৃষক ও হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী স্বনির্ভর কৃষির অস্তিত্বের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। কৃষিপ্রধান এ দেশের বীজের বিশাল বাজার দখলের সুদুরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রবর্তন করছে হাইব্রিড ও জেনিটিক্যালি মডিফায়েড (জিএম) বীজ। কোম্পানির প্যাটেন্ট করা এসব বীজ কৃষক নিজেরা উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে না। অন্যদিকে, এসব বীজের ফসল চাষ করলে এখনও কৃষকের হাতে যেসব বীজ আছে একসময় অবধারিতভাবে সেগুলোও হারিয়ে যাবে। এতে করে শুধু কৃষক নয় দেশের গোটা কৃষি ব্যবস্থাই জিম্মি হয়ে পড়বে বহুজাতিক কোম্পানির উপর যা প্রকারান্তরে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেও মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলে দিবে।
বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। হাজারো জাতের ফসল, পশুপাখি, গাছপালা অতুলনীয় সমৃদ্ধি দান করেছে এ দেশের জীববৈচিত্র্যকে। উফশী ধানের ক্রমবর্ধমান চাষ আমাদের ফসল বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে। আগের দিনের সুগন্ধি আতপ চালের পোলাও, নানা ধরণের পিঠা-পায়েস, শালি ধানের চিড়ে, বিন্নি ধানের খৈ ইত্যাদি মিলে আমাদের ছিল বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস। এসবই এখন অতীত। একসময় বাঙালীর ঘরে ঘরে ছিল ‘বারো মাসে তের পার্বন’। বিশেষ জাতের ধানের চিড়া, মুড়ি, খৈ, পিঠা-পায়েস ছিল এসব পার্বনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ধানের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে আজ এসবই আমরা হারিয়েছি। অন্যদিকে, ধানের ফলন ও উৎপাদন বাড়লেও ডাল জাতীয়, তেল জাতীয়, মসলা জাতীয় ফসল এবং শাক-সব্জির উৎপাদন কমেছে যা আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের দেশী জাতগুলো আমাদের পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে বেড়ে উঠতো। পরিবেশের বর্তমান বিপর্যয় বহিরাগত জাত চাষ করার দীর্ঘমেয়াদি ফল। আমাদের এ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও ফসলবৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির পথে। এই ফসলবৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক যে বীজ সে বীজ সম্পদের কোন সঠিক হিসাব আজ পর্যন্ত করা হয় নি।
বীজ সম্পদের উপর বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ
বহুজাতিক কোম্পানির বীজ বাণিজ্যের ইতিহাস বেশি পুরনো নয়। ১৯৩৫ সালে নরিন-১০বি জাতের উচ্চফলনশীল গম বীজ প্রবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানির বীজ বাণিজ্যের সূচনা হয়। এসময় গবেষণা ও উন্নয়নের নামে সারা বিশ্বের কৃষি বাণিজ্যকে গ্রাস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে, যেহেতু এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ দেশের অন্যতম প্রধান ফসল ধান তাই এশিয়ার কৃষির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিনী প্রতিষ্ঠান রকফেলার এন্ড ফোর্ড ফাউন্ডেশন ১৯৬০ সালে ফিলিপাইনে প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি)। এটা ছিল সবুজ বিপ্লবের সূচনা পর্ব যা বহুজাতিক কোম্পানির জন্য খুলে দেয় বীজ, কৃষি রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং কৃষি যন্ত্রপাতির বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার দ্বার।
১৯৭০-এর দশক জুড়ে বিশ্বের মূলত বালাইনাশক উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের শক্তি-সামর্থ্যকে সুসংহত করে এবং কৃষি বাণিজ্যের উপর একচ্ছত্র ও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একে অপরকে আত্ত¡ীকরণের মাধ্যমে দানবীয় আকার ধারণ করে। যেমনঃ নোভার্টিস ও এস্ট্রাজেনেকা একসাথে মিলে হয়েছে সিনজেন্টা, রোন-পোলেন্ক ও এগ্রো-ইভো মিলে হয়েছে এভেন্টিস ক্রপ সায়েন্স ইত্যাদি। এরূপ পাঁচটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানি যেমনঃ সিনজেন্টা, এভেন্টিস, মোনসান্টো, বিএএসএফ ও ডু-পন্ট বর্তমান বিশ্বের বীজ, বালাইনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বের বীজ বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ এবং জিএম বীজের প্রায় ১০০% নিয়ন্ত্রণ করছে এই পাঁচটি কোম্পানি। মোনসান্টো একাই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের প্রায় ৯১% জিএম বীজের বাজার। ধান, গম, ভূট্টাসহ প্রধান প্রধান ফসলের জাতের উপর এ পর্যন্ত প্রায় ৯০০০টি প্যাটেন্ট দেওয়া হয়েছে যার ৪৪%ই মাত্র চারটি বড় বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। বীজের উপর কোম্পানির এরূপ একক মালিকানা প্রতিষ্ঠা যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, বীজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা গোটা খাদ্য চক্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারই নামান্তর।
‘ট্রিপস’ চুক্তি, ‘উপোভ’ এবং কৃষকের বীজের অধিকার
খাদ্য ও কৃষির জন্য কৌলিক সম্পদের (জেনেটিক রিসোর্স) উপর প্যাটেন্ট বীজের উপর বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকেই ত্বরান্বিত করছে যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা এমনকি জীবিকার জন্যও মারাতœক হুমকির সৃষ্টি করছে। এরূপ প্যাটেন্ট কৃষক ও প্রজননবিদদের জন্য বীজ ও কৌলিক সম্পদের সহজপ্রাপ্যতাকে বাঁধাগ্রস্ত করবে। কারণ, এই প্যাটেন্ট আইন কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের গ্যারান্টি দেয়। ফলে, বীজের বাজার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকায় তা সাধারণ কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে তার কোনই নিশ্চয়তা নেই। অথচ কৃষক এসব বীজ থেকে নিজে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবে না বিধায় প্রতিবছর কোম্পানির কাছ থেকেই বীজ কিনতে বাধ্য হবে।
ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য কৃষক বা প্রজননবিদের জন্য উদ্ভিদের কৌলিক সম্পদের (চষধহঃ এবহবঃরপ জবংড়ঁৎপবং-চএজং) সহজলভ্যতা অপরিহার্য। আবহমান কাল ধরে যেসব জাত কৃষকরা চাষ করে আসছিল সেগুলো কৃষকেরই আবিষ্কার। প্রাকৃতিক প্রজনন ও নির্বাচনের মাধ্যমে কৃষক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী হাজারো স্থানীয় ও বন্য জাতের ফসল উদ্ভাবন করেছেন যেগুলো বর্তমানে আবিষ্কৃত সকল উচ্চফলনশীল (উফশী), হাইব্রিড ও জিএম জাতের মূল ভিত্তি। এসব স্থানীয় ও বন্য জাতের ফসল সকল গবেষক ও বাণিজ্যিক উদ্ভিদ প্রজননবিদের জন্যই সহজলভ্য। কারণ, এসবের কোন প্যাটেন্ট নেই। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ট্রিপস’ চুক্তির প্যাটেন্ট আইনের আর্টিকেল ২৭.৩ (বি) ধারা এবং ‘উপোভ’-এ নতুন উদ্ভাবিত সকল জাতের উপর বাণিজ্যিক প্রজননবিদের একচ্ছত্র মালিকানা লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে। প্যাটেন্টকৃত এসব জাতের উপর কৃষক জনগোষ্ঠীর কোন অধিকারতো থাকছেইনা বরং জনকল্যাণে পরিচালিত সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের গবেষকদের জন্যও এসব জাত নিয়ে গবেষণার কোন শর্তহীন সুযোগ থাকছে না।
‘ট্রিপস’ এবং ‘উপোভ’ চুক্তি দুটি জাতিসংঘ গৃহীত কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি, ১৯৯২) এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রিটি অন প্লান্ট জেনেটিক রিসোর্সেস ফর ফুড এন্ড এগ্রিকালচার (আইটিপিজিআর, ২০০১)-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ সিবিডি ও আইটিপিজিআর চুক্তি দুটিতে উদ্ভিদের কৌলিক সম্পদের উপর কৃষক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যা ‘ট্রিপস’ এবং ‘উপোভ’ চুক্তি দুটিতে অস্বীকার করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় এই যে, সিবিডি ও আইটিপিজিআর চুক্তি দুটি কার্যকর করার ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নি যেমনটি হয়েছে ‘ট্রিপস’ চুক্তির বেলায়।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও কৌলিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য কোন আইনগত ব্যবস্থা নেই। এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের জন্য ১৯৯৮ সালে উদ্ভিদ কৌলিক সম্পদ বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করা হয় যে কমিটি চষধহঃ ঠধৎরবঃরবং অপঃ ড়ভ ইধহমষধফবংয (বাংলাদেশের উদ্ভিদ জাত সংরক্ষণ আইন)-এর একটি খসড়া তৎকালীন সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করে যা কার্যকর করার কোন উদ্যোগ অদ্যাবধি গ্রহণ করা হয় নি। প্রস্তাবিত এই আইন অনুসারে কোন হাইব্রিড বা জিএম শস্য ঢালাওভাবে এ দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। পক্ষান্তরে, দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে যাতে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তিতে বর্ণিত সুই জেনেরিস সিস্টেম হিসেবে উপভ গ্রহণ করে। হয়ত এরূপ চাপের কারণেই এ আইনটি অদ্যাবধি কার্যকর করা হচ্ছে না। যাহোক, প্রস্তাবিত প্ল্যান্ট ভ্যারাইটি অ্যাক্ট-এর আর্টিকেল-৭ -এ বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিশেষ ধারা সংক্ষেপিত আকারে নিম্নে উল্লেখ করা হল।
ধারা-২: এই আইনের জন্য উদ্ভিদের সকল জাত, যেগুলো বর্তমানে বিদ্যমান বা নতুন উদ্ভাবিত জাত হিসেবে দাবীকৃত, বাংলাদেশের জনগণের “পূর্ববর্তী জ্ঞান” হিসেবে বিবেচিত হবে। অতএব, এই জাতগুলোকে ব্যক্তিগত বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার, সংরক্ষণ বা বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। উদ্ভাবিত জাতটি যে নতুন এবং তার অস্তিত্ব পূর্বে কখনও ছিলনা এবং উদ্ভাবনের সামাজিক প্রক্রিয়ার উপর একটি স্বাধীন মানব সংস্থার প্রতি কমিউনিটির স্বীকৃতি রয়েছে এটা প্রমাণ করা উদ্ভাবনকারীর একক দায়িত্ব।
নোট: এই আইনে “সংরক্ষণ” বলতে সবসময় ‘জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষ’ কর্তৃক কোন উদ্ভাবনকারীর অনুক‚লে অনুমোদিত ও বরাদ্দকৃত, সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হউক বা না হউক, কোন সংজ্ঞায়িত এবং সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়িক সুবিধাদি বুঝাবে এবং তা কোন সাধারণকৃত বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার তৈরি করবে না, এবং আবিষ্কারের ধরণ অনুসারে বিভিন্ন আবেদনকারীর ক্ষেত্রে ভিন্নরকম হতে পারে।
ধারা-৩: কোন জাতের বাণিজ্যিক অধিকার লাভের জন্য কেবল প্রজনন বা কিছু উৎকর্ষসাধনমূলক প্রজননই যথেষ্ট হবেনা। এরূপ অধিকার লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে গেলে নতুন জাতটিকে বাংলাদেশের মানুষের সুনির্দিষ্ট ও প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতে সক্ষম হতে হবে। কোন জাত বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে, সরাসরি এবং যথেষ্ট পরিমানে লাভজনক বিবেচিত না হলে জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। হাইব্রিড জাতকে শুধুমাত্র তখনই সংরক্ষণ করা যাবে যদি তার মাতৃজাতগুলো কমিউনিটির জাত হিসেবে জনগণের কাছে সহজলভ্য হয়।
ধারা-৫: যদি কোন নতুন জাত পরিবেশ, জীবজগৎ, স্বাস্থ্য এবং জনমানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয় তবে তা এই আইন দ্বারা সংরক্ষণ করা যাবেনা।
ধারা-৬: যদি কোন নতুন জাতের জীববৈচিত্র্য এবং/অথবা বিদ্যমান জৈবিক ও কৌলিক সম্পদ এবং কৌলিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়সহ সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজাত ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও চর্চার উপর ঋণাতœক প্রভাব থাকে তবে তা এই আইনে সংরক্ষণ করা যাবেনা।
ধারা-৭: কোন ট্রান্সজেনিক (জিএম) জাত সংরক্ষণ করার যোগ্য হবে না যদি না সে জাতের –
ক. জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত সংশ্লিষ্ট কোন সংস্থা/বিভাগ কর্তৃক পরিবেশের উপর প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়;
খ. বাংলাদেশকে জৈব দুষণ থেকে মুক্ত রাখার জন্য ‘জৈব নিরাপত্তা কমিশন’ কর্তৃক জৈব-নিরাপত্তা মূল্যায়ন করা হয়;
গ. সেই ট্রান্সজেনিক (জিএম) জাত ব্যবহার বা নাড়াচাড়ার ফলে যদি কোন বিপদ বা ক্ষতি সাধিত হয় তবে সে জাতের মালিক তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি থাকে এবং জাত সংরক্ষণের দরখাস্তের সাথে এই মর্মে লিখিত অঙ্গীকার করে;
ঘ. জাত সংরক্ষণের জন্য আবেদনকারী এই মর্মে অঙ্গীকার করে যে, জাতের ট্রান্সজেনিক বৈশিষ্ট্য জনসমক্ষে ঘোষণা করা হবে এবং লেবেল, লোগো এবং সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য উপকরণে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকবে;
ঙ. জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হয় যে দুর্যোগের দায় বহন করার মত আবেদনকারীর যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ রয়েছে।
ধারা-১০: কোন জাতীয় সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমনঃ সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জাতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, স্বায়ত্বশাসিত বা আধা-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আবিষ্কৃত জাতগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তায় বা জনগণের অর্থায়নকৃত সম্পদ বা উন্নয়ন সহযোগিতা হিসেবে প্রাপ্ত টাকায় আবি®কৃত জাতও সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে।
ধারা-১১: কোন ব্যক্তি, এনজিও বা অন্য কোন সংস্থা যারা স্থানীয় বা বৈদেশিক উন্নয়ন তহবিল ব্যবহারে করে বা করেছে যে তহবিল নীতিগতভাবে জনকল্যাণে দান করা হয়েছে তাদের উদ্ভাবিত নতুন জাতও সাধারণ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এসব জাত সংরক্ষণযোগ্য হবে না বা কোন বাণিজ্যিক সুবিধা দাবী করা যাবে না।
ধারা-১২: উপরোক্ত জাতগুলো যেগুলো আইনগতভাবে জনগণের সাধারণ সম্পত্তি কেউ যাতে সেগুলোর বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার দাবী করতে না পারে জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রস্তাবিত এই আইনটি কার্যকর করা হলে তা দেশের কৌলিক সম্পদ এবং কৃষক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। কাজেই, দেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও কৌলিক সম্পদ সংরক্ষণে এই আইনটি কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরী।
বাংলাদেশের বীজ-সম্পদ এবং বীজবাণিজ্য
বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। হাজারো জাতের ফসল, পশুপাখি, গাছপালা অতুলনীয় সমৃদ্ধি দান করেছে এ দেশের জীববৈচিত্র্যকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের এই সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির পথে। আমাদের বীজ সম্পদের কোন সঠিক হিসাব আজ পর্যন্ত করা হয় নি। ১৯১৫ সালে ঢাকাস্থ তৎকালীন কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের এক হিসেব মতে বাংলাদেশে একসময় ১৫,০০০ জাতের ধানের চাষ হতো। এর প্রায় ৭০ বছর পর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রায় ৬০০০ জাতের ধান সংগ্রহ করে। সংগৃহীত এসব জাতের মধ্যে মাত্র ২০০০ টি জাত প্রজননবিদদের জন্য সহজলভ্য হয়। আশির দশকে পরিচালিত এক জরিপে ১২,৪৭৯ জাতের ধানের তালিকা করা হয় যার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। বর্তমানে দেশজুড়ে চাষ হচ্ছে গুটিকয় স্থানীয়, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান।
ষাটের দশকের শেষের দিকে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে এ দেশে প্রথম উচ্চফলনশীল জাতের ধান বীজ আমদানি করা হয়। এরপর সত্তরের দশকে ফিলিপাইনস্থ ইরি ও ইন্ডিয়া থেকে প্রচুর উচ্চফলনশীল জাতের ধান বীজ আমদানি করা হয়। অতঃপর ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট যা একটি হাইব্রিডসহ এ পর্যন্ত ধানের ৪৬ টি নতুন জাত আবিষ্কার করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২১ টি গমের জাত, ৪ টি ভূট্টার জাত, ৩২ টি গোল আলুর জাত, ২৪ টি ডাল জাতীয় ফসলের জাত, ২১ টি তৈলবীজ ফসলের জাত, ৪১ টি শাক-সব্জির জাত এবং ২৬ টি ফলের জাত আবিষ্কার করেছে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আবিষ্কৃত হওয়ায় এসব জাতের কোন প্যাটেন্ট নেওয়া হয় নি। ফলে, এগুলো কৃষকের কাছে সহজলভ্য এবং কৃষক নিজেরাই এসব জাত থেকে বীজ তৈরি করতে পারে (হাইব্রিড ছাড়া)।
কাজেই নতুন জাতের আবিষ্কার এবং তার বীজের নিয়ন্ত্রণ অন্ততঃ সরকারের হাতে থাকলেও কৃষকেরা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারে। কারণ, সে যে সরকারই হউক জনগণের কাছে তার কমবেশি দায়বদ্ধতা থাকে যা কোম্পানির মোটেও থাকে না। মুনাফা অর্জনই কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য সে যে করেই হউক। মুনাফার জন্য যদি কৃষককে জিম্মি করে ফেলতে হয়, কৃত্রিম সংকটের ফাঁদে ফেলতে হয়, কৃষকের স্বনির্ভর ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হয় কোম্পানি তা করতে কখনও পিছপা হবে না। কিন্তু সরকারের লক্ষ্য কখনই এমনটি হতে পারে না। তাই বীজ সম্পদের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ কৃষকের হাতে থাকা উচিত। কেবলমাত্র যেসব বীজ কৃষক নিজেরা উৎপাদন করতে পারবে না যেমন: হাইব্রিড ও ব্রিডার মানের বীজ সেগুলো বড়জোড় সরকারি মালিকানায় রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি যদি বিদেশি কোম্পানির কোন বীজ প্রবর্তন করতেই হয় তবে তা কঠোর নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় করা উচিত, ঢালাওভাবে কখনই নয়।
বাংলাদেশের বীজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং বিএডিসি
এ দেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণে একমাত্র বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী সংস্থা হল বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) যেটি প্রতিষ্ঠিত হয় সবুজ বিপ্লবের সূচনালগ্নে ষাটের দশকে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বিএডিসির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থার দিকে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন যাতে এ দেশে বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের প্রসারে এই সংস্থার ভূমিকা এবং তার পিছনের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শুরুতে এই সংস্থা শুধু বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিলনা। শুরুতে এই সংস্থার প্রধান কাজ ছিল সেই সময়ে আসা উচ্চফলনশীল জাতের চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, সেচ যন্ত্রসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া। সেসময় বিএডিসি এসব কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি কৃষকদেরকে দিত উচ্চহারে ভর্তুকি মূল্যে, এমনকি কখনও কখনও বিনামূল্যে। আর এই ভর্তুকির ভার বহন করা হত বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন বিদেশী দাতা সংস্থার ঋণের টাকায়। তবুও সে সময় এসব নতুন জাতের বীজ ও প্রযুক্তি কৃষকরা সহজে গ্রহণ করতে চায়নি কারণ তারা সম্ভবত তাদের হাজার বছরের স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়নি। এ কারণেই বিএডিসির মাধ্যমে এসব প্রযুক্তির বিস্তার হচ্ছিল অত্যন্ত ধীর গতিতে। ধীর গতিতে হলেও ইতোমধ্যে সুসংহত হওয়া বহুজাতিক কোম্পানির জন্য এ দেশের বাজারে প্রবেশের পথ সুগম করার ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট সহায়ক হয়। আর এ সুযোগেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো দাতা সংস্থাগুলো একদিকে যেমন ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে থাকে অন্যদিকে তেমনি ঋণের শর্ত হিসেবে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি চাপিয়ে দিয়ে এ দেশের সরকারগুলোকে বাধ্য করে বিএডিসি কর্তৃক সরবরাহকৃত কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তির বাণিজ্যকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে যাতে বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যের প্রসার সহজতর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সামরিক সরকার আশির দশকে এ দেশের কৃষি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঢালাও বেসরকারিকরণ ও উদারিকরণ নীতির বাস্তবায়ন ঘটায় যা বাংলাদেশের কৃষির ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তরের দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, শুধু বাংলাদেশে নয় তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানো এবং টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকসহ এসব দাতা সংস্থার নগ্ন পৃষ্ঠপোষকতার কথা সর্বজনবিদিত। যাহোক, ঐ সময় থেকেই বীজ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ বা বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা বিএডিসির কাছ থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। আর এই নিয়ন্ত্রণকে একচ্ছত্র করতে বর্তমানে এসব দাতা সংস্থা বিএডিসিকেই বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ দেশের বীজ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক এবং কৃষি যন্ত্রপাতি বাণিজ্যের প্রায় সবটুকুই নিয়ন্ত্রণ করছে বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের দেশীয় এজেন্টরা।
বীজ ফসল উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলোর একটি। ‘ভাল বীজে ভাল ফসল’ – এটি একটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। কৃষি গবেষকদের মতে বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ যেসব উচ্চ ফলনশীল জাত কৃষকের হাতে তুলে দিয়েছে সেগুলোর কৃষকের মাঠের ফলন গবেষণা খামারের ফলনের তুলনায় অনেক কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ কৃষকরা যে বীজ ব্যবহার করে তা মোটেও উৎকৃষ্ট মানের নয়। বিজ্ঞানীদের মতে শুধু উৎকৃষ্ট মানের বীজ ব্যবহার করা গেলে ধানের ফলন শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। আজ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাতœক সংকটাপন্ন। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে ফসলি জমি। এমতাবস্থায়, একক পরিমান জমিতে শস্যের ফলন বাড়ানো অপরিহার্য। অথচ আজ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে দেশের প্রধান ফসল ধানের বীজের চাহিদার শতকরা মাত্র ১০/১২ ভাগ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, মানসম্মত বীজ কৃষকের হাতে পৌছে দেওয়ার জন্য যেখানে বিএডিসিকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন ছিল সেখানে বিএডিসিকে বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে।
জাতীয় বীজ নীতি ও কৃষকের বীজের অধিকার
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ দেশের সমৃদ্ধ বীজ সম্পদ ও কৃষকের বীজের অধিকার সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত হতাশাজনক যা পূর্বেই আলোকপাত করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, আমাদের সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা বীজ সম্পদের উপর বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
সরকার ২০০৬ সালে একটি জাতীয় বীজ নীতি প্রণয়ন করেছে যার প্রধান লক্ষ্য হল বেসরকারি খাতে বীজ শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করা। এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৭৭ সালের সীড এ্যাক্ট সংশোধন করে সীড এ্যাক্ট ১৯৯৭ প্রবর্তন করা হয়েছে। জাতীয় বীজ নীতির প্রায় সকল ধারায় কোম্পানির বীজ বাণিজ্যকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। এই বীজ নীতিতে বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি বর্তমানে এ দেশের বীজের চাহিদার মাত্র ৫-৬% সরবরাহ করছে। অথচ বিএডিসির ক্ষমতাবৃদ্ধির কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এই বীজ নীতিতে নেই।
পক্ষান্তরে, এই বীজ নীতি বেসরকরি খাতে হাইব্রিড বীজ আমদানির শর্তসাপেক্ষ অনুমোদনকে আরও সুসংহত করবে। কারণ, এই বীজ নীতি অনুসারে বাংলাদেশের কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যদি কোন জাত আবিষ্কার করে এবং তা কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্য ছাড় করতে চায় তবে দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে পরীক্ষাসহ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু বেসরকারি খাতে বীজ আমদানি ও বাজারজাতকরণের জন্য এরূপ কোন পরীক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয় না। অথচ, দেশের ইকোসিস্টেম সুরক্ষার জন্য এই ধরণের পরীক্ষা জরুরী। অন্যথায় বাইরে থেকে আসা কোন জাত দেশের ফসল বৈচিত্র্যের জন্য বিপদজ্জনক হতে পারে। অন্যদিকে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশীয় বীজ সম্পদ সংরক্ষণের কোন কথাই এ বীজ নীতিতে বলা হয় নি যদিও সরকার তা করার জন্য জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ ও পরিবেশ উন্নয়ন সম্মেলনের এজেন্ডা-২১ অনুযায়ী অঙ্গীকারাবদ্ধ।
আমাদের এখনও যেসব নীতি আছে তাতে হাইব্রিড বা জিএম বীজ সহজে এ দেশে ঢুকতে পারেনা। কিন্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার চাপে আমাদের নীতিগুলো পরিবর্তন করা হচ্ছে। যারা আমাদের বাজার দখল করতে চায় তারাতো বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করবেই। হুমকি-ধামকি ও চাপ প্রয়োগ করবেই। কিন্তু একটি দেশপ্রেমিক, মেরুদন্ডসম্পন্ন সরকারের উচিত এসব হুমকি-ধামকি ও চাপ উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে, কৃষকের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন করা।
by শহীদুল ইসলাম | Mar 30, 2025 | প্রকৃতি কথা
Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights (TRIPS) অর্থাৎ বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট মেধাস্বত্ব (ট্রিপস) চুক্তিটিও কৃষিচুক্তির মতোই ১৯৯৪ সালে গ্যাটের উরুগুয়ে রাউণ্ডে গৃহীত হয় এবং ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে কার্যকর হয়। এ চুক্তির উদ্দেশ্য হল কোন নতুন আবিষ্কারের উপর আবিষ্কারক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব বা মালিকানা নিশ্চিত করা। এই মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য ট্রিপস চুক্তিতে যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা হল প্যাটেন্ট। প্যাটেন্ট বিষয়টা একটু ভালোভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন এবং এর সাথে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টাকে মিলিয়ে না দেখলে প্যাটেন্টকে মামুলি বিষয় বলে মনে হতে পারে।
সহজ কথায় প্যাটেন্ট হল একপ্রকার মালিকানার দলিল। অর্থাৎ কোনকিছু প্যাটেন্ট করা মানে তার স্বত্বাধিকারী হওয়া। এরূপ প্যাটেন্ট আইন কপিরাইট আইন নামে বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ধরা যাক, কোন লেখক একটি বই লিখলেন এবং কপিরাইট আইনে তার স্বত্বাধিকারী হলেন। এমতাবস্থায়, লেখকের অনুমতি ছাড়া কেউ সেই বই ছাপতে বা কপি করতে পারবেনা এবং করলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ট্রিপস চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে তা একটু ভিন্নরূপে উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপরও প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমাদের চারপাশের গাছপালা, ফসল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এসবের মালিক কে? আপনি, সে বা আমি অর্থাৎ যারা এসবের লালন-পালনকারী। কিন্তু ট্রিপস চুক্তি স্বাক্ষরের পর এগুলোর মালিকানা আর আমাদের থাকবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, সামান্য জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েই কোম্পানী যেকোন সময় এগুলোর মালিকানা নিয়ে নিতে পারে। ধরা যাক, আমাদের বাদশাভোগ ধানের সামান্য জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে কোন কোম্পানী একটি নতুন জাত তৈরি করলো এবং তা বাদশাভোগ নামে প্যাটেন্ট করলো। এরূপ প্যাটেন্ট করার ফলে বাংলাদেশ যদি বাদশাভোগ নামের কোন ধান উৎপাদন, ব্যবহার, বিক্রি ও আমদানি-রপ্তানি করতে চায় তবে সে কোম্পানীকে টাকা দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন জাতের মালিকানা কুক্ষিগত করে মুনাফা করার অদ্ভূত এক রক্ষাকবচ হলো এই প্যাটেন্ট আইন!
এ চুক্তিটি বিভিন্ন প্যাটেন্টধারী বা প্যাটেন্ট করতে চায় এমন সব বহুজাতিক কোম্পানির চাপে উরুগুয়ে রাউণ্ডে উত্থাপিত হয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের যুক্তি ছিল এরকম যে, যদি কোন নতুন আবিস্কারের একচ্ছত্র মালিকানা নিশ্চিত করা না হয় তবে নতুন আবিষ্কারে কেউ উৎসাহিত হবে না। কথাটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত মনে হলেও মানব ইতিহাস তা সত্য বলে মেনে নিবেনা। কারণ, আজ পর্যন্ত এ পৃথিবীতে যত নতুন আবিষ্কার হয়েছে তার জন্যে তো মালিকানা সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। তখন কি আবিষ্কার হয় নি? গ্রেগর জোহানেজ ম্যাণ্ডেল যখন তার বংশগতির সূত্রগুলো আবিষ্কার করেন তখনতো প্যাটেন্ট আইন ছিল না। তাই বলে কি অসামান্য পরিশ্রম করে মেণ্ডেল তার সূত্রগুলো আবিষ্কার করেন নি! অথচ সেসব সূত্র ব্যবহার করে আজ নতুন নতুন উফশী ও হাইব্রিড জাত আবিষ্কার করা হচ্ছে এবং প্যাটেন্ট করে নেয়া হচ্ছে। তখন যদি মেণ্ডেলের সূত্র প্যাটেন্ট করা হতো তা হলে উদ্ভিদ প্রজনন বিদ্যার এতটা বিকাশ কখনো ঘটতো না। কারণ, প্যাটেন্টকৃত কোন আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা করতে হলে প্যাটেন্টধারীর (ব্যক্তি বা কোম্পানি) কাছ থেকে অনুমতি ও স্বত্ব কিনে নিতে হবে। বাস্তব সত্য এই যে, অতীতে বিজ্ঞানীরা নিজস্ব জ্ঞান-পিপাসা থেকে এবং মানবকল্যাণে ব্রতী হয়েই নতুন কোন আবিষ্কারে আত্মনিয়োগ করতেন। অথচ আজ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন অর্থ উপার্জনের ব্রত নিয়ে কোম্পানির ভাড়াটিয়া হিসেবে এবং কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। মানবকল্যাণ এখানে নিতান্তই গৌণ বিষয়। আগেকার দিনের আবিষ্কার ও বর্তমানকালের আবিষ্কারের মধ্যে মূল পার্থক্যটা এখানেই। আজ এরূপ আবিষ্কারকেই বলা হচ্ছে বুদ্ধিজাত সম্পত্তি। এসব আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষেই বুদ্ধিজাত না কুবুদ্ধিজাত তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
ট্রিপস চুক্তিতে মৌলিক আবিষ্কারের কোন স্বীকৃতি নেই। যে কৃষক হাজারো জাতের ধানের মৌলিক আবিষ্কারক এবং হাজার বছর ধরে সেগুলো লালন করেছে তার কোন স্বীকৃতি এই ট্রিপস চুক্তিতে নেই। অথচ ভূইফোঁড় কোন কোম্পানি কৃষকের আবিষ্কৃত এসব জাতগুলোর সামান্য জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েই তার মালিক বনে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আবিষ্কারকে উৎসাহিতকরণ ফাঁকা বুলি। মুদ্দাকথা হল মুনাফা। একচেটিয়া মুনাফা লুটার অভিলাষ থেকেই তৈরি করা হয়েছে কুটকৌশলী এই প্যাটেন্ট আইন।
ট্রিপস চুক্তিটি বহু বিষয়ের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে তবে বর্তমান বিতর্ক হচ্ছে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর এর প্রয়োগ নিয়ে। এই চুক্তির ২৭.৩ (বি) ধারায় কোম্পানিগুলোকে নতুন জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং তার উৎপাদন প্রক্রিয়া প্যাটেন্ট করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ট্রিপস চুক্তির এ ধারাটির সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর সামান্য জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েই তাকে নতুন আবিষ্কার হিসেবে দাবি করছে এবং সেগুলোর মালিক বনে যাচ্ছে। এর চেয়ে হাস্যকর অথচ দুঃখজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে!
ট্রিপস চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে বুদ্ধিজাত সম্পত্তির সংরক্ষণ আইন ছিল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু ট্রিপস চুক্তিতে যেকোন আবিষ্কারের স্বত্বাধিকার বা মালিকানা প্রদানের জন্য প্রত্যেক দেশকে প্যাটেন্ট আইন প্রণয়ন করা অথবা আপনা আপনি বুদ্ধিজাত সম্পত্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত হয়ে যায় এমন কোন কার্যকর ব্যবস্থা (effective sui generis system) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চুক্তির ধারায় প্রথমে কার্যকর (effective) শব্দটি ছিল না; এটি অন্তর্ভুক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এজন্য যে, কোন দেশ তার ইচ্ছামতো ব্যবস্থা নিলেই হবে না, তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, শিল্পোন্নত দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানির কাছে কার্যকর বা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনী দেশ তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে যেন তারা কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে উপভ (UPOV) কনভেনশন গ্রহণ করে। UPOV-এর পূর্ণরূপ হল International Convention for Protection of New Varieties of Plant । ১৯৬১ সালে ধনী দেশগুলো প্যাটেন্ট আইনের বিকল্প হিসেবে UPOV চুক্তি স্বাক্ষর করে। যে বিজ্ঞানীরা নতুন জাত তৈরি করেন তাদেরকে উদ্ভিদ প্রজননবিদ (Plant Breeder) বলা হয়। উদ্ভাবিত জাতের উপর উদ্ভিদ প্রজননবিদদের মালিকানা স্বত্ত্ব (Plant Breeders’ Rights) প্রতিষ্ঠার জন্য এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য প্রায় সকল গবেষণাই কোম্পানির টাকায় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। এসব কোম্পানির নিজেদের বেতনভূক্ত বা চুক্তিবদ্ধ প্রজননবিদ রয়েছে। এমনকি কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন কোন জাত উদ্ভাবন করলে তাও তারা টাকা দিয়ে কিনে নেয় এবং এরূপ গবেষণার জন্য তারা অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। এভাবে নতুন আবিষ্কৃত প্রায় সকল জাতের মালিক বনে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। ফলে, আমাদের ধান, আমাদের নিম এবং এ দেশের হাজারো উদ্ভিদ ও প্রাণীর মালিকানা আর আমাদের থাকবে না, মালিক হবে বহুজাতিক কোম্পানি। কাজেই এই প্যাটেন্ট আইন মেনে নেওয়া বা উপভ কনভেনশন গ্রহণ করা আমাদের দেশের জন্য কোন মতেই সমীচীন হবে না।
বাংলাদেশের কৃষিতে ট্রিপস চুক্তির প্রভাব
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫% গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস হল কৃষি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষুদ্র কৃষকেরা সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমেই বিশ্বের ৬৬% মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির অধীনে উদ্ভিদ ও বীজের উপর বুদ্ধিজাত সম্পত্তির সংরক্ষণ নীতি (প্যাটেন্ট আইন) প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফলে, বিশ্বের কোটি কোটি ক্ষুদ্র কৃষকের জীবন-জীবিকা, খাদ্য স্বাধিকার ও খাদ্য নিরাপত্তা আজ হুমকির সন্মুখীন। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আজ এরূপ মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি।
বাংলাদেশের প্রায় ৮৮% কৃষকই ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন শ্রেণীভূক্ত। কৃষি উপকরণের ক্রমবর্ধমান উচ্চমূল্য এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণে সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পক্ষে কৃষিতে টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তদুপরি, মনুফালোভী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এমনসব প্রযুক্তি নিয়ে এ দেশের বাজারে ঢুকছে যার প্রবর্তন করা হলে এসব কৃষকের পক্ষে কৃষিতে টিকে থাকা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। নিম্নে এরূপ কিছু প্রযুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
প্যাকেজ টেকনোলজি (Package Technology)
বর্তমানে কোম্পানিগুলো ধান বা অন্যান্য ফসলের এমনসব জাত তৈরি করছে যার সাথে সে কোম্পানির তৈরি বিশেষ ধরণের রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, হরমোন, ভিটামিন ইত্যাদি ব্যবহার না করলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে না। আবার জাতের সাথে সাথে এসব প্রযুক্তিও কোম্পানির প্যাটেন্টকৃত। এভাবে কোম্পানিগুলো চুটিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করার নানা ফন্দি-ফিকির বের করছে। আর এরূপ ফন্দির সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হল কৃষকের হাতে যেসব জাত আছে সেগুলোকে সরিয়ে দেওয়া। এজন্য তারা এমনসব জাত তৈরি করছে যাতে কৃষকের নিজস্ব বীজ হাতছাড়া হয়ে যায় এবং কৃষক প্রতিবছর কোম্পানির বীজ কিনতে বাধ্য হয়। এরূপ টেকনোলজি যেগুলো একসাথে ব্যবহার না করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়না, সেগুলোকে প্যাকেজ টেকনোলজি বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, এগ্রো-ইভো নামক একটি বহুজাতিক কোম্পানি এমন একটি ধানের জাত তৈরি করেছে যাতে সে কোম্পানির লিভার্টি নামক আগাছানাশক ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোম্পানির আগাছানাশকে ভাল কাজ করবে না। মোনাসান্টো রাউণ্ড-আপ-রেডি নামের একটি ধানের জাত তৈরি করছে যাতে সে কোম্পানির তৈরি প্লাইসোফেট নামক আগাছানাশক ব্যবহার করতে হবে।
টার্মিনেটর টেকনোলজি (Terminator Technology)
মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ডেল্টা এন্ড পাইন ল্যাণ্ড ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের সহায়তায় এমন একটি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যা দিয়ে বীজকে বন্ধ্যা করে দেওয়া যায়। এই প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে টার্মিনেটর প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বীজ শুধু একবারই গজাবে, পরের বছর আর গজাবেনা। অর্থাৎ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা কোন জাতের বীজ যদি কোন কৃষক চাষ করে এবং সেই ফসল থেকে বীজ রেখে পরের বছর চাষ করতে চায় তবে সে বীজ গজাবেনা। প্রতিবছর কোম্পানির কাছ থেকে বীজ কিনেই চাষ করতে হবে। একাজে এক প্রকার জিন ব্যবহার করা হয় যা ধানসহ যেকোন ফসলে ব্যবহারের জন্য প্যাটেন্ট করা হয়েছে।
দুই ধরণের টার্মিনেটর প্রযুক্তি রয়েছে।
১. ভি-গার্ট: এই ধরণের টার্মিনেটর বীজ থেকে বীজ রাখলে সে বীজ গজাবেনা। এবং
২. টি-গার্ট: এই ধরণের টার্মিনেটর বীজ থেকে বীজ রাখলে বীজ গজাবে কিন্তু সেই কোম্পানির বিশেষ ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করলে সেই বীজ থেকে ভাল ফলন পাওয়া যাবেনা।
টার্মিনেটর প্রযুক্তি ব্যবহার করা এরূপ বীজকে আত্মঘাতি বীজও বলা হয়ে থাকে। প্রধানত নিম্নরূপ কয়েকটি কারণে এই প্রযুক্তির বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
প্রথমত: বর্তমান বিশ্বের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহের অধিকাংশ কৃষকই নিজের উৎপাদিত বীজ দিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। তাদের পক্ষে প্রতিবছর বীজ কিনে চাষ করা সম্ভব হয়না। কাজেই এই ধরণের বীজ এসব দরিদ্র কৃষকের জন্য মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয়ত: বীজের জন্য কৃষক কোম্পানির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ফলে, একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। যে কারণে সারা বিশ্বের সচেতন মহল আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, এই ধরণের বীজ বাজারজাত করা হলে সারা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের আশংকা অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
তৃতীয়ত: এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা কোন ফসল যদি কোন মাঠে চাষ করা হয় তবে সেই মাঠের অন্যান্য ফসলেও কৌলিক দুষণ ঘটবে। ফলে, সেই মাঠের অন্যান্য ফসলের বা জাতের বীজও বন্ধ্যা হয়ে যাবে। ফলে, কৃষকের হাতে আর কোন বীজই থাকবে না।
চতুর্থত: এই প্রযুক্তি ফসলবৈচিত্র্য তথা জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডেল্টা এন্ড পাইন ল্যান্ড কোম্পানিটি যখন ১৯৯৯ সালে এই বীজ বাজারজাত করার উদ্যোগ নেয় তখন বিশ্বের শীর্ষ মার্কিন বীজ কোম্পানি মোনসান্টোও ১৯৯৯ সালে এই বীজের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে এই মোনসান্টো কোম্পানিই ডেল্টা এন্ড পাইন ল্যাণ্ড কোম্পানিটি কিনে নেয় এবং এই প্রযুক্তি বাজারজাত করতে উঠেপড়ে লাগে। যাহোক, আশার কথা হচ্ছে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে জাতিসংঘের কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি) ২০০০ সালে এই প্রযুক্তির মাঠ পরীক্ষা ও বাণিজ্যিক বিক্রয় নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে এবং ২০০৬ সালে মোনসান্টোর বাজারজাতকরণ তৎপরতার প্রেক্ষিতে তা পূনর্ব্যক্ত করেছে। ব্রাজিল ও ইন্ডিয়া ইতোমধ্যে জাতীয়ভাবে এই প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ সিবিডিতে স্বাক্ষর করলেও এই প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি।
বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক গরিব দেশের জীববৈচিত্র্য চুরি
এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো জীববৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এসব দেশে রয়েছে হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীব যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে নেই। নতুন জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরি করতে গেলে বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবের সংগ্রহ অত্যন্ত জরুরী। তাই ধনীদেশ বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণী চুরি করে নিয়ে গিয়ে তাদের জীনব্যাংকের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করছে এবং তা থেকে নতুন নতুন জাত তৈরি করে তার মালিকানা নিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় দেখা যাবে যে, এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যত উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে তার মালিক বনে গেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশের মাঠে মাঠে একসময় শুধু চাষই হত প্রায় ১২,৫০০ জাতের ধান। চাষ হতোনা এমন অগণিত জাতের বন্য ধান ছিল। ধানের এসব জাত কোন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নয় বা কোন গবেষণাগার থেকেও আসেনি। হাজার বছর ধরে কৃষকরাই সেসব জাত আবিষ্কার ও লালন করেছে। আজ হাইব্রিড বা জিএম-এর মতো যেসব নতুন জাত তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো তৈরি করা হয় কৃষকের আবিষ্কৃত জাত থেকেই। তাই আমরা হেলায় হারিয়ে ফেললেও গবেষকদের কাছে বা কোম্পানির কাছে এসব দেশী জাতের ধানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এমন অনেক জাতের ধান বর্তমানে কৃষকের মাঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জিন ব্যাংকে সেগুলোর অনেকই সংরক্ষণ করা আছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জিনব্যাংক সংরক্ষিত আছে মাত্র প্রায় ৩০০০ প্রজাতির ধান। পক্ষান্তরে, শুধু আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (সংক্ষেপে ইরি) এর জিন ব্যাংকেও সংরক্ষিত আছে হাজার হাজার জাতের ধান।
ট্রিপস চুক্তিতে কৃষকের এসব আবিষ্কারের কোন স্বীকৃতি নেই, নেই প্যাটেন্ট করার অধিকার। অন্যদিকে, সবুজ বিপ্লব কেড়ে নিচ্ছে কৃষকের নিজস্ব এসব আবিষ্কার। এসব আদি জাত থেকেই শংকরায়ন করে বা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল (উফশী), হাইব্রিড বা জিএম জাতের ধান। আর এগুলো প্যাটেন্ট করে নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করে একদিকে যেমন মুনাফা লুটছে এবং অন্যদিকে জিম্মি করে ফেলছে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের কৃষক ও গোটা কৃষি ব্যবস্থাকে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে হাজার বছর ধরে লালিত প্রাণসম্পদ (উদ্ভিদ ও প্রাণী) চুরি বা একার্থে ডাকাতি করে নিয়ে গিয়ে প্যাটেন্ট করে নিচ্ছে। নিন্মে এরকম দুটি উদাহরণ তুলে ধরা হল।
উদাহরণ-১: বাসমতি ধানের প্যাটেন্ট
বাসমতি অত্যন্ত উচ্চ মানের একটি সুগন্ধি জাতের ধান। ভারত ও পাকিস্তানের কৃষকরা বহু শতাব্দী ধরে এই ধান চাষ করে আসছে। ১৯৯৭ সালে ভারত এককভাবে বিশ্বের চার ভাগের তিনভাগ বাসমতি চাল রপ্তানি করেছে এবং ১৯৯৮ সালে ভারত শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লাখ টন বাসমতি চাল রপ্তানি করেছে। বাসমতি চালের এরূপ বাজার চাহিদা দেখে এই ধানের একচ্ছত্র মালিকানা গ্রাস করার মতলব আটে রাইসটেক নামের একটি মার্কিন কোম্পানি। এই কোম্পানি বাসমতি ধানের সাথে একটি মার্কিন জাতের শংকরায়নের মাধ্যমে নতুন ধরনের একটি জাত আবিষ্কার করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোম্পানিটি তাদের আবিষ্কৃত জাতটির নতুন কোন নাম না দিয়ে তা বাসমতি নামেই ১৯৯৭ সালে ইউএস প্যাটেন্ট এন্ড ট্রেডমার্ক অফিস থেকে অজ্ঞাতসারে এর প্যাটেন্ট লাভ করে। এই প্যাটেন্ট লাভের ফলে তাদের আবিষ্কৃত জাতসহ বাসমতি নামের সকল জাতের মালিক বনে যায় ঐ কোম্পানি। কারণ, ট্রিপস চুক্তির প্যাটেন্ট আইন অনুসারে রাইসটেককে রয়্যালটি না দিয়ে কেউ বাসমতি নামের কোন ধান বা চাল উৎপাদন, ব্যবহার, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি করতে পারবে না। যাহোক, ভারত সরকার বাসমতির প্যাটেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে ইউএস প্যাটেন্ট এন্ড ট্রেডমার্ক অফিসে মামলা দায়ের করে। সর্বশেষ খবর হল রাইসটেক বাসমতি নামে তার আবিষ্কৃত জাতের প্যাটেন্ট পায় নি, পেয়েছে ভিন্ন নামে।
উদাহরণ-২: নিমের প্যাটেন্ট
নিম ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অতি মূল্যবান ভেষজ উদ্ভিদ। নিমকে জাতিসংঘ একুশ শতকের উদ্ভিদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিমের জৈব ও ভেষজ গুণ সর্বজনবিদিত। হাজার বছর ধরে এ উপমহাদেশের মানুষ বিভিন্ন রোগের ঔষধ, পোকামাকড় দমন ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে নিম ব্যবহার করে আসছে। নিমের এরূপ গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এটাকে কুক্ষিগত করার মতলব আটে ‘ডবিøও আর গ্রেস’ নামের একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি। রবার্ট লারসন নামক এক মার্কিন বিজ্ঞানী নিমের বীজ থেকে ছত্রাকনাশক তৈরি করে বললেন যে, এটা তার নতুন আবিষ্কার। এরপর লারসন তার এই আবিষ্কার দেড় লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বেচে দিলেন ‘ডব্লিও আর গ্রেস’ নামের একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির কাছে। ‘ডব্লিও আর গ্রেস’ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ ১৯৯৫ সালে জার্মানির মিউনিখে অবস্থিত ইউরোপিয়ান প্যাটেন্ট অফিস থেকে অজ্ঞাতসারে নিমের প্যাটেন্ট লাভ করে। এই প্যাটেন্ট লাভের ফলে উক্ত কোম্পানি নিম নিয়ে সারা বিশ্বে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার পায়। ফলে, যে নিম আমাদের নিজস্ব সম্পদ এবং যে নিম হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষকরা ছত্রাকনাশক ও বালাইনাশক হিসেবে ব্যবহার করে আসছে সে নিমের মালিক বনে যায় উক্ত কোম্পানি। অর্থাৎ কোম্পানিকে রয়্যালটি না দিয়ে কোন কৃষক বালাইনাশক হিসেবে আর এই নিম ব্যবহার করতে পারবেনা। প্যাটেন্ট আইন অনুসারে যদি কোন কৃষক কোম্পানিকে রয়্যালটি না দিয়ে তার বাড়ির গাছের নিমের বীজ নিজের জমিতে বালাইনাশক হিসেবে ব্যবহার করে তবে তা হবে প্যাটেন্ট আইনের লঙ্ঘন। এজন্য উক্ত কোম্পানি সেই কৃষকের বিরূদ্ধে মামলা করতে পারবে যে মামলায় সে কৃষকের জেল জরিমানা হবে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! এই প্যাটেন্টের বিরুদ্ধে তখন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের গ্রীন পার্টি, ভারতের পরিবেশবাদী বিজ্ঞানী বন্দনা শিবা ও ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্ট (আইফোম) মিলে ইউরোপিয়ান প্যাটেন্ট অফিসে মামলা দায়ের করে এবং তারা তথ্য ও দলিলপত্র উপস্থাপন করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় যে বালাইনাশক হিসেবে নিমের ব্যবহার নতুন কোন আবিষ্কার নয়। যার প্রেক্ষিতে ২০০০ সালে এই প্যাটেন্ট বাতিল করা হয়। এরপর উক্ত কোম্পানি এই রায়ের বিরূদ্ধে আপিল করে যা ইউরোপিয়ান প্যাটেন্ট অফিস ২০০৫ সালে খারিজ করে দেয়।
যাহোক, উপরের দুটি উদাহরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, এভাবে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি সারা বিশ্ব, বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে কৌলিক সম্পদ (জেনেটিক রিসোর্স) চুরি করে প্যাটেন্ট করে নিচ্ছে। বিশ্বে ধানের উপর এ পর্যন্ত দুই শতাধিক প্যাটেন্ট দেওয়া হয়েছে যার অধিকাংশই নিয়েছে মার্কিন ও জাপানি কোম্পানি।
উন্নয়নশীল দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ট্রিপস চুক্তির প্রভাব
শংকরায়নের মাধ্যমে ধানের নতুন নতুন জাতের আবিষ্কার শুরু হয় মাত্র ষাটের দশক থেকে। তা হলে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এর আগে হাজার হাজার বছর ধরে যেসব ধান চাষ হয়ে আসছে তার আবিষ্কারক কে? উত্তরও সবার জানা। বংশ পরম্পরায় নিজস্ব জ্ঞান থেকে কৃষকেরাই আবিষ্কার করেছে এসব জাত। কিন্তু প্যাটেন্ট আইনের আওতায় এসব জাতের প্যাটেন্ট হতে পারে না। কারণ, এগুলোকে আবিষ্কার হিসেবেই গণ্য করা হয় না। ট্রিপস চুক্তি বিজ্ঞান ও উন্নয়নের এমন এক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারকে বিজ্ঞানভিত্তিক বা মৌলিক আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, বরং স্বীকৃতি দেয় বাণিজ্যিক সম্ভবনাময় আবিষ্কারকে।
যে জাত জৈবিক পদ্ধতি (বায়োলজিক্যাল প্রসেস) ব্যবহার করে তৈরি করা হয় কেবল তাকেই ট্রিপস চুক্তিতে আবিষ্কার হিসেবে ধরা হয়। যদিও এগুলো শত শত বছর ধরে প্রাকৃতিক শংকরায়নের ফলে সৃষ্ট এবং কৃষকের দ্বারা আবিষ্কৃত জাত ব্যবহার করেই তৈরি করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ট্রিপস চুক্তি নিজস্ব ফসলের উপর কৃষকগোষ্ঠীর সার্বভৌম অধিকারের স্বীকৃতি দেয় না। অথচ ব্যক্তি বিশেষ বা কোম্পানি তাদের উদ্ভাবিত নতুন জাতের ফসলের উপর প্যাটেন্ট পেয়ে যায়।
তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোর স্থানীয় জাত ব্যবহার করে উদ্ভাবিত নতুন জাতের উপর কোম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট পাওয়ার অর্থ হল জৈবস্বত্ব অপহরণ। তৃতীয় বিশ্বের (উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের) স্থানীয় প্রজাতির নমুনা বিনা অনুমতিতে নিয়ে গিয়ে তা থেকে নতুন জাত তৈরি করা হয়। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কৃষকরা যদি এই নতুন ফসল ফলাতে চায় তা হলে আবিষ্কারক কোম্পানির কাছ থেকে তা কিনে নিতে হবে।
আজকাল ক্ষুধা ও দারিদ্র বিমোচনের নামে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের কৃষকের উপর উচ্চ ফলনশীল, হাইব্রিড ও জিএম শস্য কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য হল ধনী দেশগুলোর প্যাটেন্টকৃত বীজ ও রাসায়নিক সামগ্রির উপর তৃতীয় বিশ্বের কৃষকদেরকে আরও বেশি নির্ভরশীল করে তোলা। প্যাটেন্টকৃত হওয়ার কারণে এসব প্রযুক্তির মূল্যের ক্ষেত্রে কোন প্রতিযোগিতার সুযোগ থাকেনা বলে এগুলো এমনিতেই উচ্চ মূল্যের হয়ে থাকে। তদুপরি, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ি কর্তৃক কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা সর্বদাই থেকে যায়। অর্থাৎ প্যাটেন্টধারী কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া ব্যবসার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রিপস চুক্তিটি।