বাঙালির ফুটবল জ্বর

বাঙালির ফুটবল জ্বর

বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশ। আক্রান্ত গোটা বিশ্বও।  বিশ্বজুড়ে ফুটবলই একমাত্র খেলা যা সম্ভবত সকল দেশের মানুষকেই কমবেশি মাতিয়ে তুলে। বিশ্বকাপ ফুটবলকে তাই গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বলা হয়ে থাকে। ফুটবলের বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের কোন স্থান নেই, নেই এশিয়াতেও। সম্প্রতি দেশের অদম্য নারীরা সাফ ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়লেও পুরুষ দলের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসনটাও নড়বড়ে। তবুও ফুটবল নিয়ে আমাদের উৎসাহের কমতি নেই। কমতি নেই উত্তেজনা আর উন্মাদনারও যা কখনো কখনো মারামারি খুনোখুনি  পর্যন্ত গড়াতে দেখা যায়। উত্তেজনার চাপে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুবরনের কথাও শোনা যায় কখনো কখনো। মিডিয়ার খবর অনুসারে এবারের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে নানাভাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১২ জন, আহত হয়েছেন ২৭ জন। এটা সেমিফাইনাল পর্যন্ত খবর। আজ ফাইনালে দুই চিরপ্রদ্বিন্দ্বী একটি বিজয়ী হওয়ার পর এই সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না যা কোনক্রমেই কাম্য নয়! যাহোক, আর্জেন্টিনার ৩৬ বছর আর মেসির ২০ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাপ জয়ে দল আর্জেন্টিনা ও মেসিকে অভিনন্দন!

খেলা মানেই বিনোদন। সুস্থ জীবনের জন্য বিনোদন যেমন জরুরী তেমনি জরুরি খেলাধূলা বা শরীরচর্চা। আমরা যেমন খেলা দেখে মজা পাই, বিনোদিত হই তেমনি যারা মাঠে খেলে তারাও অপার আনন্দ লাভ করে যেমন আনন্দ লাভ করতাম আমরাও আমাদের শৈশবে। আমাদের শৈশবে গ্রামাঞ্চলে চামড়ার বল সহজলভ্য ছিলোনা। চামড়ার বল কিনতে  হলে দূর থানা বা জেলাসদরে যেতে হত যা ছোটদের জন্য সহজ ছিলোনা। কারণ, তখন যোগাযোগ সহজ ছিলোনা। পাঁচ-দশ কিলোমিটার হেটে বা সাইকেলে পাড়ি দিতে হত। তাই সেকালে আমাদের খেলা হত হাতে তৈরি বলে। শিমুল তুলা পলিথিনে মুড়িয়ে  তা পাটের রশি দিয়ে জালের মত করে বেঁধে আমরা সুন্দর আরামদায়ক বল বানিয়ে ফেলতাম। সে বল খেলতে মন্দ লাগতোনা। কাপড়ে মোড়ানো এমন বলেই নাকি মেরাডোনার পায়েখড়ি হয়েছিলো। আমদের খেলার মাঠ ছিলো মূলত ধান মাড়ানোর খোলা কিংবা ফসলের মাঠ। ধান কেটে নেওয়ার পর ধানক্ষেতে খালি পায়ে আমাদের খেলা চলত। বুট জুতা পড়ে খেলা হয়নি কখনো। আমাদের ছেলে এমদাদ হকের মত ব্যাথাপায়ে তখনকার ব্যাথানাশক মালিশ জামবাক মেখে হারিকেনের মাথায় কাপড় গরম করে ছ্যাক নেওয়া ছিল তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একটি গোল করার জন্য সেকি কসরত! খেলার মাঠের ব্যর্থতার আক্ষেপ প্রায়শই সফলতা রূপে স্বপ্নে এসে ধরা দিত। স্বপ্নে পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদোর মত সবাইকে কাটিয়ে গোল করার আনন্দ ছিলো অসাধারণ। কখনো কখনো গোলমুখে গিয়ে ঘুম ভেঙ্গে নিশ্চিত গোল মিস করা আক্ষেপটাও  নিতান্ত কম ছিলোনা।

তখন অবশ্য পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো কিংবা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার নামও আমাদের জানা ছিলোনা। পেলে ও ব্রাজিল  সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি “ফুটবলের রাজা” প্রবন্ধ থেকে ক্লাশ ফোর কি ফাইভের পাঠ্য বই থেকে। সেসময় ‍আমাদের জন্য বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার কোন সুযোগ ছিলোনা। ছিয়াশির বিশ্বকাপে যখন ম্যারাডোনা বিশ্ব মাতিয়েছিলেন তখনো হাতেগোনা কিছু টেলিভিশন এসেছিলো গ্রামের বাজার অবধি যেখানে সবে বিদ্যুৎ এসেছিল বলে। রাত জেগে সেই বিশ্বকাপ যারা দেখতেন তাদের মুখ থেকে শুনতাম ম্যারাডোনার গুনকীর্তন। সম্ভবত তখন থেকেই এদেশে আর্জেন্টিনার এতো সাপোর্টার সৃষ্টি হয়। ব্রাজিলের সমর্থক আগে থেকেই ছিলো আমার ধারণায় মূলত শহুরে ফুটবল বোদ্ধাদের মধ্যে। ব্রাজিলের সমর্থক বৃদ্ধিও ছিল প্রায় সমসাময়িককালে। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ১৯৯০ পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সাল অবধি ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ ফুটবল খেললেও নানান সমালোচনা, কেলেষ্কারির সাথে সাথে খেলার মানেও পড়ন্তবেলা নেমে এসেছিলো। ঠিক একই সময়ে রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, রোনালদিনহু, কাকাদের মত তারকা ফুটবলারদের কয়েক বিশ্বকাপজুড়ে সফলতা-ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে ২০০২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের ফলে সমর্থকগোষ্ঠী আরও বৃদ্ধি পায়। এসময় জার্মানী এবং ফান্সের সাফল্য ও শক্তিমত্তার কারণে এই দুই দলের বেশ একটা সমর্থকগোষ্ঠীও তৈরি হয় বিশেষ করে জার্মানির।

আমার বিশ্বকাপ খেলা দেখা শুরু মূলত নব্বইয়ের বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিল সমর্থক হিসেবে। এবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ব্রাজিলের বিদায় হওয়ার পর থেকে ফাইনাল অবধি সমর্থনের সেই আবেগ বা উচ্ছাস । তবুও খেলার মজার জন্য প্রতি ম্যাচে কোন না কোন দলের পক্ষে মৃদু হলেও সমর্থন ছিলই। আগে যখন বিশ্ব রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে অতটা ধারণা ছিলনা তখন সমর্থনের মূল মাপকাঠি ছিল ভালো দল, ভালো খেলা যেমনটা এখন আমার ছেলে করে। প্রায়শই ছেলের সমর্থন আমার বিপরীতে যায়। তাই আমি আমার মৌন সমর্থন প্রকাশ করতে চাইনা। ওর চাপাচাপিতে যখন তা প্রকাশ করতে হয় তখন সে একটু দমে যায়, উৎসাহে ভাটা পড়ে। যদিও আমি সমর্থন পরিবর্তন না করতেই তাকে উৎসাহিত করি। কারণ, তার জন্য জেতাটাই আনন্দের বিষয়। অবশ্য খেলার ক্ষেত্রে এমনটাই হওয়া উচিত – শ্রেফ বিনোদনের উপলক্ষ।

কিন্তু আমাদের দেশে ফুটবল মানে শ্রেফ বিনোদনের চেয়েও বেশি কিছু। কার্যত আমরা এক ফুটবলপ্রেমি জাতি। শুধু প্রেমিক বললে ভুল হবে। বরং পাগল প্রেমিক বলাই শ্রেয়। এমন একটা জাতি ফুটবলে কেন এতটা পশ্চাদপদ সেটাই বিপুল বিষ্ময়। ছোটবেলায় আমাদের ফুটবল উন্মাদনা ছিল আবাহনী-মোহামেডানকে ঘিরে। বর্তমান প্রজন্ম সম্ভবত এখন দেশের ক্লাবগুলোর খেলাই দেখেনা। মাঠের অভাবে খেলারও সুযোগ পায়না। আমরা জনক-জননীরাও ওদের পড়াশোনার প্রতি যতটা যত্নবান খেলাধূলার প্রতি ততটাই উদাসীন। অথচ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা ভিনদেশি কোন দলকে পাগলের মত করে সাপোর্ট করা থেকে বুঝা যায় যে আমরা কতটা উন্মত্তভাবে ফুটবলপ্রেমি। এই প্রেমটাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব আসরে না হউক, এশিয়ায় কিংবা অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা আমাদের অবস্থানটা সংহত করতেই পারি।

নারী ফুটবলাররা এক্ষেত্রে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ওদের অগ্রগামী হওয়ার গল্পটা পেলে-মেরাডোনা-মেসি-নেইমার-এন্টোনিদের গল্পের মতই। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বস্তি থেকে অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশ্ব আসরে জায়গা করে নেওয়া এসব তারকারা এদেশের রাস্তায়-বস্তিতে বেড়ে উঠা অসংখ্য শিশুদের আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। বাফুফে এদেরকে নিয়ে কাজ করলে অনেক বেশি সাফল্য আসতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

#fifa_world_cup_Qatar_2022 #Messi #Neymer #Maradona

পারিবারিক কৃষি এবং পটেটো হলিডের গল্প

পারিবারিক কৃষি এবং পটেটো হলিডের গল্প

সাতসকালে বাচ্চা বয়সী ছেলেমেয়েসহ এক কর্ষণজীবী নেমেছেন জমি কর্ষণে। ভূট্টার বীজ ফেলে তিন বছর বয়সী ছেলেকে মইয়ে বসিয়ে জমি সমান করছিলেন তিনি। চলতিপথে তাঁদের দেখে শৈশব স্মৃতি জাগরিত হলো। বাইক থামিয়ে ছবি তুললাম। কাজ থামিয়ে উনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে এই কৃষকের জীবনের গল্পটা ইচ্ছে থাকলেও শোনা হয়নি। চলতি পথে আমারও সময়ের অভাব ছিল। অবশ্য সেটা যে খুব দরকারি ছিল তাও নয়। কারণ, কৃষক পরিবারের গল্পগুলো প্রায় এক এবং অভিন্ন। কৃষক পরিবারের সন্তান, কৃষিবিজ্ঞানের ছাত্র এবং প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে কৃষকদের সাথে কাজ করার সুবাধে এমন শতশত গল্প জানা। ছেলেটার স্কুলে যাবার বয়স হয়নি এখনও তাই জিজ্ঞেসও করা হয়নি। মেয়েটার বয়স দশ কী এগার হবে। তাই শুধু জানতে চাইলাম মেয়েটা স্কুলে যায় কিনা। উত্তরে হ্যা সূচক জবাব দিলেও অনুমান করতে কষ্ট হয়না যে পড়াশুনা খুব বেশিদূর এগুবেনা। এক কমিউনিটি ‍মিটিং-এ নারী শিক্ষার ব্যাপারে জানতে চাইলে অনেকে হতাশাভরে বলেছিলেন, “লেখাপড়া শিখিয়ে কি লাভ হবে, গরীবের চাকরি হয়না কারণ ঘুষ দিতে পারেনা”। বলাবাহুল্য, বাল্যবিবাহ রোধে গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় অনেক সাফল্য এলেও এই প্রকট সমস্যাটা সমাজ থেকে দূরীভূত হওয়া দূরে থাকুক করোনার কারণে আরও পশ্চাতপদ হয়েছে।

আমার সঙ্গী ছিলেন ড. ভল্কার কাশ নামের একজন জার্মান ভদ্রলোক। বয়স বাহাত্তর। উনার জন্ম জার্মানির এক কৃষক পরিবারে। অটো থামিয়ে আমাকে নামতে দেখে উনিও নেমে এলেন। আগ্রহভরে দেখলেন এবং উনার বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। উনার শৈশবের স্মৃতি প্রায় সত্তর বছরের পুরনো যখন সবুজ বিপ্লবের সূচনাকাল চলছে। উনার কথা থেকে জানা গেলো যে সেসময় জার্মানির পারিবারিক কৃষিও প্রায় আমাদের এখনকার কৃষির মতই ছিল। সেসময় পারিবারিক কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ছোয়া সবে লাগতে শুরু করেছে। উনিও কিভাবে শৈশবে পারিবারিক কৃষির সাথে যুক্ত ছিলেন সেসব স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন। আমিও চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর আগেকার শৈশবে ফিরে গেলাম যখন ধান, পাট, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, পাকা মরিচ, সরিষা, শাকসব্জীসহ নানান ফসল মাড়াই করার কাজে আমিও মনের আনন্দেই যুক্ত হতাম। মইয়ে চড়া, ধান মলন দেওয়া – এগুলো ছিল খুব মজার কাজ। শখ করে কয়েকবার গরুর লাঙ্গল চালানোর দীক্ষাও নিতে চেয়েছি। কিন্তু এর জন্য একটু বেশিই কসরত প্রয়োজন ছিলো বিধায় বেশিদূর এগুনো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্র‍্যাক্টিক্যাল ক্লাশে অবশ্য ট্রাক্টর চালানো শিখতে হয়েছিলো। আমাদের পারিবারিক কৃষিটা এমনই ছিল যা এখনো অনেকটাই বিরাজমান। কিন্তু ড. কাশের ছোটবেলার পারিবারিক কৃষি আর এখনকার পারিবারিক কৃষির মধ্যে বিস্তর ফারাক।

উল্লেখ্য যে, এই মূহুর্তে বিশ্বে জাতিসংঘ ঘোষিত পারিবারিক-কৃষি-দশক চলছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৯-২০২৮ সাল পর্যন্ত পারিবারিক কৃষি দশক ঘোষনা করেছে যার লক্ষ্য হল একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে পারিবারিক কৃষক হওয়ার অর্থ কী তা নিয়ে নতুন করে আলোকপাত করা এবং ক্ষুধা নির্মূলে এবং ভবিষ্যত খাদ্য ব্যবস্থার রূপায়নে পারিবারিক কৃষি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আগের চেয়ে বেশি করে তুলে ধরা। এফএওর মতে পারিবারিক কৃষি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জীবিকার উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় টেকসই উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। পারিবারিক কৃষকগণ তাঁদের প্রজ্ঞা এবং পৃথিবীর মাটি ও প্রকৃতির প্রতি আন্তরিক যত্নশীলতার মাধ্যমে আমাদের কৃষির ইতিবাচক রূপান্তরের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন যা আমাদের ক্ষুধামুক্তি, আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিস্থাপক পৃথিবী বিনির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

যাহোক, এই দৃশ্য দেখার পর ড. ভল্কার কাশের কাছে প্রশ্ন রাখলাম যে তিনি এটাকে শিশুশ্রম হিসেবে দেখেন কিনা। উত্তরে তিনি একটা মজার বিশ্লেষণ দিলেন যা আমার খুবই পছন্দ হলো। তিনি বললেন, “দেখো এটা এক অর্থে শিশু শ্রম বটে তবে এটাকে তুমি একজন পিতার শিশু দেখাশুনার কাজ হিসেবেও দেখতে পার। তুমি ভেবে দেখ যে, এসময় এই শিশুটির দেখাশুনার জন্য একজন লোক লাগত। হয়ত ওর মাকেই তা করতে হত। কিন্তু এখানে মইয়ের উপর বসে থেকে সে বেশ মজাই পাচ্ছে। আর এই মজার মাধ্যমে প্রকারান্তরে সে তার পিতার কাজে সাহায্যও করছে যা এক ধরণের উইন-উইন সিচুয়েশন”।

বিশ্লেষণটা চমৎকার লাগলো। ঠিকইতো। প্রথমে এটাকে আমার কাছে অমানবিক শিশুশ্রম বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ভল্কারের কথায় চিন্তার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। মন পড়ে ছোটবেলায় আমরা কৃষক পরিবারে যে কাজগুলো করতাম সেগুলো বেশ মজা করেই করতাম। করতে না বললেও স্বেচ্ছায় করতাম। একদিকে একঘেয়ে মুখস্ত বিদ্যা গলাধকরণের মত অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক কাজ (যা এখন আমাদের শিশুদের একমাত্র করণীয়) থেকে মুক্তি আর অন্যদিকে, মাটি আর প্রকৃতির সাথে ফসলের মাঠে কাজ করার আনন্দ – মূলত এই দুই কারণে অনেকসময় অনাহুত হয়েও শ্রেফ মনের আনন্দে কাজে যোগ দিতাম। এখন আমরা জানি প্রতিদিন শারিরীক শ্রম সুস্বাস্থ্যের জন্য কতটা জরুরী। ইদানিং বয়ষ্ক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ কিংবা ডায়াবেটিস রোগীরা যেমন নিষ্ফল হন্টন কিংবা শারিরীক পরিশ্রমের কসরত করেন তা না করে বাল্যকাল থেকে উৎপাদনশীল শারীরিক শ্রমের অভ্যাস করাগেলে গেলে দেহ ও মন উভয়ের ক্ষুধাই মেটানো অনেকাংশেই সম্ভব।

ঠিক এই কাজটাই মাটি এনজিওর ইকো-স্কুলে শিশুদের শেখানোর এবং চর্চায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রেও শিশু-কিশোর-যুবকদের নিয়ে আদর্শ গ্রাম বিনির্মানে ঠিক এই চিন্তাটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। স্কুল পর্যায়ে পুষ্টি বাগান করার কাজে ছাত্রছাত্রীদেরকে যুক্ত করার মাধ্যমে এই কাজটি সহজেই করা যায়। পাশাপাশি, গ্রাম পর্যায়ে বসতভিটায় সব্জি, ফল ও ফুলবাগান এবং শহর পর্যায়ে ছাদবাগান কিংবা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের খোলা জায়গায় পুষ্টিবাগান করা এবং বৃক্ষরোপন ছেলেমেয়েদের পাঠ্যক্রমের অংশ করা এবং তা একাডেমিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে এই জরুরী চিন্তার সফল বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

যাহোক, জার্মানির পটেটো হলিডের গল্পটা বলে এ লেখার ইতি টানা যাক। ড. ভল্কার কাশের বাল্যকালে জমি থেকে গোলআলু তোলার কাজে পরিবারকে সহায়তা করতে এক সপ্তাহের মৌসুমী ছুটি দেওয়া হত যা “পটেটো হলিডে” নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শহর-গ্রাম সকল স্কুলই এসময় বন্ধ থাকত। সব শিশুরাই যে আলু তোলার কাজ করত এমন নয়, অন্য কাজও করত। মূলত তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই ছুটি চালু হয়েছিল। প্রথমত শ্রমিক সংকটের সেকালে কৃষকদের কাজে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে শিশুদেরকে উৎসাহিত করা। এবং তৃতীয়ত প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে কর্মক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করা। কৃষির রূপান্তর এবং যান্ত্রিকীকরণের কারণে পটেটো হলিডের উপযোগিতা এখন আর না থাকলেও ছুটিটা এখনও বহাল আছে।  পরিকল্পিতভাবে শৈশব থেকে শিশুদেরকে কৃষির উপযুক্ত কাজগুলোর সাথে আমাদের শিশুদেরকে যুক্ত করার মাধ্যমে শুধু ‍শিশুদেরই নয় দেশেরও বহুমূখী কল্যাণ সাধিত হতে পারে।

#family #farming

#পারিবারিক #কৃষি

বায়োডাইনামিক এগ্রিকালচারঃ জৈব কৃষির নতুন পাঠ

বায়োডাইনামিক এগ্রিকালচারঃ জৈব কৃষির নতুন পাঠ

বাংলাদেশের মত দেশে জৈব কৃষির মত প্রায় অসম্ভব এক কাজের পিছনে প্রায় পুরো কর্মজীবনটা ব্যয় করে ফেললাম। অর্জন বা সফলতার খাতায় আশাব্যঞ্জক খুব বেশি কিছু যুক্ত না হলেও অভিজ্ঞতার ঝুলিটা মুটেও ফেলনা নয়। যদিও অভিজ্ঞতার সবটুকু এখনো কাজে লাগানো যায়নি। এর পিছনে বহুবিদ কারণ রয়েছে। প্রথম ও প্রধান কারণটি হলো গত কয়েক দশক ধরে রাসায়নিক কৃষির চর্চার ফলে আমাদের মাটি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে সেখান থেকে জৈব কৃষিতে ফেরাটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এটা মূলত একটা টেকনিক্যাল কারণ। আরেকটা প্রধান আর্থসামাজিক কারণ হচ্ছে – আমাদের স্বল্প এবং ক্রমহ্রাসমান জমিতে ক্রমবর্ধমান মানুষের বর্তমান খাদ্যচাহিদা মিটাতে হলে বর্তমান রাসায়নিক কৃষির কোন বিকল্প নেই বলেই নীতি-নির্ধারক-মহলসহ দেশের বেশিরভাগ মানুষের এমনকি খোদ কৃষকেরও বদ্ধমূল ধারণা। আপাতদৃষ্টিতে এই ধারণা হয়ত পুরোপুরি অমূলক নয়। জৈব কৃষি বাস্তবায়নে শ্রীলংকার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে যদিও এক্ষেত্রে শ্রীলংকান পন্থা মুটেও বাস্তবসম্মত ছিলনা। জৈব কৃষি চর্চার বাস্তবায়ন যতই কঠিন হউক না কেন তাই বলে মাটি, পরিবেশ, মানবস্বাস্থ্য ইত্যাদি সবকিছুকে হুমকিতে ফেলে আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত খাদ্য চাহিদা মিটাতে হবে সেটা মেনে নিতে মন সায় দেয়না বলেই এই অসম্ভবের পিছে নিরন্তর ছুটে চলা।

আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা যে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। আমাদের সুষম পুষ্টির জন্য একজন মানুষের দৈনিক কতটুকু শর্করা প্রয়োজন সেটা জানা খুব জরুরি। কিন্তু আমরা কয়জন তা জেনেবুঝে খাদ্য গ্রহণ করি? একজন প্যুর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২০০০-২২০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি দরকার হয় তার ৪৫-৬৫% শর্করা থেকে আসতে হবে। তার মানে হলো, সর্বোচ্চ পরিমাণটা ধরা হলেও শর্করা থেকে আসতে হবে ১৪৩০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি। আবার ১ গ্রাম শর্করা সমান ৪ কিলোক্যালোরি শক্তি। অর্থাৎ ১৪৩০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পেতে হলে প্রায় ৩৫৮ গ্রামের মত শর্করা জাতীয় খাদ্য লাগবে। চালে শর্করা থাকে ৮০% এবং সে হিসেবে শর্করার পুরোটাই চাল থেকে পেতে চাইলে আমাদের প্রতিজনের প্রতিদিন চাল লাগে ৪৪৮ গ্রামের মত। কিন্তু আমরা শুধু ভাতই খাইনা আলু, বিস্কুট, চিনি, চিড়া-মুড়ি এমনকি শাকসব্জী ও ফলমূলও খাই যেখান থেকেও শর্করা পেয়ে থাকি। জাতিসংঘের WHO/FAO এর হিসেব অনুযায়ী আমাদের ভাত গ্রহণ করা উচিত সর্বোচ্চ ৪০০ গ্রাম। বাকি ক্যালরি আসবে গম, গোলআলু এবং অন্যান্য খাবার থেকে। তার মানে, আমাদের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে চাল লাগে মুটামুটি ২.৫ কোটি টন বা তার একটু বেশি যেখানে ২০২১ সালে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩.৭৬ কোটি টন।

তদুপরি আমাদেরকে প্রতিবছরই চাল আমদানি করতে হয়। চালের উচ্চমূল্যসহ নানান সংকটতো লেগেই আছে। অন্যদিকে, খাদ্য নিরাপত্তার সংঙা থেকে আমরা জানি যে, তিনবেলা পেটপুরে পোলাও-মাংস-বিরিয়ানি খেলেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়না যদি না সেই খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয় এবং মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা মিটাতে সক্ষম হয়। কাজেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ এসব সংকট মোকাবিলায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের বিবেচনায় মানুষের পুষ্টিজ্ঞান ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত ছিল। অথচ এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে চালের উৎপাদন বৃদ্ধিকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমারা আমাদের কৃষি ও খাদ্যববস্থাকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন করে চলেছি।

আমি কর্মজীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি যতজন কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানির মুখোমুখি হয়েছি তাঁদের বেশিরভাগেরই কথা হচ্ছে জৈব কৃষি আমাদের জন্য বিলাসিতা। কারণ, আমাদের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ক্ষুধার অন্ন যোগান দেওয়া। চ্যালেঞ্জ যেখানে, গবেষণার প্রয়োজন এবং উদ্ভাবনের সুযোগও সেখানে। কৃষি ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে যে বিষয়টা আমাকে সর্বাধিক ভাবিয়ে তুলে সেটা হচ্ছে আমাদের মাটির বেহাল অবস্থা। এককালের “খাটি সোনার চেয়েও খাটি আমার দেশের মাটি” আজ প্রাণহীন মৃত মাটিতে পরিণত হয়ে গেছে। কারণ, জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ। একটি সুস্থ ও সজীব মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন যা আমাদের অধিকাংশ মাটিতে ১% এরও নীচে নেমে গেছে। ফসলের অত্যাবশ্যক ১৭টি পুষ্টি উপাদানের যে ১৩ টি উপাদান মাটি থেকে আসে তার ৬-৭ টির ঘাটতি ইতোমধ্যে আমাদের মাটিতে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে যেগুলো ত্রমবর্ধমান হারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে পূরণ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় যখন মাটি জৈবপদার্থশূণ্য হয়ে পড়বে তখন তা মৃত মাটিতে পরিণত হবে। তখন এই মাটিতে ১৩ প্রকার রাসায়নিক সার দিয়েও ফসল ফলানো সম্ভব হবেনা। কারণ এই সারকে ফসলের জন্য গ্রহণোপযোগি করতেও জৈব পদার্থ অত্যাবশ্যক।

এটা হচ্ছে আমাদের সংকটের একটা দিক। অন্যদিকে আছে রাসায়নিক বালাইনাশক যা ফসল রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক বালাই দমন ব্যবস্থায় পোকাকে পেস্ট বা শত্রুজ্ঞান করে হত্যা করা হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এই পোকারাও এই ইকোসিস্টেমের অংশ। এই ইকোসিস্টেমই জীবজগতের চালিকাশক্তি। বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য একে একটি রেডিওর সাউন্ডসিস্টেমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। রেডিওর সাউন্ড সিস্টেমের কোথাও কোন একটি আইসি নষ্ট হলে যেমন গোটা রেডিওটাই বিকল হয়ে পড়ে তেমনি আমরা যাকে পেস্ট বা বালাই বলি সেগুলো না থাকলে ইকোসিস্টেমও বিকল হয়ে পড়ে। আমাদের ইকোসিস্টেমের খাদ্য-শিকল অক্ষুণ্ণ রাখতে পোকামাকড় অত্যাবশ্যক। কারণ, এই পৃথিবীতে একমাত্র সবুজ উদ্ভিদই নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারে যেখানে মানুষসহ বাকী সকল প্রাণিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এই খাদ্যকে ইকোসিস্টেমে পৌছে দিতে এই পোকামাকড়ই হলো প্রাথমিক পোষক। অবশ্য সমাজের দুষ্টু মানুষদের মত ক্ষতিকর পেস্টকে দমন করতে হবে, নির্মূল নয়। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম অক্ষুন্ন থাকলে হয় এমনিতেই দমন হয় নয়তো কিছু প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে খুব সহজেই দমন করা সম্ভব হয়।

এই সিস্টেমের আরেকটি কম্পোনেন্ট হলো ম্যাক্রো ও মাইক্রোক্লাইমেট যার সাথে আলো-বাতাসসহ জলবায়ুগত নানান উপাদান জড়িত। এই উপাদানগুলোর অন্যতম হলো সূর্যের আলো যা পৃথিবীর সকল শক্তির আদি উৎস। এই শক্তিই খাদ্যের মাধ্যমে সমগ্র জীবজগতে সঞ্চারিত হয়। সৌরজগতের অংশ হিসেবে অন্যান্য গ্রহ এবং পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চন্দ্রসহ অন্যান্য মহাজাগতিক শক্তিগুলোর প্রভাবও থাকতে পারে যা নিয়ে পূর্বে আমার তেমন কোন ধারণা ছিলোনা যা বায়োডায়নামিক এগ্রিকালচারের অন্যতম অনুসঙ্গ। এদিক থেকে বায়োডাইনামিক এগ্রিকালচারকে অনেকে সাইন্টিফিকের চেয়েও স্পিরিচুয়াল বলতেই বেশি আগ্রহী। কসমোলজি বিজ্ঞানের বিরাট এক শাখা হলেও কসমিক ফোর্সের সাথে জীবজগতের নিবিড় যোগাযোগ সম্পর্কে খুব বেশি গবেষণা আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

জৈব কৃষি, পারমাকালচার, রিজেনারেটিভ এগ্রিকালচার, ইকোলজিক্যাল এগ্রিকালচার, জিরোবাজেট ন্যাচারাল ফার্মি, স্থায়িত্বশীল কৃষি, বায়োডাইমানিক এগ্রিকালচার (বিডি) ইত্যাদি নানা নামে যেসব কৃষিচর্চা আছে তার মূলমন্ত্রই হচ্ছে এই প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমটাকে ঠিক রেখে ফসল উৎপাদন করা। জৈব কৃষি নিয়ে এতদিন কাজ করতে গিয়ে এই ইকোসিস্টেমটাকে সারিয়ে তোলা বা পুণপ্রতিষ্ঠার উপায় অনুসন্ধান করেছি। কিন্তু বায়োডাইনামিক কৃষিতে এসব টেকনিক্যাল ও প্রাকৃতিক বিষয়ের সাথে একটি অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ও আছে যা সম্পর্কে এশিয়া-প্যাসিফিক বায়োডাইনামিক কনফারেন্সে এসে আরও গভীরভাবে জানা গেলো।

বিডি এগ্রিকালচারের অন্যতম মূল কথা হচ্ছে কসমিক ফোর্সের সাথে এই পৃথিবীর কৃষি-ইকোসিস্টেমের যে যোগসূত্র এবং ব্যালেন্স থাকা দরকার সেটা পূণঃপ্রতিষ্ঠা করা। মালয়াশিয়ার পাহাং রাজ্যের রাউব শহরে মালয়েশিয়া ডিমেটার এসোসিয়েশন(এমডিএ)-এর আয়োজনে ২০-২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই সম্মিলনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৮টি দেশের প্রায় ১৫০ জন মানুষ অংশগ্রহন করে। মাটি বাংলাদেশ থেকে আমরা পাঁচ সদস্যের একটি দল অংশ নিয়েছিলাম। আশা করি এখান থেকে লব্ধ শিখন এবং অভিজ্ঞতাগুলো আগামিকত বেশ কাজে দিবে।

হানসালিম: নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার এক অনুসরনীয় মডেল

হানসালিম: নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার এক অনুসরনীয় মডেল

ভূমিকা

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ভোক্তাদের কাছে মাত্র কয়েকটি জৈবপণ্য বিক্রির ছোট্ট একটি দোকান দিয়ে” হানসালিম” নামে যে সাপ্লাই চেইনের যাত্রা শুরু হয়েছিল সাড়ে তিন দশকের ব্যবধানে তা আজ দক্ষিণ কোরিয়ায় জৈব কৃষক এবং ভোক্তাদের সর্ববৃহৎ ফেডারেশনে পরিণত হয়েছে। শুধু কোরিয়তেই নয়, এটি আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জৈব ভোক্তা সমবায় যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ এবং এটি বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রি করে থাকে।

হানসালিম মডেলের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে সরাসরি এবং কার্যকর যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। কৃষককেরা তাঁদের উৎপাদিত জৈব খাদ্যপণ্য হানসালিম বিক্রয়-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌছে দেয়। হানসালিম মডেল মূলত কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যেখানে কৃষক যেমন ভোক্তার স্বাস্থ্যের দ্বায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নিয়েছে তেমনি ভোক্তাও গ্রহণ করেছে কৃষকের জীবন-জীবিকার দ্বায়িত্বভার।

হানসালিম মডেলের অন্তর্ভূক্ত কৃষক এবং ভোক্তার রয়েছে অভিন্ন এক লক্ষ্য – শুধু একা নয় সবাই মিলে ভালো থাকা। কেবল নিজেদের জীবন নয়, এই পৃথিবী ও প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচাতে তাঁদের রয়েছে সম্মিলিত প্রচেষ্টা যা তাঁরা শুধু কথায় নয় তাঁদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে এর প্রতিফলন ঘটায়। আজকাল অনেকে জৈব কৃষিকে শুধু অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে দেখে থাকে। কিন্তু হানসালিম পরিবারের কাছে জৈব কৃষি হলো শুধু কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা নয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে দায়িত্বশীল সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমও বটে।

সৃষ্টির প্রেক্ষাপট

১৯৮৬ সালের কথা। সেসময় সারাবিশ্বের মত দক্ষিণ কোরিয়াতেও মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ন্ত্রিত খোলা বাজার ব্যবস্থার এক উত্তাল ঢেউ লেগেছিল যার প্রভাবে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়েই চরম বিপাকের মধ্যে নিপতিত হয়। পাশাপাশি, বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি গ্রহণের ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্তির শঙ্কার মুখোমখি হয়। একদিকে যেমন কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে থাকে অন্যদিকে, রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক দ্বারা উৎপাদিত ও আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দৌরাত্মে ভোক্তাগণও দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিপন্নতার কবলে পড়ে মানবস্বাস্থ্য। দেশজ কৃষির স্থলে তথাকথিত আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পরিবেশ। অবস্থাটা ঠিক যেন আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে হুবহু মিলে যায়। এমনি এক পরিস্থিতিতে মি. পার্ক জাই ইল নামক একজন সমাজকর্মী যিনি হানসালিমের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন তিনি সিউলে ”হানসালিম সংসান” নামে ছোট একটি দোকান খুলেন যেখানে তিনি বিষমুক্ত চাল, তিলের তেল, উর্বর ডিম, মাল্টিগ্রেইন (বেশ কয়টি দানাদার খাদ্যের মিশ্রণে তৈরি এক ধরণের খাবার) ইত্যাদি হাতেগোনা কয়েকটি পণ্যের বিক্রয় শুরু করেন। ভোক্তাগণ ক্রমশ এই দোকানের নিরাপদ পণ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলে ১৯৮৮ সালে গড়ে উঠে হানসালিম ভোক্তা সমবায়। এরপর ক্রমাগতভাবে এই সমবায়ের প্রসার ঘটতে থাকে যা আজও সমান তালে অগ্রসরমান।

প্রসার ও প্রভাব

হানসালিমের প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ কোরিয়ায় জৈব কৃষির উন্নয়ন এবং জৈব কৃষি সমবায় সম্পসারণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয় এটা কোরিয়ার অন্যান্য সমবায়ের জন্য অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছে যেখানে বর্তমানে চারটি বৃহৎ কোঅপারিটেভ কোরিয়ার জৈব পণ্যের বাজারের প্রায় ৩০% দখল করে আছে। হানসালিমের সদস্যদের দ্বারাই সমষ্টিগত উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাত্র ১০০ জন কর্মচারি ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল সাপ্লাই চেইন পরিচালনা করছে। কর্মী সংগঠন তিনটি নীতিতে পরিচালিত হয় – ১) একত্রে বিনিয়োগ, ২) একত্রে কাজ করা এবং ৩) একত্রে ব্যবস্থাপনা করা।

হানসালিমের কর্মীগণ কৃষির প্রকৃত মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্দি করতে এবং কৃষির স্থায়িত্বশীলতার জন্য জৈব কৃষি চর্চায় কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি, তারা এটা উপলব্ধি করেছিলো যে, বিদ্যমান খাদ্য ব্যবস্থায় কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের নানাবিধ সমস্যা এবং সংকট সমাধানে মধ্যস্বত্বভোগি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী। এরূপ চিন্তা থেকেই তারা কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে একটি বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় যেখানে সাপ্লাই চেইন-এর ব্যবস্থাপনাগত ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে কৃষককে সর্বোচ্চ পরিমাণ লভ্যাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।

কর্মপদ্ধতি

ভোক্তাগণই হানসালিমের প্রকৃত মালিক, অন্যান্য কোম্পানির মত শ্রেফ তথাকথিত “প্রিয় গ্রাহক” নন। উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠা নিবিঢ় হৃদ্ধতাপূর্ণ স্থায়ি এক সুসম্পর্কই হানসালিমের মূল চালিকাশক্তি এবং সকল সাফল্যে মূলমন্ত্র। সদস্যদের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত একটি পরিচালনা পরিষদ প্রতিষ্ঠানের সকল নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করে থাকে। সারাদেশের ২০টি স্থানীয় হানসালিম একইভাবে পরিচালিত হয়। পণ্যের আদর্শ গুণমান নির্ধারণ, পণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নতুন পণ্য নির্বাচন থেকে শুরু করে নানান সামাজিক বিষয়ে হানসালিমের নীতিগত অবস্থান নির্ধারণ করা পর্যন্ত সকল সিদ্ধান্তই এই পরিচালনা পরিষদ গ্রহন করে থাকে। সদস্যগণ হানসালিমের বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে উৎপাদন এলাকা পরিদর্শন করে, বাস্তব অবস্থা যাচাই করে এবং উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে তথ্য ও মতামতের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। উৎপাদক এবং ভোক্তা মিলে একটি অংশগ্রহনমূলক নিশ্চয়তা পদ্ধতি অনুসরণ করে সকল পণ্যের গুণমানের নিশ্চয়তা বিধান করে থাকে।

হানসালিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সারাদেশে এর ৫০০টিরও বেশি গ্রামভিত্তিক এবং অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মৌলিক অঙ্গসংগঠন আছে। এসব অঙ্গসংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত উৎপাদক, কর্মী এবং ভোক্তা একসাথে বসে প্রতি নতুন বছরের শুরুতে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বছরব্যাপি কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদন করা হবে, কে কে উৎপাদন করবে, কোথায় কোথায় উৎপাদন করবে এবং তার দাম কত হবে এসবকিছুই এই পরিকল্পনা সভায় ঠিক করা হয়। ফলে, হানসালিম সদস্যগণ সারাবছর পূর্বনির্ধারিত দামেই পণ্য পেয়ে থাকে। বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে বা কমে গেলেও হানসালিম পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে। ফলে, এখানে কৃষক বা ভোক্তা কারও ঠকে যাওয়া বা জিতে যাওয়ার কোন বিষয় এখানে থাকেনা।

হানসালিম কর্তৃক পরিচালিত সাপ্লাই চেইনের পরিচালন ব্যয় যেমন: কর্মীদের জন্য ব্যয়, পরিবহন ও বিতরণ ব্যয়, বিজ্ঞাপন ব্যয়, সাংগঠনিক ব্যয়, সমবায়ভূক্ত এবং সমাজের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সেবা ও অন্যান্য দরকারী সহযোহিতার জন্য ব্যয় ইত্যাদি সকল ব্যয় নির্বাহের জন্য পণ্য বিক্রয় থেকে মোট লাভের ২৪% রেখে বাকী ৭৬% উৎপাদকদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়।

পণ্যের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি

পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের সন্তুষ্টি এবং উভয়ের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার বিষয়গুলো সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় যাতে পরবর্তী প্রজন্ম একটি নিরাপদ জীবন লাভ করতে পারে। হানসালিমের নিজস্ব দাম নির্ধারণ পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কৃষক ও ভোক্তা মিলে নিজেরাই পণ্যের উৎপাদন খরচ এবং ন্যয়সঙ্গত লাভ রেখে ভোক্তার জন্য ফসলের দাম নির্ধারণ করে দেয় যার সাথে বাজারে বিদ্যমান দামের সম্পর্ক থাকেনা। এক্ষেত্রে কার্যত ফসল চাষের আগেই সম্ভাব্য উৎপাদন খরচ এবং কৃষকের ন্যায্য লাভ নিশ্চিত করে উৎপাদক সমিতি নিজেরাই ফসলের দাম ঠিক করে থাকে। ফলে, কৃষকের জন্য ফসল চাষ থেকে লাভজনক মূল্য পাওয়ার গ্যারান্টি থাকে।

জৈব উপায়ে উৎপাদিত হওয়ার কারণে কখনো কখনো হানসালিমের পণ্যের দাম বাজারের চলতি দামের চেয়ে বেশি হয়। কারণ, জৈব খাদ্যপণ্য উৎপাদনে শ্রম বেশি লাগে এবং রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, হরমোন ইত্যাদি প্রয়োগ করে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে ফলনও কম হতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষির স্থায়িত্বশীলতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভোক্তাগণ এই উৎপাদন পদ্ধতিকেই উৎসাহিত করে থাকে এবং কৃষককে বাড়তি দাম দিতে কার্পণ্য করেনা। সচেতনতার কারণে সদস্যগণ জানে যে, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিলে এবং এই মুক্ত বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে লাগামহীনভাবে বাড়ে এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা যেভাবে ভোক্তার পকেট কাটে সেই তুলনায় হানসালিমের পণ্যের দাম বরং বাজারের চেয়ে কমই থাকে।

অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উৎপাদন পর্যায়ে বর্ধিত ঝুকি মোকাবিলা এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোন কারণে কৃষকের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাতে দাম বাড়াতে না হয় এবং কৃষকদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায় তাই ২০১৫ সালে দুটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১) মূল্য স্থিতিশীলীকরণ তহবিল এবং ২) উৎপাদন স্থিতিশীলীকরণ তহবিল।

হানসালিমের পণ্যসম্ভার

হানসালিম শুধু জৈব খাদ্যপণ্য সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং এটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যই সরবরাহ করে থাকে। এই সাপ্লাই চেইন এখন প্রায় ১৯০০ প্রকার পণ্য সরবরাহে কাজ করে যার মধ্যে রয়েছে দানাশস্য, শাক-সব্জি, মাছ, প্রাণিজ খাদ্য, সামুদ্রিক খাদ্য, বাদাম ইত্যাদি, প্রক্রিয়াকৃত খাদ্য যেমন: দুগ্ধজাত খাবার, জ্যাম, জ্যালি, সস, টসু, নুড্যুলস, স্ন্যাকস ইত্যাদি। এছাড়াও পণ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রবিবেশসম্মত প্রসাধন সামগ্রী এবং বই। হানসালিম পণ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তারা কোন আমদানিকৃত পণ্য বিক্রয় করেনা।

হানসালিম পণ্যের গুণমান

জৈব উৎপাদনের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের পাশাপাশি ব্যয়বহুল তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন বৃদ্ধি পেয়েছে। হানসালিমকে তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেটের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয় না। বিপরীতে তারা নিজস্ব কনজিউমার সার্টিফিকেশন সিস্টেম গড়ে তুলেছে। এই সিস্টেমের উদ্দেশ্য হল হানসালিম পণ্যগুলির একটি বিস্তৃত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং উৎপাদককে আরও স্বাধীন ও দায়িত্বশীল করে তোলা এবং উৎপাদন এলাকা এবং পণ্যগুলির সম্পর্কে গ্রাহকদের ধারণা ও আস্থা সৃষ্টি করা। এই ব্যবস্থায় ভোক্তাগণ নিয়মিতভাবে কৃষকদের খামার পরিদর্শন করে একদিকে যেমন খাদ্যের গুণমান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় অন্যদিকে তেমনি কৃষকের জীবনযাত্রার নানান সমস্যা সম্পর্কেও খোজ-খবর করে, তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশভাগী হয়। এভাবেই কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে গড়ে উঠে এক সুদৃঢ় আত্মিক সুসম্পর্ক।

হানসালিম তাদের পণ্যের গুণগত আদর্শমান বা স্যান্ডার্ড তারা নিজেরাই ঠিক করে থাকে। তাদের পণ্যের স্যান্ডার্ডের মধ্যে রয়েছে ১) সম্পূর্ণরূপে রাসায়িক সার ও বালাইনাশক মুক্ত, ২) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দেশীয় পণ্য ৩) টাটকা ও মৌসুমি শাক-সব্জি ও ফলমূল, ৪) জিএমও মুক্ত, ৫) কোনপ্রকার এডিটিভস ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত, ৬) কৃত্রিম রঞ্জক, ফ্ল্যাভার ও মিষ্টিকারক দ্রব্য (যেমন: স্যাকারিন) ইত্যাদি থেকে মুক্ত, ৭) এন্টিবায়োটিক মুক্ত, ৮) কৃত্রিম হরমোন ও ভিটামিন মুক্ত। নিয়মিতভাবে খাদ্যপণ্যে বালাইনাশকের অবশেষ, হেভিমেটালের উপস্থিতি, অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি ইত্যাদি পরীক্ষা এবং  জাপানের ফুকোশিমা পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে সংঘটিত দুর্ঘটনার পর থেকে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষাও করা হয়। হানসালিম পণ্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্যাকেটের গায়ে খাদ্যের উৎস্য লিপিবদ্ধ করা হয় যাতে খাদ্যদ্রব্যের অতিক্রান্ত দূরত্ব নির্ণয় করা যায় এবং স্থানীয় পণ্য যাতে স্থানীয় বা সবচেয়ে নিকটস্থ হানসালিম বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রয় হয় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় যেন খাদ্যের কার্বন ফুটপ্রিন্ট সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে।

উপসংহার

প্রায় সাড়ে তিন দশকের সাফল্যজনক পথচলায় হানসালিম সমবায় মডেল একদিকে যেমন ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ ও ‍পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান দিতে পেরেছে অন্যদিকে তেমনি কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতেও সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ধ্বংসাত্মক বর্তমান উন্নয়ন মডেলের বাইরে গিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি শান্তিময় সহাবস্থান নিশ্চিত করার এক স্থায়িত্বশীল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সর্বোপরি, মুক্তবাজারের প্রবল স্রোত মোকাবিলা করে সাফল্যের সাথে তার বিষ্ময়কর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পেরেছে যা আগ্রহী এবং চিন্তাশীল ও অনুসন্ধিৎসু মানুষদের জন্য এক অনুসরনীয় ও অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

শহীদুল ইসলাম, কৃষিবিদ ও কৃষি উন্নয়ন গবেষক

shahid.bd1172@gmail.com

সার-সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছাপ্রসূত কৃষক-বান্ধব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

সার-সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছাপ্রসূত কৃষক-বান্ধব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশের সীমিত পরিমান আবাদী জমি থেকে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, নিজে খেয়ে না খেয়ে, ১৬ কোটি মানুষের মুখে নিরন্তর অন্ন তুলে দিচ্ছে যারা সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের যেন অন্ত নেই। পেটে ভাত নেই, পরনের কাপড় নেই, মাথা গুজার ঠাই নেই, ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ ও লেখাপড়া শেখানোর অর্থ নেই – এমনি হাজারও সমস্যার সাথে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে চলমান সার সংকট। সারতো কোন বিলাস দ্রব্য নয় যে, এর চাহিদা মেটানোর দায় কোন ভাবে এড়িয়ে গেলেই হল। তাছাড়া, এটা শুধু কৃষকের একার সমস্যাই নয়, সারা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও এর সাথে জড়িত। অথচ এই সারের দাবীতে কৃষকের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে চলমান এই দূর্ভোগ থেকে কৃষকের যেন মুক্তি নেই।

অথচ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সারতো কৃষক চায়না। বরং প্রকৃত সত্য এই যে, প্রয়োজনীয় পরিমান সার কেনার সাধ্যও কৃষকের নেই। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বা মাঠের ফসল কম দামে আগাম বিক্রী করে দিয়ে বা খাদ্য ও বীজ হিসেবে ঘরে সঞ্চিত শস্য বিক্রী করে বা ধার-কর্জ করে বহুকষ্টে কৃষক সার কেনার অর্থ জোগাড় করে। তবু কেন এই সংকট, এর কি সমাধান আদৌ নেই! তাছাড়া এ সংকটতো নতুন নয়। বিগত সরকারগুলো বোধগম্য কারণেই এই সংকট সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন করেনি। কারণ তাদের চেলা চামুন্ডারা এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে পকেট ভারি করার ধান্দা করেছে। কিন্তু বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলেও কেন একই চিত্র দেখা যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীদের মত বর্তমান মাননীয় শিল্প উপদেষ্টাও এই সংকটকেই অস্বীকার করে সমস্ত দায়ভার অবলীলায় নন্দঘোষ কৃষকের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছেন। মুক-বধির কৃষকের হয়ত এটাই নিয়তি!!!

ভাবতে অবাক লাগে এই সারই একসময় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে কৃষককে দেওয়া হয়েছে। বোকা কৃষক (!) তখন এই সার নিতে চায়নি। নানান ছলে ও কৌশলে বোকা কৃষককে এই সার, কীটনাশক, সেচ ও অন্যান্য ব্যয়বহুল কৃষি উপকরণগুলো ব্যবহারে অভ্যস্থ করা হয়েছে। বাহ্যিক উপকরণবিহীন যে স্থায়িত্বশীল ও স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা এতকাল কৃষকরা চর্চা করে আসছিল তা ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিয়ে বর্তমানের যে বাণিজ্যিক চাষ-ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানকে সমৃদ্ধ করলেও সেটা যে কৃষকের জন্য আহামরি কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি, চলমান সার সংকট তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বরং সুপরিকল্পিতভাবে এমন এক দুর্ভেদ্য ব্যবসার জালে কৃষককে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যে জাল ছিড়ে বেরোনোর আর কোন পথই যেন খোলা নেই। বেঁচে থাকতে হলে ফসল ফলাতে হবে, আর ফসল ফলাতে হলে উচ্চমূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক, ডিজেল ইত্যাদি কিনতেই হবে। এই নিশ্চিত মুনাফার নিশ্চিন্ত ব্যবসায় দিনে দিনে ফুলেফেঁপে উঠছে দেশী-বিদেশী কোম্পানি আর রক্তচোষা মধ্যস্বত্বভোগীরা। দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনকে দ্বিগুনের বেশি বৃদ্ধি করেও অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে কৃষককেই। একদিকে কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী মুনাফাখোর অক্টোপাসের শোষণ আর অন্যদিকে ঘামঝরানো শ্রমে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের উদ্বৃত্ব মূল্যের মধ্যস্বত্বভোগী কর্তৃক লুন্ঠন – এই দ্বিমুখী শোষণের ও লুন্ঠন শিকার হয়ে কৃষকের আজ ত্রাহি মদুসদন দশা।

রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতই বর্তমান সরকারও বারবার বলে চলেছে যে, দেশে চাহিদার তুলনায় সার মজুদের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশের সার কারখানাগুলো উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জনে সবসময় ব্যর্থ। বর্তমানে বিসিআইসি’র বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) অধীনস্ত ৭ টি সার কারখানা (৬ টি ইউরিয়া ও ১ টি টিএসপি কারখানা) থেকে ২০০৪-০৫ সালে ৪২.৫ লাখ মে.টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত হয় ২২.৪৩ মে.টন এবং আমদানি করা হয় ১৬.৩৫ লাখ মে. টন অর্থাৎ মোট মজুদ ৩৮.৭৮ লাখ মে.টন যা চাহিদার তুলনায় কম। ২০০৫-০৬ সালে দেশের কারখানাগুলোতে প্রায় ১৯.২৬ লাখ মে.টন সার উৎপাদিত হয় যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ মে.টন কম। এখানে লক্ষনীয় যে, সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সংকট সত্ত্বেও ১৯৯৫-৯৬ সালের পর থেকে সারের উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান যা দেশের সার সংকটকে ভবিষ্যতে আরও তীব্র করে তোলার ইঙ্গিত বহন করে। কারণ, বহুল কথিত মুক্তবাজারে সারের মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ, যে ইউরিয়া ও ফসফেট সারের সংকট সবচেয়ে তীব্র সে দুটি সারই বাংলাদেশে তৈরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইউরিয়া তৈরির কাাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস আমাদের রয়েছে। অথচ, গ্যাস রপ্তানি নিয়ে যতটা মাথা ঘামানো হয়েছে এই গ্যাস ব্যবহার করে ইউরিয়া সার উৎপাদন করার ক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও হয়নি। তা যদি হত তবে হয়ত সার সংকট এতটা তীব্র আকার ধারণ করতনা। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের বস্তাপ্রতি মূল্য যেখানে প্রায় ৮০০ টাকা সেখানে এদেশের কারখানায় তার উৎপাদন খরচ পড়ে মাত্র ৪০০ টাকা। অথচ অজ্ঞাত কারণে উচ্চহারে ভর্তুকী দিয়ে সার আমদানির প্রতিই আমাদের নীতিনির্ধারক মহলের অধিক ঝোঁক লক্ষ করা যায়।

অন্যদিকে, সারের ক্রমবর্ধমান আমদানী নির্ভরতাও সার সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। ১৯৯৫-৯৬ সাল পর্যন্ত সার আমদানী সীমিত আকারে থাকলেও বর্তমানে তা অত্যন্ত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসময়কালে সারের আমদানী দ্বিগুনেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সার আমদানির ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান যা সার সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে সারের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চরম অস্থিতিশীলতা, আমদানির পরিমান নির্ধারণে সিদ্ধান্তহীনতা ও দীর্ঘসুত্রিতা, এলসি’র ক্লিয়ারেন্স সময়মত না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্দর সমস্যার কারণে শিপমেন্ট সময়মত না হওয়া, আমদানিকারক নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছতা, কিছু অসাধু আমলা ও আমদানিকারকদের যোগসাজসে আমদানি কোটায় কারচুপি ইত্যাদি। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের অস্থিতিশীলতা এবং সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিপরায়নতার সুযোগ নিয়ে আমদানিকারক ও ডিলাররা সারের মূল্য ইচ্ছামত বাড়িযে দেয়। গত তিন বছর ধরে যে টিএসপি সারের মূল্য বস্তাপ্রতি ৬৫০-৭৮৫ টাকা ছিল এ মাসেই তা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে দাড়িয়েছে ১২০০-১৫০০ টাকা। হঠাৎ করে এরূপ মূল্য বৃদ্ধির কোন যৌক্তিক কারণ ছিলনা। ডিলাররা তাদের নামে বরাদ্দকৃত সব সার কৃষকের মাঝে বিতরণ না করে বেশি দামে বাইরে বিক্রী করে দেয়। খুচরা বিক্রেতারা এই সার কিনে নিয়ে ইচ্ছেমত উচ্চমূল্যে বিক্রী করে। ডিলারের কাছ থেকে সার না পেয়ে কৃষকরা উচ্চমূল্যে এই সার কিনতে বাধ্য হয়। ৩০০ টাকা দামের এক বস্তা ইউরিয়া সার কৃষককে ৭০০-৮০০ টাকা দামেও কিনতে হচ্ছে।

ভেজাল ও নিন্মমানের সার আমদানি আরেকটি মারাত্মক সমস্যা যা কৃষকের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। শিল্পবর্জ্যকেও সার হিসেবে আমদানির অনেক নজির এদেশে আছে। যেমনঃ ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি শিল্পবর্জ্যকে পটাশ সার হিসেবে আমদানি করা হয়। এ সার মাটিতে দিলে ফসল পুড়ে যেতে দেখা গেছে যাতে প্রচুর কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেসময় এটি নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি ও নানা মহল থেকে উঠা প্রতিবাদের মুখে আমদানি বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে চীন থেকে একটি শিল্পবর্জ্যকে ডিফিউজড ম্যাগনেশিয়াম ফসফেট সার নামে আমদানি ও বাজারজাত করা হয়। এ সার জমিতে প্রয়োগ করার পর ৬ মাসেরও অধিক সময় ধরে পাথরের মত অবিকৃত থাকতে দেখা গেছে। এটি নিয়েও তখন ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে এর আমদানি বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার।

চলমান সার সংকটের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চাহিদা নিরূপন ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে বেশকিছু পদ্ধতিগত ক্রটিকে দায়ি করা যায়। জরিপের মাধ্যমে সারের চাহিদা নিরূপিত হলেও এ জরিপের যথার্থতা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ এই জরিপের মাধ্যমে প্রাক্কলিত চাহিদা ও বাস্তব চাহিদার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বিরাজ করে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই চাহিদার তুলনায় বরাদ্দের পরিমান কম থাকে। উদাহরণস্বরূপ: ২০০৭-০৮ সালে ঝিনাইদহ জেলার ৫৯,০০০ মে. টন সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৫৫,৫৫০ মে. টন। অন্যদিকে বরাদ্ধ থেকেও কম পরিমানে সার সরবরাহ করা হয়। যেমনঃ ২০০৬-০৭ সালে ঝিনাইদহ জেলার জন্য বরাদ্দকৃত ৫৫,০০০ মে. টন সারের বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ৫২,০০০ মে. টন। ২০০৫-০৬ সালে দেশে ইউরিয়া সারের মোট বরাদ্দ ২৮ লাখ মে. টনের বিপরীতে সরবরাহ করা হয় মাত্র ২৫ লাখ মে. টন। সার বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুর্ণীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

ফ্যাক্টরী থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে সার পৌছানো পর্যন্ত মনিটরিং ব্যবস্থা জোড়ালো ও কার্যকরী নয়। পাশাপাশি কর্তব্য পালনে অবহেলা, ঘুষ, দুর্ণীতি, অনিয়মও এজন্য কম দায়ী নয়। বাস্তবে দেখা যায়, ডিলারের গোদামে সার না থাকলেও চোরাকারবারি ব্যবসায়ীদের কাছে সারের অভাব নেই। চোরাকারবারিরা ৩০০ টাকার সার ৭০০-৮০০ টাকা দরে কৃষকের কাছে বিক্রী করছে প্রকাশ্য দিবালোকে। কৃষক দিনের পর দিন জরুরী কাজ ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকেও সার না পেয়ে চোরা কারবারির কাছ থেকে অতি উচ্চমূল্যে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। সার মনিটরিং কমিটি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে তারা এ কাজ দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে দুনীতির বিরূদ্ধে জেহাদ ঘোষনাকারী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও।

পূর্বে বিসিআইসি অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকে শতশত খুচরা বিক্রেতা সার সংগ্রহ করত ও প্রতিযোগিতামূলক দামে তা কৃষকের কাছে বিক্রী করত। কিন্তু বর্তমানে সার বিতরণের একমাত্র এজেন্ট হল এসব ডিলাররা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কিছুসংখ্যক প্রতিনিধির মাধ্যমে সার বিতরণ করলেও এসব প্রতিনিধি নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ফলে এসব ডিলাররা একচেটিয়াভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। পূর্বের খুচরা বিক্রেতারা ছিল মূলতঃ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী কিন্তু ডিলারদের এসব প্রতিনিধি সাধারণতঃ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী নয়। কাজেই একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ক্রেতাদের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতাও এদের নেই। খুচরা বিক্রেতারা কৃষককে মৌসুমে বাকীতে সার দিত কিন্তু এরা তা দেয়না। ফলে, গরীব কৃষকের পক্ষে সার কেনা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ গরীব কৃষকের পক্ষে নগদ টাকা জোগাড় করা কঠিন।

বর্তমান ডিলারশিপ ব্যবস্থায গুটিকয় ডিলারদের একচেটিয়া মুনাফা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষান্তরে, লাখ লাথ খুচরা বিক্রেতার ব্যবসা বন্ধ হওয়ার ফলে তাদের উপার্জনের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে যা তাদের জীবন জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, এই শূন্যতা পূরণ করছে একশ্রেণীর মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী যারা কালোবাজার থেকে সার সংগ্রহ কওে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রী করছে। আর এই কালোবাজারে সার আসছে ডিলারদের কাছ থেকেই। চলমান জরুরী অবস্থা এবং সার বিতরণ ব্যবস্থায় যৌথ বাহিনীর পূর্ন নিয়ন্ত্রণ সত্বেও ডিলারদের এরূপ দৌরাত্ব প্রমাণ করে যে, গুটিকয় ডিলারদের মাধ্যমে সার বিতরণ ব্যবস্থা সমস্যা আরও বাড়াবে বৈ কমাবে না। বর্তমান বিতরণ ব্যবস্থায় জেলা ও উপজেলাভিত্তিক সারের যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা অন্য জেলা ও উপজেলায় স্থানান্তর নিষিদ্ধ। ফলে, দেখা যায় কোথাও সার উদ্বৃত্ব থাকছে আবার কোথাও সারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই উদ্বৃত সার কালোবাজারিদের হাতে চলে যাচ্ছে।

এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিশেষকরে বড় কৃষক ও অনুপস্থিত কৃষকরা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে সাধারণতঃ তাদের প্রাপ্য সারের চেয়ে অনেক বেশি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরু মৌসুমের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সার একসাথে মজুত করে ফেলে। ফলে, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র কৃষকরাই সাধারণতঃ সার থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাদের জমির পরিমান খুবই কম জমির পরিমান খুবই কম তাদের পক্ষে সার সংগ্রহ করা সবচেয়ে কঠিন। ডিলাররা যেহেতু প্রভাবশালী সুতরাং তাদের সার পাওয়া না পাওয়া ডিলারের মর্জির উপর নির্ভর করে। ফলে প্রায়শঃই দেখা যায় যে, কৃষক ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকে সার সংগ্রহ করে খুচরা বিক্রেতাদের হাতে তুলে দিয়ে সেই সার বেশী মূল্যে বাকীতে কিনে নিয়ে যায়। কারণ, নগদে সার কেনার মত টাকা কৃষকের হাতে থাকেনা।

অন্যদিকে, সারের মূল্য কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার নামে যে ভর্তুকী দেওয়া হয় তার সুফলও কৃষকের কাছে পৌছায় না। এবছর (২০০৭ সাল) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিবস্তা ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৪০০ টাকা যা সরকার বিক্রী করে ২৪০ টাকায়। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি প্রায় ১৬০ টাকা (টন প্রতি ৩২০০ টাকা) ভর্তুকী দেওয়া হয়। অন্যদিকে, আমদানিকৃত ইউরিয়া সারে বস্তাপ্রতি ৫৬০ টাকা (টন প্রতি ১১২০০ টাকা) ভর্তুকী দেওয়া হয় যাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সারের সমান দরে বিক্রী করা যায়। অথচ সে সার কৃষককে ৭০০-৮০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়েও আমদানিকারকরা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে এরূপ ঘটনার খবর পত্রপত্রিকায় প্রচুর দেখা গেছে। অর্থাৎ ভর্তুকীর সুফল পাচ্ছে মূলতঃ আমদানিকারক ও ডিলাররা।

যাহোক, সার বিতরণের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ দূর করার জন্য সরকার সম্প্রতি কার্ড সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ গ্রহন করেছে। কিন্তু যেভাবে এই সিস্টেমটি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে কিছু সুবিধা হয়ত পাওয়া যাবে তবে অনেক অসুবিধাও সৃষ্টি হবে। যেমনঃ এতে সার বিতরণ ব্যবস্থা আরও জটিল হবে। কারণ, অশিক্ষিত কৃষকের পক্ষে সঠিক তথ্য সরবরাহ ও সংরক্ষণ করা সহজ হবেনা। ডিলারের কাজ বেড়ে যাবে। কার্ড হারানো, নতুন কার্ড ইস্যু ইত্যাদি জটিলতা বাড়বে। তাছাড়া, এসব কাজ করতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার দাপ্তরিক কাজ বেড়ে যাবে ফলে তাদের দেয় সেবার মান বর্তমানের চেয়েও কমে যাবে। ফসল চাষের হিসাব সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ফসল চাষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে কৃষক সমস্যায় পড়বে।

সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু সুপারিশ

১.    জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ সার সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করা।

২.   দেশে সারের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করা। পাশাপাশি পুরাতন কারখানাগুলোর অত্যন্ত পুরনো ও ক্রটিপূর্ণ যন্ত্রপাতিগুলো প্রতিস্থাপন ও সময়মত মেরামতের উদ্যোগ গ্রহন করা।

৩.   সারের চাহিদা নিরূপন সঠিকভাবে করার জন্য সঠিকভাবে জরিপকাজ পরিচালনা করা।

৪.   প্রত্যেক জেলায় সরকারী গোদামে সরকারী উদ্যোগে সার এনে সেখান থেকে খুচরা ডিলারের মাধ্যমে সার বিক্রীর ব্যবস্থা করা যাতে মাঝখানে আর কোন হাত না থাকে।

৫.   প্রত্যেক গ্রামে সৎ ও দক্ষ ব্যবসায়িদের নিয়ে ৮/১০ জন ডিলারের একটি প্যানেল তৈরি করা যারা বছরানুক্রমে সার সরবরাহ করবে। ডিলারশীপের জন্য সিকিউরিটি মানির পরিমান আরও কমানো যাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ডিলারশীপ পেতে পারে।

৬.   খুচরা ডিলারদের সার সংগ্রহ ও বিতরণ ব্যবস্থা কঠোরভাবে মনিটরিং করা এবং কোন অনিয়মের জন্য তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

৭.   খোলা বাজারে সারের খুচরা বিক্রয় ব্যবস্থা চালু করা যাতে কৃষক প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে হাতের কাছে সার পায়। তবে, পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থাও জোড়দার করা আবশ্যক।

৮.   সারের উৎপাদন ও আমদানি থেকে শুরু করে কৃষকের হাতে পৌছানো পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থা জোড়দার করা।

৯.   তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবিলায় সারের পর্যাপ্ত মজুদসহ প্রত্যেক জেলায় অন্ততঃ একটি করে বাফার গুদাম স্থাপন করা প্রয়োজন।

১০.  সারে দেয় ভর্তুকী সরাসরি কৃষকের হাতে পৌছানোর ব্যবস্থা করা এবং জৈব সারে ভর্তুকী দেওয়া।

১১.  কার্ড পদ্ধতি যেটা চালু করা হচ্ছে সেটি আরও সময় নিয়ে এবং সঠিকভাবে জরিপকার্য সমাধা করে নিয়ে তারপর করা।

পরিশেষে বলতে হয়, ডিলারদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন’-এর দৌরাত্ব ও সিন্ডিকেশন সার সংকট সমাধানের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। এদের দৌরাত্বের কারণে ডিলারের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিলার নিয়োগের একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও সরকার ব্যর্থ হয়। সরকারী প্রজ্ঞাপনে শর্ত ছিল ১. ডিলারকে ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। ২. ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিলারের গোদাম থাকতে হবে এবং সেই গোদামে সার সংরক্ষণ ও সেখান থেকে বিতরণ করতে হবে। এসব শর্ত কার্যকরভাবে পালিত হলে সার সংকট ও কৃষকদের হয়রানি অনেকটাই লাঘব হতে পারত। কিন্তু উচ্চ আদালতে মামলা করে এ আদেশ স্থগিত করে দেওয়া হয় এবং এতেই সরকার বিষয়টি চেপে যায়। অথচ সরকার পুরাতন প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন করে ডিলার নিয়োগ দিতে পারত। আসলে, সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং ঘুষ ও দুর্নীতিই এরূপ ব্যর্থতার জন্য প্রধানতঃ দায়ী। কাজেই, সারের চলমান সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাসহ একটি কৃষক-বান্ধব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং তার সফল বাস্তবায়ন।

শহীদুল ইসলাম 

কৃষিবিদ ও কৃষি উন্নয়ন গবেষক

shahid.bd1172@gmail.com

ফটোক্রেডিট: প্রথমআলো