আর নয় সোয়াবিন তেল, আসুন রান্নায় সরিষার তেল ফিরিয়ে আনি

আর নয় সোয়াবিন তেল, আসুন রান্নায় সরিষার তেল ফিরিয়ে আনি

সরিষার তেলের উপকারী উপাদানসমূহ:

সরিষার তেল প্রধানত মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড-এর বিশ্বস্ত উৎস যা স্বাস্থ্য তথা হার্টের জন্য খুবই ভালো। প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষার তেলে রয়েছে[1]:

  • ৫৯ গ্রাম মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড
  • ২১ গ্রাম পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড
  • ১১ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড

সরিষা তেলের উপকারিতা:

১. আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের জরিপ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের দিক থেকে সরিষার তেল অলিভ অয়েলের চেয়ে ভালো। এটি শুধু সুস্থ মানুষের জন্যই ভালো নয়, হৃদরোগীদের জন্যও ভালো।

২. আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন অনুসারে, সরিষার তেল হার্ট অ্যাটাক প্রায় ৭০% কমায়। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS) এবং সেন্ট জনস মেডিকেল কলেজ, ব্যাঙ্গালোর পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় এই ফলাফল নিশ্চিত করে।

৩. এই তেল রক্তের চর্বি কমাতেও সাহায্য করে – ‘ট্রাইগ্লিসারাইডস’ এবং রক্ত ​​জমাট বাঁধার প্রবণতা কমায়। এছাড়াও এর প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত, এটি হাঁপানি এবং আর্থ্রাইটিসের মতো অবস্থার চিকিৎসায় কার্যকর।

৪. সরিষার তেলে রান্না করা খাবার খাওয়া উচ্চ রক্তচাপে যারা ভুগছেন তাদের রক্তচাপ কমাতেও সাহায্য করতে পারে। সরিষার তেলের চর্বি হতাশাগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসায়ও সাহায্য করে। কারণ এটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়।[2]

৫. ফোর্টিস হার্ট অ্যান্ড ভাস্কুলার ইনস্টিটিউ-এর চেয়ারম্যান, প্রখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ টি.এস. ক্লার-এর মতে, অন্যান্য তেলের তুলনায় সরিষার তেলে কম পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং উচ্চ পরিমাণে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। মি. ক্লার আরও বলেন, সরিষার তেলে পাওয়া আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড রক্তের প্লেটলেটগুলির আঠালো-একত্রীকরণের প্রবণতা হ্রাস করে যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস করে। বেশ কিছু ক্লিনিকাল গবেষণায় দেখা গেছে যে সরিষার তেল হৃদরোগের জন্য সেরা।

৬. এশিয়ান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, সরিষার তেলের নিয়মিত ব্যবহার কম শরীরের ওজন বৃদ্ধি, কম ভিসারাল চর্বি জমে এবং উন্নত গ্লুকোজ এবং লিপিড হোমিওস্টেসিস হতে পারে।[3]

৭. নয়াদিল্লির ধর্মশিলা নারায়ণা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল-এর কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ অমরেন্দ্র কুমার পান্ডে, বলেন, সরিষার তেল ভাল কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, এর ব্যবহার করোনারি ঝুঁকি কমাতে পারে হৃদরোগ এবং সেইসাথে ওজন কমাতে সাহায্য করে।[4]

৮. ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (NCBI)- এর সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সরিষার তেলে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটের (যা স্বাস্থ্যকর চর্বি) পরিমাণ বেশি থাকায় শরীরে এলডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্টকে সুস্থ রাখে।

৯. এনসিবিআই-এর অপর একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সরিষার তেলে যে লিনোলিক এসিড থাকে তা একটি উপকারি ফ্যাটি এসিড ওমেগা-৩ যার এন্টিইনফ্ল্যামেটরি প্রপার্টিজ আছে যা আর্থ্রাইটিসজনিত জয়েন্টের ব্যাথায় ভোগা রোগিদের জন্য বিশেষ উপকারি।

সোয়াবিন তেলের আগ্রাসন ও স্বাস্থ্য ঝুকি

একসময় অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর বলে কার্যত মিথ্যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে এদেশে সোয়াবিন তেল প্রবর্তন করা হয়। কালক্রমে রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহারে এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে পায়ে দলে বিদেশি সোয়াবিন তেল রান্নাঘর থেকে সরিষার তেলকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অথচ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক নতুন গবেষণা দেখায় যে সয়াবিন তেল শুধুমাত্র স্থুলতা এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়না তা অটিজম, আলঝেইমার রোগ, উদ্বেগ এবং বিষন্নতার মতো স্নায়ুবিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করতে পারে।[5]

সরিষার বিরুদ্ধে এরূপ নেতিবাচক প্রচারনা চালিয়ে আমাদের সরিষা চাষী ও তেলজীবী (কুলু) সম্প্রদায়ের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে এদেশে সোয়াবিন তেল ডাম্পিং করে আমাদের ভোজ্যতেলের বাজার দখল করে নিয়েছে দেশি-বিদেশি মুনাফালোভী কোম্পানিগুলো যার ফলস্বরূপ এখন আমাদেরকে বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে উচ্চদামে সোয়াবিন তেল কিনে খেতে হচ্ছে।

 সরিষার তেলে ইরোসিক এসিড প্রসঙ্গ

একদা ইদুরের উপর পরিচালিত এক পরীক্ষার ভিত্তিতে ইরোসিক এসিড বেশি থাকার যুক্তি দেখিয়ে আমেরিকায় সরিষা তেল খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অথচ খোদ আমেরিকান বিভিন্ন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন গবেষক সাম্প্রতিক এক যৌথ গবেষণায় প্রমাণ করেন যে, উপরোক্ত গবেষণার এমন দাবীর সুস্পষ্ট কোন ভিত্তি নেই ।

সরিষা তেলে ঝাঁঝ হওয়ার কারণ হচ্ছে এতে ইরোসিক এসিড থাকে। এই ইরোসিক এসিড অল্পমাত্রায় উপকারী এবং অধিকমাত্রায় ক্ষতিকর বলে প্রচারিত হলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। তাছাড়া, আমরা যে পরিমাণ সরিষার তেল গ্রহণ করি তাতে সমস্যা হওয়ায় কথা নয়। রাধুনিদের মতে সরিষার তেল সোয়াবিন তেলের অর্ধেক পরিমাণে ব্যবহার করলেও রান্না সুস্বাদু হয়। কাজেই কম তেলে রান্নার অভ্যাস করলে যেমন নিরাপদ থাকা যায় তেমনি ব্যয় সাশ্রয়ও করা যায়।

ক্ষতিকর কৃত্রিম ঝাঝ থেকে সাবধান

বাজারে ভেজাল সরিষার তেলে সয়লাব যেখানে উৎপাদন পর্যায়ে রাসায়নিক সার ও বিষ দেওয়া হচ্ছে তাই নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিক কৃত্রিম ঝাঁঝ, কৃত্রিম রঞ্জক – এসবও মিশানো হচ্ছে।

ফলন অনেক কম বলে এখন আদি দেশি মাঘী সরিষা চাষ কৃষকেরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) কর্তৃক আবিষ্কৃত জাতগুলোই ব্যাপকভাবে চাষ করা হয় যেগুলোতে ঝাঁঝ সাধারণত একটু কম হয়। অবশ্য হলদে রংয়ের সরিষায় (যেমন: বারি-১৪, বারি-১৫, বারি-১৭ ইত্যাদির ফলন তেলের পরিমাণ ও ঝাঁঝ বেশি। কিন্তু দেশি সরিষার মত লালচে সরিষায় ঝাঁঝ একটু কম। অথচ বাজারে অধিক ঝাঁঝের সরিষাই বেশি পাওয়া যায় যেগুলো হয় হলদে রংয়ের উফশী সরিষা অথবা কৃত্রিম ঝাঁঝ মিশানো।

সরিষা তেলের দাম একটু বেশি হলেও সাশ্রয়ী

কারণ সরিষার তেল সয়াবিন তেলের অর্ধেক পরিমান ব্যবহার করতে হবে। এতে যে শুধু আপনার সাশ্রয় হবে তাই নয়, আপনার ইরোসিক এসিডও গ্রহণও কমবে যা অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। কাজেই দাম নিয়ে না ভেবে সরিষার তেল দিয়ে রান্না করুন।

বিশুদ্ধ সরিষার তেল পেতে যোগাযোগ করুন:

প্রকৃতি ফুড, ফোন: ০১৩১৯৭২০০২৯

#সরিষা #তেল #Mustard #oil

তথ্যসূত্র: 

[1]https://www.medicalnewstoday.com/articles/324686

[2]https://www.thedailystar.net/news-detail-144142

[3]https://timesofindia.indiatimes.com/life-style/food-news/mustard-oil-best-for-heart-study/photostory/81352651.cms?picid=81352683

[4]https://www.narayanahealth.org/blog/which-cooking-oil-is-the-best-for-indian-cooking/

[5]https://www.sciencedaily.com/releases/2020/01/200117080827.htm

বাণিজ্যিক কৃষিতে কি খেঁজুর গাছ টিকে থাকতে পারবে?

বাণিজ্যিক কৃষিতে কি খেঁজুর গাছ টিকে থাকতে পারবে?

শীতের সকালে খেজুরের টাটকা রস পান করা এবং খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস খাওয়া গ্রাম বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য। আগে খেজুর পাতা রোদে শুকিয়ে ঘরে ঘরে পাটি, মাদুর, ঝুড়ি, হাতব্যাগ এবং বিভিন্ন ধরনের কারুপণ্য বানানো হত যা বর্তমানে বিরল। এসব কারুপণ্য আগে হাটে-বাজারে প্রচুর বিক্রী হত এবং তা থেকে অনেকে জীবিকাও নির্বাহ করতেন যা আজ খুব একটা চোখে পড়েনা। খেজুর ফল হৃদরোগ, জ্বর ও পেটের পীড়ায় উপকারী এবং বলবর্ধক। ফলে প্রচুর লৌহ জাতীয় খনিজ উপাদান আছে।

খেজুরগাছ একটি প্রাকৃতিক গাছ যা লাগাতে হয়না। তাই হয়ত গ্রামে গেলে আমরা আমাদের চারপাশে কিছু খেজুর গাছ এখনো দেখতে পাই। আগে গ্রামে গ্রামে জমির আইলে, কিংবা উচু টিলা বা চালার মত স্থানে প্রচুর খেজুর গাছ জন্মাতো যা এখন আর ওভাবে দেখা যায়না। ইদানিং বজ্রপাত রোধে কিছু উপযোগিতা থাকায় তালগাছ লাগানোর কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও খেঁজুর গাছ লাগানোর কথা শুনিনি কখনো। আমাদের কৃষিভূমি যেভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং আমরা যে ধরণের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছি তাতে অদূর ভবিষ্যতে খেজুরগাছ এবং খেজুরগুড় এক দুষ্প্রাপ্য জিনিষ হয়ে উঠবে বলেই অনুমান করি। এমনকি বিলুপ্তও হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।

মুখে মুখে একটি ভয়ংকর পরিসংখ্যান প্রায়শই শোনা যায়। সেটি হলো শিল্পায়ন, নগরায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, গ্রামে বসতি স্থাপন এমন অনেক কাজে আমাদের ফসলি জমি ফিবছর প্রায় এক শতাংশ হারে কমছে। এই হার অব্যাহত থাকলে আগামি একশত বছরের মধ্যে দেশে কোন কৃষিজমি অবশিষ্ট থাকবে না। এই নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারক মহল যেমন চিন্তিত তেমনি চিন্তিত প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার ব্যাপারে। এখন চাষবাস মানে বাণিজ্যিক কৃষি। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে এই বাণিজ্যিক কৃষির আওতায় আনতে আমাদের হয়ত খুব বেশিদিন সময় লাগবে না। বাণিজ্যিক কৃষিতে কি খেঁজুর গাছ থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর অজানা হলেও আপাতদৃষ্টিতে থাকবেনা বলেই মনে হচ্ছে।

দেশের ষোল-সতের কোটি মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটাতে আমরা যতটা চিন্তিত আমাদের  প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও খাদ্য সংস্কৃতি রক্ষায় চিন্তা বা আগ্রহের প্রকাশ খুব বেশি দেখা যায়না। ফলস্বরূপ আমাদের প্রকৃতি থেকে প্রতিনিয়ত অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী ক্রমাগত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে যার মধ্যে অনেক মূল্যবান ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদও রয়েছে। খেজুর গাছের ক্ষেত্রে হয়ত এমন অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি কিন্তু এমন দিন যে খুব বেশি দূরে নয় সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয়না। কারণ, আমাদের খাদ্যাভ্যাস বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে জীবনধারা। আমরা পাশ্চাত্য জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের অন্ধ অনুকরণ করছি। আমরা এখন পলিশ করা সাদা চালের মত আমদানিকৃত সাদা চিনি এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের পাটকলের মত চিনিকলও একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আখচাষে দশমাস সময় লাগে এই যুক্তিতে আখচাষকে নিরূৎসাহিত করা হচ্ছে। তাছাড়া, হালে খেজুর রসে নিপা ভাইরাসের আমদানি ঘটেছে। শীতের সকালে তাজা খেজুর রস কিংবা খেঁজুর রসের ক্ষীর খাওয়ার অভ্যাস আমাদের শহুরে নতুন প্রজন্মের নেই বললেই চলে। নিপা ভাইরাসের ভয় ক্রমশঃ গ্রামেও সঞ্চারিত হয়ে কাঁচা খেঁজুর রসের চাহিদা অচিরেই নিঃশেষ হবে। তেমনি সাদা চিনির আগ্রাসনে খেঁজুর গুড়ও দুঃষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে একসময়।

আমাদের ছোটবেলায় ময়মনসিংহ অঞ্চলে আখের গুড় যা ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি হিসেবে খ্যাত এবং খেজুরের জ্বালানো রস (তরল গুড়) – এ দুটিই ছিল মিষ্টিজাতীয় খাদ্য তৈরির অত্যাবশ্যক উপকরণ। কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি এই গুড়ের প্রচলন সারাদেশেই ছিল। যশোর, নাটোর, রাজশাহী অঞ্চলের খেজুরের ঝোলা গুড় বা দানাগুড় এবং পাটালি গুড় এ দুটোর কদর ব্যাপক। পাটালি গুড়ের সংরক্ষণ ও পরিবহন সহজতর হওয়ায় তা সারাদেশেই সহজলভ্য ছিল। আজও এই গুড়ের চাহিদা থাকায় সর্বত্র ভেজাল গুড়ের দৌরাত্ম। সাদাচিনির আগ্রাসনের পাশাপাশি এ ধরণের ভেজাল আতঙ্ক খেজুর গুড়ের প্রতি দিনদিন মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে যা খেজুর গুড় বা গাছের বিলুপ্তির আশংকাকে বাড়িয়ে তুলছে।

খেজুর রস বা গুড় হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে এর সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ প্রক্রিয়া যার পুরোটাই কায়িক শ্রমনির্ভর। উচু গাছে উঠে নিয়মিত গাছ কাটা এবং খেজুর রস সংগ্রহ করা যেমন শ্রমসাধ্য তেমনি ভয়েরও ব্যাপারও বটে। বিশেষ দক্ষতা ও সাহস ছাড়া যে কারও পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত আগ্রহ বা শখের বশে কিংবা শ্রেফ জীবিকার টানে গ্রামে-গঞ্জে একটি শ্রমজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে যাদেরকে “গাছি” বলা হয়ে থাকে। আজকাল চাষাবাদের যান্ত্রিকীকরণের ফলে চাষের ক্ষেত্রে যেমন কায়িক শ্রমিকের সংখ্যা কমছে তেমনি আগামী দিনে এই গাছি শ্রেণি টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। কাজেই খেজুর রস আহরণের সহজ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর বিকল্প প্রযুক্তির উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি। পরিবর্তন দরকার গুড় তৈরির পদ্ধতিরও। অন্যথায় এই শিল্পের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন।

অন্যদিকে,আমরা যেহেতু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুকছি এবং খেজুরগাছ যেহেতু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অংশ নয় তাই এর বিলুপ্তির আশংকা প্রবল। আমরা ক্রমেই যেভাবে ফাস্টফুড, জাংক ফুড এবং চকচকে, মুখরোচক, পলিশ করা খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি তাতে এই আশংকা অমূলক নয়। তাছাড়া, বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের যুগে যার ব্যবসায়িক মূল্য নেই সেটাই টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে হারিয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট মহলের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে খেজুর গুড়ও হয়ত একদিন হারিয়ে যাবে।  কাজেই খেজুরগুড়সহ দেশের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য উপকরণগুলোর সংরক্ষণ ও প্রসারে জোড়ালো ভূমিকা গ্রহণ করা অতীব জরুরী। আমরা যদি খেজুরগুড় খাওয়ার অভ্যাসটা ধরে রাখি তবেই হয়ত টিকে থাকবে খেজুরগুড় এবং খেজুর গাছ। আসুন খেজুর গুড় খাই, টিকিয়ে রাখি খেজুর গাছ।

বাঙালির ফুটবল জ্বর

বাঙালির ফুটবল জ্বর

বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশ। আক্রান্ত গোটা বিশ্বও।  বিশ্বজুড়ে ফুটবলই একমাত্র খেলা যা সম্ভবত সকল দেশের মানুষকেই কমবেশি মাতিয়ে তুলে। বিশ্বকাপ ফুটবলকে তাই গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বলা হয়ে থাকে। ফুটবলের বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের কোন স্থান নেই, নেই এশিয়াতেও। সম্প্রতি দেশের অদম্য নারীরা সাফ ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়লেও পুরুষ দলের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসনটাও নড়বড়ে। তবুও ফুটবল নিয়ে আমাদের উৎসাহের কমতি নেই। কমতি নেই উত্তেজনা আর উন্মাদনারও যা কখনো কখনো মারামারি খুনোখুনি  পর্যন্ত গড়াতে দেখা যায়। উত্তেজনার চাপে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুবরনের কথাও শোনা যায় কখনো কখনো। মিডিয়ার খবর অনুসারে এবারের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে নানাভাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১২ জন, আহত হয়েছেন ২৭ জন। এটা সেমিফাইনাল পর্যন্ত খবর। আজ ফাইনালে দুই চিরপ্রদ্বিন্দ্বী একটি বিজয়ী হওয়ার পর এই সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না যা কোনক্রমেই কাম্য নয়! যাহোক, আর্জেন্টিনার ৩৬ বছর আর মেসির ২০ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাপ জয়ে দল আর্জেন্টিনা ও মেসিকে অভিনন্দন!

খেলা মানেই বিনোদন। সুস্থ জীবনের জন্য বিনোদন যেমন জরুরী তেমনি জরুরি খেলাধূলা বা শরীরচর্চা। আমরা যেমন খেলা দেখে মজা পাই, বিনোদিত হই তেমনি যারা মাঠে খেলে তারাও অপার আনন্দ লাভ করে যেমন আনন্দ লাভ করতাম আমরাও আমাদের শৈশবে। আমাদের শৈশবে গ্রামাঞ্চলে চামড়ার বল সহজলভ্য ছিলোনা। চামড়ার বল কিনতে  হলে দূর থানা বা জেলাসদরে যেতে হত যা ছোটদের জন্য সহজ ছিলোনা। কারণ, তখন যোগাযোগ সহজ ছিলোনা। পাঁচ-দশ কিলোমিটার হেটে বা সাইকেলে পাড়ি দিতে হত। তাই সেকালে আমাদের খেলা হত হাতে তৈরি বলে। শিমুল তুলা পলিথিনে মুড়িয়ে  তা পাটের রশি দিয়ে জালের মত করে বেঁধে আমরা সুন্দর আরামদায়ক বল বানিয়ে ফেলতাম। সে বল খেলতে মন্দ লাগতোনা। কাপড়ে মোড়ানো এমন বলেই নাকি মেরাডোনার পায়েখড়ি হয়েছিলো। আমদের খেলার মাঠ ছিলো মূলত ধান মাড়ানোর খোলা কিংবা ফসলের মাঠ। ধান কেটে নেওয়ার পর ধানক্ষেতে খালি পায়ে আমাদের খেলা চলত। বুট জুতা পড়ে খেলা হয়নি কখনো। আমাদের ছেলে এমদাদ হকের মত ব্যাথাপায়ে তখনকার ব্যাথানাশক মালিশ জামবাক মেখে হারিকেনের মাথায় কাপড় গরম করে ছ্যাক নেওয়া ছিল তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একটি গোল করার জন্য সেকি কসরত! খেলার মাঠের ব্যর্থতার আক্ষেপ প্রায়শই সফলতা রূপে স্বপ্নে এসে ধরা দিত। স্বপ্নে পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদোর মত সবাইকে কাটিয়ে গোল করার আনন্দ ছিলো অসাধারণ। কখনো কখনো গোলমুখে গিয়ে ঘুম ভেঙ্গে নিশ্চিত গোল মিস করা আক্ষেপটাও  নিতান্ত কম ছিলোনা।

তখন অবশ্য পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো কিংবা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার নামও আমাদের জানা ছিলোনা। পেলে ও ব্রাজিল  সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি “ফুটবলের রাজা” প্রবন্ধ থেকে ক্লাশ ফোর কি ফাইভের পাঠ্য বই থেকে। সেসময় ‍আমাদের জন্য বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার কোন সুযোগ ছিলোনা। ছিয়াশির বিশ্বকাপে যখন ম্যারাডোনা বিশ্ব মাতিয়েছিলেন তখনো হাতেগোনা কিছু টেলিভিশন এসেছিলো গ্রামের বাজার অবধি যেখানে সবে বিদ্যুৎ এসেছিল বলে। রাত জেগে সেই বিশ্বকাপ যারা দেখতেন তাদের মুখ থেকে শুনতাম ম্যারাডোনার গুনকীর্তন। সম্ভবত তখন থেকেই এদেশে আর্জেন্টিনার এতো সাপোর্টার সৃষ্টি হয়। ব্রাজিলের সমর্থক আগে থেকেই ছিলো আমার ধারণায় মূলত শহুরে ফুটবল বোদ্ধাদের মধ্যে। ব্রাজিলের সমর্থক বৃদ্ধিও ছিল প্রায় সমসাময়িককালে। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ১৯৯০ পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সাল অবধি ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ ফুটবল খেললেও নানান সমালোচনা, কেলেষ্কারির সাথে সাথে খেলার মানেও পড়ন্তবেলা নেমে এসেছিলো। ঠিক একই সময়ে রোনাল্ডো, রিভাল্ডো, রোনালদিনহু, কাকাদের মত তারকা ফুটবলারদের কয়েক বিশ্বকাপজুড়ে সফলতা-ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে ২০০২ সালে বিশ্বকাপ জয়ের ফলে সমর্থকগোষ্ঠী আরও বৃদ্ধি পায়। এসময় জার্মানী এবং ফান্সের সাফল্য ও শক্তিমত্তার কারণে এই দুই দলের বেশ একটা সমর্থকগোষ্ঠীও তৈরি হয় বিশেষ করে জার্মানির।

আমার বিশ্বকাপ খেলা দেখা শুরু মূলত নব্বইয়ের বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিল সমর্থক হিসেবে। এবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ব্রাজিলের বিদায় হওয়ার পর থেকে ফাইনাল অবধি সমর্থনের সেই আবেগ বা উচ্ছাস । তবুও খেলার মজার জন্য প্রতি ম্যাচে কোন না কোন দলের পক্ষে মৃদু হলেও সমর্থন ছিলই। আগে যখন বিশ্ব রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে অতটা ধারণা ছিলনা তখন সমর্থনের মূল মাপকাঠি ছিল ভালো দল, ভালো খেলা যেমনটা এখন আমার ছেলে করে। প্রায়শই ছেলের সমর্থন আমার বিপরীতে যায়। তাই আমি আমার মৌন সমর্থন প্রকাশ করতে চাইনা। ওর চাপাচাপিতে যখন তা প্রকাশ করতে হয় তখন সে একটু দমে যায়, উৎসাহে ভাটা পড়ে। যদিও আমি সমর্থন পরিবর্তন না করতেই তাকে উৎসাহিত করি। কারণ, তার জন্য জেতাটাই আনন্দের বিষয়। অবশ্য খেলার ক্ষেত্রে এমনটাই হওয়া উচিত – শ্রেফ বিনোদনের উপলক্ষ।

কিন্তু আমাদের দেশে ফুটবল মানে শ্রেফ বিনোদনের চেয়েও বেশি কিছু। কার্যত আমরা এক ফুটবলপ্রেমি জাতি। শুধু প্রেমিক বললে ভুল হবে। বরং পাগল প্রেমিক বলাই শ্রেয়। এমন একটা জাতি ফুটবলে কেন এতটা পশ্চাদপদ সেটাই বিপুল বিষ্ময়। ছোটবেলায় আমাদের ফুটবল উন্মাদনা ছিল আবাহনী-মোহামেডানকে ঘিরে। বর্তমান প্রজন্ম সম্ভবত এখন দেশের ক্লাবগুলোর খেলাই দেখেনা। মাঠের অভাবে খেলারও সুযোগ পায়না। আমরা জনক-জননীরাও ওদের পড়াশোনার প্রতি যতটা যত্নবান খেলাধূলার প্রতি ততটাই উদাসীন। অথচ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা ভিনদেশি কোন দলকে পাগলের মত করে সাপোর্ট করা থেকে বুঝা যায় যে আমরা কতটা উন্মত্তভাবে ফুটবলপ্রেমি। এই প্রেমটাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব আসরে না হউক, এশিয়ায় কিংবা অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা আমাদের অবস্থানটা সংহত করতেই পারি।

নারী ফুটবলাররা এক্ষেত্রে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ওদের অগ্রগামী হওয়ার গল্পটা পেলে-মেরাডোনা-মেসি-নেইমার-এন্টোনিদের গল্পের মতই। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বস্তি থেকে অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশ্ব আসরে জায়গা করে নেওয়া এসব তারকারা এদেশের রাস্তায়-বস্তিতে বেড়ে উঠা অসংখ্য শিশুদের আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। বাফুফে এদেরকে নিয়ে কাজ করলে অনেক বেশি সাফল্য আসতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

#fifa_world_cup_Qatar_2022 #Messi #Neymer #Maradona

পারিবারিক কৃষি এবং পটেটো হলিডের গল্প

পারিবারিক কৃষি এবং পটেটো হলিডের গল্প

সাতসকালে বাচ্চা বয়সী ছেলেমেয়েসহ এক কর্ষণজীবী নেমেছেন জমি কর্ষণে। ভূট্টার বীজ ফেলে তিন বছর বয়সী ছেলেকে মইয়ে বসিয়ে জমি সমান করছিলেন তিনি। চলতিপথে তাঁদের দেখে শৈশব স্মৃতি জাগরিত হলো। বাইক থামিয়ে ছবি তুললাম। কাজ থামিয়ে উনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে এই কৃষকের জীবনের গল্পটা ইচ্ছে থাকলেও শোনা হয়নি। চলতি পথে আমারও সময়ের অভাব ছিল। অবশ্য সেটা যে খুব দরকারি ছিল তাও নয়। কারণ, কৃষক পরিবারের গল্পগুলো প্রায় এক এবং অভিন্ন। কৃষক পরিবারের সন্তান, কৃষিবিজ্ঞানের ছাত্র এবং প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে কৃষকদের সাথে কাজ করার সুবাধে এমন শতশত গল্প জানা। ছেলেটার স্কুলে যাবার বয়স হয়নি এখনও তাই জিজ্ঞেসও করা হয়নি। মেয়েটার বয়স দশ কী এগার হবে। তাই শুধু জানতে চাইলাম মেয়েটা স্কুলে যায় কিনা। উত্তরে হ্যা সূচক জবাব দিলেও অনুমান করতে কষ্ট হয়না যে পড়াশুনা খুব বেশিদূর এগুবেনা। এক কমিউনিটি ‍মিটিং-এ নারী শিক্ষার ব্যাপারে জানতে চাইলে অনেকে হতাশাভরে বলেছিলেন, “লেখাপড়া শিখিয়ে কি লাভ হবে, গরীবের চাকরি হয়না কারণ ঘুষ দিতে পারেনা”। বলাবাহুল্য, বাল্যবিবাহ রোধে গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় অনেক সাফল্য এলেও এই প্রকট সমস্যাটা সমাজ থেকে দূরীভূত হওয়া দূরে থাকুক করোনার কারণে আরও পশ্চাতপদ হয়েছে।

আমার সঙ্গী ছিলেন ড. ভল্কার কাশ নামের একজন জার্মান ভদ্রলোক। বয়স বাহাত্তর। উনার জন্ম জার্মানির এক কৃষক পরিবারে। অটো থামিয়ে আমাকে নামতে দেখে উনিও নেমে এলেন। আগ্রহভরে দেখলেন এবং উনার বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। উনার শৈশবের স্মৃতি প্রায় সত্তর বছরের পুরনো যখন সবুজ বিপ্লবের সূচনাকাল চলছে। উনার কথা থেকে জানা গেলো যে সেসময় জার্মানির পারিবারিক কৃষিও প্রায় আমাদের এখনকার কৃষির মতই ছিল। সেসময় পারিবারিক কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ছোয়া সবে লাগতে শুরু করেছে। উনিও কিভাবে শৈশবে পারিবারিক কৃষির সাথে যুক্ত ছিলেন সেসব স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন। আমিও চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর আগেকার শৈশবে ফিরে গেলাম যখন ধান, পাট, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, পাকা মরিচ, সরিষা, শাকসব্জীসহ নানান ফসল মাড়াই করার কাজে আমিও মনের আনন্দেই যুক্ত হতাম। মইয়ে চড়া, ধান মলন দেওয়া – এগুলো ছিল খুব মজার কাজ। শখ করে কয়েকবার গরুর লাঙ্গল চালানোর দীক্ষাও নিতে চেয়েছি। কিন্তু এর জন্য একটু বেশিই কসরত প্রয়োজন ছিলো বিধায় বেশিদূর এগুনো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্র‍্যাক্টিক্যাল ক্লাশে অবশ্য ট্রাক্টর চালানো শিখতে হয়েছিলো। আমাদের পারিবারিক কৃষিটা এমনই ছিল যা এখনো অনেকটাই বিরাজমান। কিন্তু ড. কাশের ছোটবেলার পারিবারিক কৃষি আর এখনকার পারিবারিক কৃষির মধ্যে বিস্তর ফারাক।

উল্লেখ্য যে, এই মূহুর্তে বিশ্বে জাতিসংঘ ঘোষিত পারিবারিক-কৃষি-দশক চলছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৯-২০২৮ সাল পর্যন্ত পারিবারিক কৃষি দশক ঘোষনা করেছে যার লক্ষ্য হল একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে পারিবারিক কৃষক হওয়ার অর্থ কী তা নিয়ে নতুন করে আলোকপাত করা এবং ক্ষুধা নির্মূলে এবং ভবিষ্যত খাদ্য ব্যবস্থার রূপায়নে পারিবারিক কৃষি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আগের চেয়ে বেশি করে তুলে ধরা। এফএওর মতে পারিবারিক কৃষি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জীবিকার উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় টেকসই উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। পারিবারিক কৃষকগণ তাঁদের প্রজ্ঞা এবং পৃথিবীর মাটি ও প্রকৃতির প্রতি আন্তরিক যত্নশীলতার মাধ্যমে আমাদের কৃষির ইতিবাচক রূপান্তরের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন যা আমাদের ক্ষুধামুক্তি, আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিস্থাপক পৃথিবী বিনির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

যাহোক, এই দৃশ্য দেখার পর ড. ভল্কার কাশের কাছে প্রশ্ন রাখলাম যে তিনি এটাকে শিশুশ্রম হিসেবে দেখেন কিনা। উত্তরে তিনি একটা মজার বিশ্লেষণ দিলেন যা আমার খুবই পছন্দ হলো। তিনি বললেন, “দেখো এটা এক অর্থে শিশু শ্রম বটে তবে এটাকে তুমি একজন পিতার শিশু দেখাশুনার কাজ হিসেবেও দেখতে পার। তুমি ভেবে দেখ যে, এসময় এই শিশুটির দেখাশুনার জন্য একজন লোক লাগত। হয়ত ওর মাকেই তা করতে হত। কিন্তু এখানে মইয়ের উপর বসে থেকে সে বেশ মজাই পাচ্ছে। আর এই মজার মাধ্যমে প্রকারান্তরে সে তার পিতার কাজে সাহায্যও করছে যা এক ধরণের উইন-উইন সিচুয়েশন”।

বিশ্লেষণটা চমৎকার লাগলো। ঠিকইতো। প্রথমে এটাকে আমার কাছে অমানবিক শিশুশ্রম বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ভল্কারের কথায় চিন্তার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। মন পড়ে ছোটবেলায় আমরা কৃষক পরিবারে যে কাজগুলো করতাম সেগুলো বেশ মজা করেই করতাম। করতে না বললেও স্বেচ্ছায় করতাম। একদিকে একঘেয়ে মুখস্ত বিদ্যা গলাধকরণের মত অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক কাজ (যা এখন আমাদের শিশুদের একমাত্র করণীয়) থেকে মুক্তি আর অন্যদিকে, মাটি আর প্রকৃতির সাথে ফসলের মাঠে কাজ করার আনন্দ – মূলত এই দুই কারণে অনেকসময় অনাহুত হয়েও শ্রেফ মনের আনন্দে কাজে যোগ দিতাম। এখন আমরা জানি প্রতিদিন শারিরীক শ্রম সুস্বাস্থ্যের জন্য কতটা জরুরী। ইদানিং বয়ষ্ক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ কিংবা ডায়াবেটিস রোগীরা যেমন নিষ্ফল হন্টন কিংবা শারিরীক পরিশ্রমের কসরত করেন তা না করে বাল্যকাল থেকে উৎপাদনশীল শারীরিক শ্রমের অভ্যাস করাগেলে গেলে দেহ ও মন উভয়ের ক্ষুধাই মেটানো অনেকাংশেই সম্ভব।

ঠিক এই কাজটাই মাটি এনজিওর ইকো-স্কুলে শিশুদের শেখানোর এবং চর্চায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রেও শিশু-কিশোর-যুবকদের নিয়ে আদর্শ গ্রাম বিনির্মানে ঠিক এই চিন্তাটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। স্কুল পর্যায়ে পুষ্টি বাগান করার কাজে ছাত্রছাত্রীদেরকে যুক্ত করার মাধ্যমে এই কাজটি সহজেই করা যায়। পাশাপাশি, গ্রাম পর্যায়ে বসতভিটায় সব্জি, ফল ও ফুলবাগান এবং শহর পর্যায়ে ছাদবাগান কিংবা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের খোলা জায়গায় পুষ্টিবাগান করা এবং বৃক্ষরোপন ছেলেমেয়েদের পাঠ্যক্রমের অংশ করা এবং তা একাডেমিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে এই জরুরী চিন্তার সফল বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

যাহোক, জার্মানির পটেটো হলিডের গল্পটা বলে এ লেখার ইতি টানা যাক। ড. ভল্কার কাশের বাল্যকালে জমি থেকে গোলআলু তোলার কাজে পরিবারকে সহায়তা করতে এক সপ্তাহের মৌসুমী ছুটি দেওয়া হত যা “পটেটো হলিডে” নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শহর-গ্রাম সকল স্কুলই এসময় বন্ধ থাকত। সব শিশুরাই যে আলু তোলার কাজ করত এমন নয়, অন্য কাজও করত। মূলত তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই ছুটি চালু হয়েছিল। প্রথমত শ্রমিক সংকটের সেকালে কৃষকদের কাজে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে শিশুদেরকে উৎসাহিত করা। এবং তৃতীয়ত প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে কর্মক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করা। কৃষির রূপান্তর এবং যান্ত্রিকীকরণের কারণে পটেটো হলিডের উপযোগিতা এখন আর না থাকলেও ছুটিটা এখনও বহাল আছে।  পরিকল্পিতভাবে শৈশব থেকে শিশুদেরকে কৃষির উপযুক্ত কাজগুলোর সাথে আমাদের শিশুদেরকে যুক্ত করার মাধ্যমে শুধু ‍শিশুদেরই নয় দেশেরও বহুমূখী কল্যাণ সাধিত হতে পারে।

#family #farming

#পারিবারিক #কৃষি