বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের কৃষি

বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের কৃষি

ভূমিকা

বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র কৃষিপ্রধান দেশ। হিমালয়ের পাদদেশে নদীবিধৌত পলিমাটি দিয়ে গঠিত কৃষি উপযোগী উর্বর জমি ও জলবায়ু নিয়ে এই ভূখন্ড গঠিত। একসময় এ দেশের কৃষকের ঘরে ঘরে ছিল গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু। “মাছে-ভাতে বাঙালী” একটি সর্বজনবিদিত প্রবাদ। এ দেশের ইতিহাস স্বনির্ভর কৃষি ও জুম চাষের এক সফল ইতিহাস। স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল ছিল এ দেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা। কৃষক ছিল স্বনির্ভর। কেবলমাত্র কেরোসিন ও লবণ জাতীয় দ্রব্য ছাড়া জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কোন দ্রব্যের জন্য তাঁদেরকে পরমুখাপেক্ষি হতে হত না। খাঁটি সোনার চেয়েও খাটি ছিল এ দেশের মাটি। সহজে ও অল্প পরিশ্রমেই জমিতে ফসল ফলাতো এ দেশের কৃষক।

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বাহিত পলিমাটিতে কৃষি উৎপাদন সহজ ছিল বিধায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ জীবনধারণের জন্য বাংলায় এসে স্থায়িভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করে। যার ফলে, ভারতের অন্যান্য অংশের চেয়ে এ অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল সব সময় বেশি। বাংলার সমৃদ্ধির যুগে কৃষকরা শুধু খাদ্যই উৎপাদন করত না, তারা নিজেদের ও স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য কৃষি উপকরণাদি, কৃষি ভিত্তিক শিল্পজাত দ্রব্য এবং ভোগ্যপণ্যও উৎপাদন করত। এ দেশের বস্ত্র শিল্প ও মসলিন ছিল পৃথিবীবিখ্যাত। তা ছাড়া, কামার, কুমার, তাতী, ছুতারসহ নানা পেশার মানুষ মিলে গ্রামে-গঞ্জে গড়ে তুলেছিল নানা ধরণের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। এই ভূখন্ডের অঢেল সম্পদের লোভে এবং এ দেশের মানুষের সরলতা, বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রে বিভক্তি এবং অসংগঠিত অবস্থার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তুর্কী, মোঘল, পাঠান, পর্তুগীজ, মারাঠী, ওলন্দাজ, ফরাসী এবং ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ দেশে এসে কায়েম করে জুলুম, নির্যাতন, শোষণ ও লুটপাটের রাজত্ব। আর তখন থেকেই এ দেশের কৃষকের ভাগ্যে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। এর পর থেকে এ দেশের কৃষকের ইতিহাস শোষণ ও বঞ্চণার এক করুণ ইতিহাস।

আজও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক জনগোষ্ঠী নানাবিধ সংকটে আকন্ঠ নিমজ্জিত। দেশের বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটানোর দায়ভার কৃষকের কাধে চাপিয়ে দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর নামে এমন এক কৃষি ব্যবস্থার বেড়াজালে কৃষককে ধীরে ধীরে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যেখান থেকে বেরুনোর আর কোন পথই যেন খোলা নেই। গত কয়েক দশক ধরে ফসলের প্রধানত দানাশস্যের ফলন বাড়াতে গিয়ে দেশীয় কৃষি উপকরণনির্ভর স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং ব্যবহারের দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে ক্রমবর্ধমান হারে সেচ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক এবং অন্যান্য বাজারনির্ভর এবং আমদানিনির্ভর কৃষি উপকরণের ব্যবহারকে ঢালাওভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে, একদিকে যেমন ফসলের উৎপাদন ব্যয় এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে অন্যদিকে তেমনি মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, ফসল চাষের ঝুঁকি বৃদ্ধি, সেচ সংকট, সার সংকট, বীজ সংকট, ভেজাল বীজ-সার-বালাইনাশক এবং জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সংকট ও সমস্যায় কৃষক আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া মানবস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যও আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। সর্বোপরি ধ্বংস হচ্ছে এ দেশের হাজার বছরের স্বনির্ভর, সমন্বিত ও স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা।

একথা সত্য যে, বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় দানাদার শস্যের উৎপাদন অনেকগুণ বেড়েছে কিন্তু তার সুফল কৃষকের ঘরে উঠছেনা। মুক্ত বাজারের কারসাজিতে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রী করে দিতে হচ্ছে। এভাবে ভর্তুকী দিয়ে, নিজে না খেয়ে কৃষক এ জাতির মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান হারে  রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক প্রয়োগ করা সত্ত্বেও গত প্রায় দুই দশক ধরে দেশের প্রধান শস্য ধান ও অন্যান্য শস্যের ফলনে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ, একই সময়ে সেচ, বালাইনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। ধানের উৎপাদন আমাদের চাহিদা অনেকাংশে মেটাতে সক্ষম হলেও ডাল, তেল, মশলা ও ফল উৎপাদনে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে যা প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করতে হচ্ছে। তা ছাড়া, অধিক ফলনের আশায় এ ধরণের চাষাবাদের ফলে আমাদের বীজের নিয়ন্ত্রণ তথা খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে দেশী-বিদেশী কোম্পানির হাতে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ফেলে দিবে।

কৃষি এখনও এ দেশের গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা। দেশের জাতীয় আয়ের প্রায় এক পঞ্চমাংশের উৎস হল কৃষি। শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি মানুষ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্ত এ দেশের কৃষির সেই সমৃদ্ধ অতীত ঐতিহ্য আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। বদলে গেছে কৃষকের গোলা ও গোয়ালের মালিকানা। অধুনা বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন ও বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যিক আগ্রাসনের কবলে পড়ে এ দেশের কৃষি ও কৃষক অতিক্রম করছে এক কঠিন ক্রান্তিকাল। আগামী দিনগুলো হবে আরও আধার ঘেরা, আরও ভয়ংকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বৃটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী এ দেশ থেকে বিতাড়িত হলেও নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরূপী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বিশাল বাজার দখলের লক্ষ্যে আজ এক ভয়াবহ নীল-নকশা বাস্তবায়নের পথে সাফল্যের সাথেই এগিয়ে চলেছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বিশাল বাজার দখলের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গঠন করা হয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষিচুক্তি ও ট্রিপস চুক্তির সহায়তায় এ দেশের কৃষিপণ্য ও স্থানীয় প্রযুক্তির বাজারকে ধ্বংস করে দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের কৃষিপণ্য এবং প্রযুক্তির একচেটিয়া বাজার প্রতিষ্ঠার সবরকম ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করছে। এতে যে শুধু এ দেশের কৃষি ও কৃষকই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাই নয়, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও আজ হুমকির মুখে পড়ছে। কারণ, দেশের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দাতা দেশ ও সংস্থাসমূহের নগ্ন হস্তক্ষেপ আজ সর্বজনবিদিত।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ দেশের কৃষি, কৃষক এবং সর্বোপরি দেশের এরূপ সংকট মোকাবিলায় স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলোর ভূমিকা ও উদ্যোগ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। স্বাধীনতার পূর্বে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী এ দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নকে স্বাভাবিকভাবেই অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পরও আজ পর্যন্ত এ দেশের কোন সরকারই সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের (যারা মোট কৃষক জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৮৭ ভাগ) স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর কোন ভূমিকা রাখে নি। যে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের আপামর গণমানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করেছিল, সে মুক্তি আজও সুদুর পরাহত। স্বাধীনতার পর বহুল আকাংখিত ভূমি সংস্কারে কোন সরকারই কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন ভুমি সংস্কারের একটি খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করে এবং তা বিবেচনার জন্য তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদে পেশ করে যা গ্রহণ করা হয় নি। তা ছাড়া, এ সুপারিশমালায় ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের উন্নয়নের জন্য সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, তাও বিবেচনা করা হয় নি।

পক্ষান্তরে, স্বাধীনতাত্তোরকালের সরকারগুলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপের মুখে অথবা কায়েমি স্বার্থে যে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে তা কার্যত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে কৃষি থেকে বিতারণের পথকেই সুগম করেছে। এরূপ কাঠামোগত সংস্কার কৃষিতে দেশী-বিদেশী কর্পোরেশনের অবাধ বাণিজ্যের দ্বার অবারিত করেছে। আর এ দেশের পিছিয়েপড়া কৃষক জনগোষ্ঠী দিন দিন বাজারের দাসে পরিণত হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অসম বাণিজ্যের বেড়াজালে কৃষক সমাজ আজ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অথচ বাণিজ্য উদারিকরণের নামে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক আগ্রাসনের নির্মম শিকারে পরিণত হলেও এ দেশের কৃষকদের মধ্যে তার স্বরূপ উপলব্ধি করার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য ও জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়ে গেছে।

এমতাবস্থায়, এই কঠিন সংকট মোকাবিলা করতে হলে এ দেশের কৃষকদেরকেই উঠে দাঁড়াতে হবে। কারো মুখাপেক্ষি না হয়ে দলমত নির্বিশেষে কৃষকদেরকেই একমঞ্চে এসে দাঁড়াতে হবে এবং বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে এক স্বনির্ভর ও স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা। খাদ্য ও কৃষির উপর বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যিক আগ্রাসন মোকাবিলা এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। ক্ষতিকর রাসায়নিক সার, বালাইনাশক এবং ব্যয়বহুল কৃষি প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ কমিয়ে এনে স্থানীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এবং শস্য, মৎস্য, প্রাণিসম্পদসহ কৃষির সমস্ত খাতগুলোকে সমন্বিত করে একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের রয়েছে প্রচুর সুযোগ ও সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সকলের সর্বোপরি নীতিনির্ধারক মহলের সুদৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা। এই গ্রন্থে এসব সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে যা নীতি নির্ধারক মহল, গবেষক, কৃষি উন্নয়ন কর্মী এবং সংশ্লিষ্ট সকলের কাজে লাগবে বলে আশা করি।

#বাণিজ্যিক #বিশ্বায়ন #কৃষি #ক্ষুদ্র কৃষক

নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার উপর খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব

নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার উপর খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব

বাংলাদেশে অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি একটি প্রকট এবং অনেকটা সমাধানহীন সমস্যা হিসেবে যুগের পর যুগ বিরাজমান। অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন-আয়ের দরিদ্র মানুষের দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক অবস্থা তথা বর্তমান কল্যাণ এবং ভবিষ্যত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে মারাত্মক অন্তরায়। মূল্যবৃদ্ধির ফলে দরিদ্র মানুষের প্রকৃত ব্যয়যোগ্য আয় এবং ব্যয় করার সক্ষমতা দুটোই ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় তা শুধু দারিদ্র বৃদ্ধি বা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেনা বরং মানুষের প্রায় সকল মৌলিক অধিকারের উপভোগক করাকে বাধাগ্রস্ত করে।

নিম্ন-আয়ের মানুষের দারিদ্র এবং খাদ্য ও পুষ্টি অধিকারের ওপর খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির এরূপ প্রভাব নিরূপণসহ খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ এবং সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে দেখার উদ্দেশ্যে ‘খানি বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দেশের ১৯টি জেলার ২৪ ধরণের নিম্ন-আয়ের পেশার প্রতিনিধিত্বকারী ৪৩৮ জন মানুষের ওপর জনপ্রিয় অনলাইন জরিপ টুলস ’সার্ভে মানকি’ ব্যবহার করে একটি জরিপ পরিচালিত হয়।

পেশাগুলো হলো- কৃষক, ঝুমচাষি, জেলে, কামার, কুমার, সুতার, মুচি, নাপিত, সুইপার, গৃহকর্মী, চা-বিক্রেতা, দর্জি, কৃষিশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, পরিবহণশ্রমিক, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, হকার, ভ্যানচালক, রিকশাচালক, অটোচালক, গাড়ীর ড্রাইভার, মেকানিক এবং হোটেলবয়।

উল্লেখ্য যে, ১৯ টি জেলায় ১৯ জন স্বেচ্ছাসেবক অনলাইন সার্ভে ফরম পুরণে উওরদাতাদেরকে সরেজমিনে সহায়তা করার মাধ্যমে জরিপকার্য সম্পন্ন করেছেন। তাছাড়া, গবেষক কর্তৃক দেশের খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি, কারণ এবং প্রতিকার নির্ণয়ে বেশকিছু সরকারি জরিপ, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগসমূহের অনলাইন ও অফলাইন প্রকাশনা এবং গবেষণাপত্রও পর্যালোচনা করা হয়েছে।

আরও উল্লেখ্য যে, কাকতালীয়ভাবে গবেষণার সময়টা ছিল করোনা মহামারীর কাল যখন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে চরম অর্থনৈতিক স্থবিরতা বিরাজমান ছিল এবং যার বিরূপ প্রভাব নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে। পাশাপাশি, উক্ত সময়ে চাল-ডাল-পেঁয়াজ ও শাক-সব্জিসহ অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যেরও আকাশচুম্বি মূল্য লক্ষ্য করা গেছে। কাজেই, নিম্ন-আয়ের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র এবং খাদ্য ও পুষ্টি অধিকারের ওপর খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সম্যক উপলব্দি করার ক্ষেত্রে এই গবেষণাকর্মটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমাদের বিশ্বাস।

জরীপ তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২৪% পরিবারের মাসিক আয় ৩,০০০টাকার কম যেখানে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার আগে মাত্র ৪% পরিবারের মাসিক আয় ৩,০০০টাকার কম ছিল। অন্যদিকে, গবেষণাকালে মাত্র ১% পরিবারের মাসিক আয় ১০,০০০টাকার বেশি ছিল যেখানে করোনার আগে ২৭% পরিবারের মাসিক আয় ছিল ১০,০০০টাকার বেশি ছিল। গবেষণাকালে বাকী ৬৯% পরিবারের মাসিক আয় ৩,০০০-১০,০০০ টাকার মধ্যে ছিল যা ২০১৬ সালে পরিচালিত ’খানা আয় ও ব্যয় জরীপ’ অনুসারে গড় জাতীয় আয় (১৫,৯৮৮ টাকা)-এর চেয়ে বেশ কম।

অন্যদিকে, আয় অনেক কমে গেলেও জরীপের উত্তরদাতাদের মতে ২০২০-এর মধ্যভাগের পর থেকেই বেশিরভাগ খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক বাড়তে থাকে। জরীপের ৮৬%, ৯৪%, ৯১% এবং ৮১% উত্তরদাতার মতে জরীপকালের তিনমাস আগের সময়টাতে যথাক্রমে চাল, পেঁয়াজ, আলু এবং শাকসব্জির মত অত্যাবশ্যক এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যগুলোর দাম ছিলো তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অন্যদিকে, শতকরা ৬২% উত্তরদাতার মতে উক্ত সময়ে ডালজাতীয় খাদ্য যেমন: মসুর, খেসারী এবং ৫৫% উত্তরদাতার মতে প্রোটিনজাতীয় খাদ্য যেমন: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি খাদ্যগুলোর দামও তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এমতাবস্থায়, পরিবারগুলোর মধ্যে মাত্র ৫% তাদের খাদ্য ক্রয়ের আগের পরিমাণ ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবং বাকী ৯৫% পরিবারকে হয় ’কম’ পরিমাণে (৩২% উত্তরদাতা) অথবা ’অনেক কম’ পরিমাণে (৬৩% উত্তরদাতা) খাদ্যদ্রব্য কিনতে বাধ্য হতে হয়েছে।

মূল্য বৃদ্ধির ফলে শুধু যে খাদ্য কম কিনতে হয়েছে তাই নয়, ৯৯% উত্তরদাতার মতে তাদেরকে ’প্রায়শই’ (৬৫% উত্তরদাতা) অথবা ’কখনো কখনো’ (৩৪% উত্তরদাতা) অন্যান্য মৌলিক চাহিদা বাবদ ব্যয় কমিয়ে খাদ্যদ্রব্য কিনতে হয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭৭% পরিবারকে কাপড়বাবদ ব্যয়, ৫৬% পরিবারকে চিকিৎসা ব্যয়, ৪০% পরিবারকে শিক্ষা ব্যয় এবং ৭৩% পরিবারকে অন্যান্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হতে হয়েছে।

খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে শুধু খাদ্য এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদার ব্যয় কমানোতেই মানুষগুলোর দুর্ভোগের শেষ হয়নি বরং বর্ধিত আর্থিক চাহিদা মেটাতে তাদেরকে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা কিংবা মহাজন থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে সেই ব্যয় মেটাতে হয়েছে। সার্ভে থেকে দেখা যায় যে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ৫২% পরিবার ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে যার গড় পরিমাণ ছিল ২২,০৭৬ টাকা এবং ঋণের পরিমাণের ব্যাপ্তি ছিল সর্বনিম্ন ৩৫,০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০,০০০টাকা।

জরীপ তথ্য অনুসারে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবারগুলোর দৈনিক খাদ্যগ্রহণের পরিমাণও তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে যায়। খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির আগে যেখানে ৯৩% পরিবার দিনে তিনবেলা খেতে পারতেন মূল্য বৃদ্ধির পর তা ৬০%-এ নেমে আসে। পক্ষান্তরে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির আগে মাত্র ৫% পরিবার দিনে দুইবার খাদ্য গ্রহণ করত যা খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে বেড়ে ৪০%-এ উন্নীত হয়। জরীপ তথ্য থেকে আরও দেখা যায় যে, প্রায় ৩৫% পরিবারকে ’মাঝেমধ্যেই’ না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে যেখানে ২০% পরিবারকে ‘প্রায়শই’ না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে।

দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্যদ্রব্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কর্তৃক পরিচালিত ’খোলাবাজারে বিক্রয়’ বা ’ওএমএস’ কার্যক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বা অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু জরীপ থেকে হতাশাজনকভাবে দেখা যায় যে, উত্তরদাতা পরিবারগুলোর মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগই অনেক খাদ্যসংকটে থাকা সত্ত্বেও সার্ভেকালীন সময়ের পূর্ববর্তী মাসে কার্যক্রম চালু থাকা সত্ত্বেও ওএমএস থেকে কোন খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারেনি যা এই কার্যক্রমের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ওএমএস থেকে খাদ্যদ্রব্য না কেনার কারণ হিসেবে এক-চতুর্থাংশ উত্তরদাতাই জানান যে, কোথায় এবং কখন খোলাবাজারে চাল বিক্রী হয় তাই তাদের অজানা থেকে যায়। তাছাড়া, তারা জনতে পারলেও বিক্রয়কেন্দ্রগুলো অনেক দূরে থাকে, ফলে সময় এবং টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে লম্বা লাইনে দাড়িয়ে প্রায় গোটা দিন ব্যয় করে খাদ্য কিনতে হয় যা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর জন্য খুবই কঠিন। উপরন্তু বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় অনেক সময় তাদেরকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হয় এবং খাদ্যের মান নিয়েও তাদের অভিযোগ রয়েছে।

সার্ভে এবং বিভিন্ন গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ এবং গবেষকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অনুসারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়া; মধ্যস্বত্বভোগী খাদ্য ব্যবসায়িদের কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করা; বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠানিক দূর্বলতা ও ব্যর্থতা; দুর্ণীতি এবং কায়েমি স্বার্থ; খাদ্য দাহিদা ও যোগানের নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে সঠিক উৎপাদন ও আমদানি পরিকল্পনার অভাব; ভোক্তা কর্তৃক আতঙ্কিত ক্রয় ইত্যাদি।

একটি জাতীয় ”দাম কমিশন” গঠন করা, টিসিবি-কে আরও দক্ষ ও কার্যকরী করা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং আমদানী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, মধ্যস্বত্বভোগী ও অবৈধ মজুদদারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় শক্তিশালীকরণসহ নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিনিয়ত খাদ্য সংকটে ভোক্তভোগী মানুষগুলো এরূপ খাদ্য সংকটকে তাদের নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে। সংখ্যায় অত্যন্ত কম হলেও ২% উত্তরদাতা মনে করে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছুই করার নেই এবং ১৯% উত্তরদতার মতে সরকারের করনীয় সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। এই তথ্য প্রমাণ করে যে, এখনও অনেক মানুষ খাদ্যকে তাদের অধিকার হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত নয়। যার ফলে, সকল সরকারও এমন একটি অতীব জরুরী বিষয়কে দায়সারাভাবে মোকাবিলা করে থাকে। এর প্রধান কারণ হিসেবে দেশে একটি ”খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার আইন”-এর অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করা যায় যা কিনা রাষ্ট্রের সকল নাগরিক বিশেষ করে দরিদ্র নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে খাদ্য ও পুষ্টির অধিকারকে গ্রাহ্য করা, সুরক্ষা দেওয়া এবং সর্বোপরি পূরণ করার আইনি বাধ্যবাধকতা দিবে।

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মানদন্ডে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিওএফপি ২০২০) তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং প্রায় ১.১ কোটি মানুষ তীব্র ক্ষুধা নিয়ে দিনাতিপাত করে থাকে। দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী মোট ৫৫ লক্ষ শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভোগে থাকে ।
২০১৯ সালে দি ইকোনোমিস্ট গ্রুপের ইনটিলিজেন্ট ইউনিট একটি গবেষণার মাধ্যমে ১১৩ টি দেশের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা, এবং নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে একটি ’গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স -২০১৯’ প্রণয়ন করে। উক্ত সূচকে ১১৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম (স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৫৩.২) যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি মানদন্ডে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ দেশের মধ্যে ১০৭তম (স্কোর ১০০এর মধ্যে মাত্র ৩০.৬) যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।

তবুও আশার কথা হচ্ছে, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তের দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে যদিও প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান হারে চাল আমদানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ আমাদেরকে এই মজার তথ্য দেয় যে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লক্ষ টন চাল উৎপাদিত হয় এবং দানাদার খাদ্যের চাহিদার তুলনায় প্রায় ১.৫ কোটি টন খাদ্য উদ্বৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও সেবছর প্রায় ৫৭ লক্ষ টন চাল আমদানি করা হয় ।

অপ্রত্যাশিত হলেও বাস্তবতা এই যে, চাল ছাড়া অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোন নির্ভরযোগ্য ও হালনাগাদ চাহিদা নিরূপণ চর্চা করা হয় বলে জানা যায়না। তদুপরি, চালের চাহিদার ক্ষেত্রে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তার যথার্থতা নিয়েও গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের সঠিক তথ্য ছাড়া কোন দেশের পক্ষেই মূল্য সম্পর্কে আগাম ধারণা করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায়, অসদুপায় অবলম্বন এবং কারসাজির মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল অপচেষ্টা দূর করা অসম্ভব ব্যাপার। (ইসলাম, এস. ও মুক্তা, জেড. এইচ. ২০১১) ।

উপর্যুপরি প্রকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ, রাসায়নিক সারের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরা শক্তির হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফসলের রোগব্যাধি বৃদ্ধি, কৃষিজমির ক্রমহ্রাস, জৈবজ্বালানী ও প্রাণিখাদ্য হিসেবে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি কারণগুলো এদেশের খাদ্য উৎপাদন অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী। এরূপ অস্থিতিশীল উৎপাদন অভ্যন্তরীণ খাদ্য স্থায়িত্বকে বিঘ্নিত করে যা দরিদ্র মানুষের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে।

সুপারিশমালা:
কোন নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের চাহিদা মুটামুটি স্থিতিশীল থাকার কথা। কাজেই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থাপনাই খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক বলে ধরে নেওয়া যায়। শক্তিশালী নীতি ও প্রতিষ্ঠানিক অস্ত্র/ইন্সট্রুমেন্ট/কাঠামো এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা দক্ষ সরবরাহ বা বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণ সরবরাহ বা বন্টন ব্যবস্থাপনার জন্য অতীব জরুরী।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশে খাদ্য-চাহিদা ও যোগানের নির্ভরযোগ্য তথ্যের মারাত্মক অভাব লক্ষ করা যায়। অধিকন্তু দেশের খাদ্য উৎপাদন অনেকাংশে জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল যা হালে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা অতীব জরুরী। এমতাবস্থায়, অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।

১. অবিলম্বে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক গৃহীত খাদ্য অধিকার গাইডলাইন (আরটিএফজি), ভূমি-জলা-বনভূমির দ্বায়িত্বশীল শাসন সংক্রান্ত ভলান্টারি গাইডলাইন (ভিজিজিটি), দায়িত্বশীল কৃষি বিনিয়োগ নীতিমালা (আরএআই)- ইত্যাদির আলোকে একটি ”খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার” আইন প্রণয়ন করা যা দরিদ্র মানুষের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও বেশি দায়িত্বশীল করে তুলবে।

২. ক্ষুদ্র খাদ্য উৎপাদকদের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি পরিবেশসম্মত ও উৎপাদকবান্ধব খাদ্য-ব্যবস্থা গড়ে তুলার লক্ষ্যে চিরায়ত ও দেশীয় খাদ্য-ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শণ ও গুরুত্ব প্রদান করা।

৩. ক্ষুদ্র উৎপাদকদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে এসএসএফ গাইডলাইন ও সিএফএস-আরএআই নীতিমালা -এর আলোকে ক্ষুদ্র উৎপাদকদের স্বার্থ সংরক্ষণপূর্বক বাণিজ্যিক কৃষিতে টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা।

৪. নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য চাল, ডাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদি অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যগুলো রেশনের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য করা।

৫. অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে একটি ”দাম কমিশন” গঠন করা।

৬. ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

৭. খোলাবাজারে খাদ্য বিক্রয় (ওএমএস) কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে টিসিবিকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করা।

৮. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসল উৎপাদন ব্যহত করতে পারে এমন প্রকৃতিক দুর্যোগসমূহের আগাম বার্তা প্রদান কার্যক্রম শক্তিশালীকর।

৯. সঠিকভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও যোগান নিরূপন সাপেক্ষে খাদ্য ঘাটতি পূরণে যথাসমযে সঠিক পরিমাণে খাদ্য আমদানির ব্যবস্থা করা।

১০. আন্তর্জাতিক খাদ্য বাজারকে তীক্ষ্ণ মনিটরিং-এর আওতায় এনে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের আগাম তথ্য সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১১. বেআইনি মজুদদারী, কালোবাজারি, খাদ্য-বাজার-সিন্ডিকেট, ভেজাল ইত্যাদি রোধে আইনশৃংখলা বাহিনী ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১২. খাদ্য উৎপাদন, বিপণন, আমদানি-রপ্তানী বাণিজ্য, মূল্য নির্ধারণ, চাহিদা ও যোগান নিরূপণ ইত্যাদি কাজে জড়িত সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন করা।

—-০—

আজকের বাণিজ্যিক কৃষি ও আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গ

আজকের বাণিজ্যিক কৃষি ও আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গ

খাদ্য নিরাপত্তা শুধু ক্ষুধা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সহজলভ্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য প্রয়োজনীয় দুষণমুক্ত খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তাই হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। অর্থাৎ একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক এবং অন্য কোন দুষণ থেকে মুক্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য পাবে। অন্যদিকে, খাদ্য শুধু একটি পণ্য নয় বরং এটি কোন একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি তথা জীবনাচারের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাকে অনেকে একটি স্থিতিশীল খাদ্য উৎপাদন ও সুষম বন্টন ব্যবস্থা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি একটি শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পৃক্ত বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। এরূপ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের (যেমন: কৃষি জমি, বীজ, সার, পানি, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, জ্ঞান ইত্যাদি) উপর উৎপাদকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারকে নিশ্চিত করবে। অথচ আজকাল বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে কেবল দানাদার খাদ্যশস্যের সহজলভ্যতাকেই বুঝানো হচ্ছে। শুধু দানাদার খাদ্য দিয়ে যেমন মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় তেমনি বর্তমান রাসায়নিক কৃষির মাধ্যমে বিষমুক্ত খাদ্যের যোগান দেওয়াও অসম্ভব। পক্ষান্তরে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে, বর্তমান কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিজমি, বীজ, সেচের পানি, কৃষকের নিজস্ব জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্যান্য উপকরণ ইত্যাদি সবই আজ কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। প্রকারান্তরে গোটা কৃষি ব্যবস্থাই আজ কৃষকের হাতছাড়া যাচ্ছে যা শুধু কৃষকেরই নয় গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

কৃষি খাদ্যের বাণিজ্যিকীকরণ কার স্বার্থে

খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য এসবই মানুষের মৌলিক অধিকার। ধনী-গরীব নির্বিশেষে এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার মত ন্যুনতম পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ খাদ্য ও পানি পাওয়ার অধিকার আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অথচ প্রায় ৬০০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ পৃথিবীর ১০০ কোটির বেশি মানুষই তাদের খাদ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। তদুপরি, আজ খাদ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। খাদ্যের উপর কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে কোম্পানির মুনাফার অনন্ত ক্ষুধার আগুনে কোটি মানুষের খেয়ে বাঁচার অধিকার যে দগ্ধ হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

খাদ্য প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান। আর মানুষ প্রকৃতিরই সন্তান। সকল যুগেই এই বিশ্বের সকল মানুষ এবং অন্য সকল প্রাণির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রকৃতির মধ্যেই ছিল, প্রকৃতির মধ্যেই আছে। কিন্তু খাদ্যের অসম বন্টন ব্যবস্থার কারণেই সকল দেশে সকল যুগে বিপুল সংখ্যক মানুষ খাদ্য থেকে বঞ্চিত থেকেছে। একসময় মানুষ কোনরূপ উৎপাদন ছাড়াই প্রকৃতি থেকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতো। কিন্তু জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির কারণে মানুষকে খাদ্য উৎপাদন শুরু করতে হয়েছে এবং কালক্রমে তা বাণিজ্যের পণ্য হয়ে উঠেছে। আগে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই অধিকাংশ খাদ্য উৎপাদিত ও ক্রয়-বিক্রয় হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে খাদ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে খাদ্য শুধু নিছক বাণিজ্যের পণ্য নয় বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিরই একটি বড় নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। কৃষিপ্রধান দেশ না হয়েও খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে উত্তরের ধনী দেশগুলো। আর এ কাজে মূল ভূমিকা পালন করছে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সংস্করণ সেসব দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। যেহেতু কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন তাই খাদ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণভার এসব বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বন্টন পরিস্থিতি

এদেশে খাদ্য বলতে শুধু দানাজাতীয় খাদ্যকেই (চাল ও গম) হিসেবের মধ্যে ধরা হয় যা একটি চরম ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, দানাদার খাদ্যশস্য মানুষের প্রধান খাদ্য হলেও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে মানবদেহের পুষ্টির জন্য অত্যাবশ্যক সকল খাদ্যকেই বিবেচনায় নেওয়া জরুরী। তদুপরি, দেশের দানাজাতীয় খাদ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিসংখ্যানগত তথ্য নিয়েও মারাতœক বিভ্রাট লক্ষ করা যায় যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। প্রথমতঃ হালনাগাদ তথ্যের প্রাপ্যতা বিশেষ করে খাদ্য চাহিদাগত তথ্য মোটেও সহজলভ্য নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইট এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের ওয়েবসাইটের কোথাও খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদাগতÍ কোন তথ্য সহজলভ্য নয় যা এদেশের পরিকল্পনা প্রণয়নে দৈন্যদশার চিত্রই ফুটে উঠে। দ্বিতীয়তঃ যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় সেখানে কোন একটি উৎসের তথ্যের সাথে অপর কোন উৎসের তথ্যের ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তৃতীয়তঃ নির্দিষ্ট বছরের জনসংখ্যা এবং মাথাপিছু খাদ্যের চাহিদা থেকে দেশের মোট খাদ্য চাহিদা হিসাব করা হয়। কিন্তু, জনসংখ্যা ও মাথাপিছু খাদ্য চাহিদা নিয়েও রয়েছে বিরাট তথ্য বিভ্রাট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ২০১০ সালে দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬০ লক্ষ যদিও অনেকের মতে এটা ১৫ কোটি, কারও মতে ১৬ কোটি। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আদর্শ মান অনুসারে মাথাপিছু দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রতিদিন ৩৯৭ গ্রাম এবং প্রকৃত গ্রহণ ৫০০ গ্রাম। পক্ষান্তরে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসেবমতে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু ৫০৪ গ্রাম (যদি মোট ২৪০০ কিলোক্যালরির ৭৫% দানাদার খাদ্য থেকে পেতে হয়) দানাদার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে যদিও কোন কোন হিসাব মতে এই পরিমাণ আরও অনেক বেশি। এখন আমরা যদি দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি এবং মাথাপিছু দানাদার খাদ্যের চাহিদা ৫০৪ গ্রাম ধরি তবে ২০০৯-১০ অর্থ বছরের জন্য দেশের খাদ্য চাহিদা দাড়ায় ২৯৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অথচ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০ অনুসারে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল ৩৬৯ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ব থাকার কথা। অথচ ঐ বছরেই আরও প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য আমদানী করা হয়েছে এবং বিদেশী সাহায্য হিসেবে এসেছে আরও ৬০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য। অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে দানাদার খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল সর্বমোট ৩৯৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এই পরিমাণ খাদ্য যদি বাংলাদেশের মানুষ খেয়ে থাকে তবে প্রত্যেক মানুষ প্রতিদিন ৬৭৪ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করেছে যা থেকে প্রত্যেকে ২৪০৬ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়ার কথা যেখানে দারিদ্রসীমা হল ২১২২ কিলোক্যালরি !!! এই হিসাব যদি সত্য হয় তবে বাংলাদেশের দারিদ্র সত্যি সত্যিই যাদুঘরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তবুও পরিসংখ্যানের হিসাবে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৪০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। খাদ্যের অসম বন্টন ব্যবস্থাই এর মূল কারণ। সুতরাং এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, খাদ্য থাকলেই সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। কাজেই এ মুহুর্তে যেকোন প্রকারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষযুক্ত দানাদার খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে বন্টন ব্যবস্থাকে ক্রুটিমুক্ত করা এবং শস্য বহুমুখীকরণের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপরোক্ত হিসাব যদি সঠিক হয় তবে আগামী ৩০-৩৫ বছর উৎপাদন না বাড়লেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

আমাদের খাদ্যাভ্যাস খাদ্য নিরাপত্তা

আমাদের খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত, অবৈজ্ঞানিক ও হাজারো ভুল অভ্যাসে ঠাসা। যদিও খাদ্য গ্রহণের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা, কিন্তু এ দেশের মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে একেবারেই উদরপূর্তি ও রসনা তৃপ্তিকে প্রাধান্য দিয়ে। পুষ্টি সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবে যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এদেশের মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, শিক্ষিত এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও পুষ্টি জ্ঞান ও পুষ্টি সচেতনতার অভাব লক্ষণীয়।

আমরা ভেতো বাঙ্গালি, খাদ্য বলতে শুধু ভাতকেই বুঝে থাকি। বার্মা ও ভিয়েতনামের পর আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাতখেকো জাতি। অন্যান্য দেশ, যেখানে ভাত প্রধান খাদ্য, সেখানেও মানুষ ভাত বেশি খায় তবে আমাদের থেকে অনেক কম। ইন্দেনেশিয়ায় একজন লোক বছরে গড়ে ১৫২ কেজি, ফিলিপাইনে ১১০ কেজি, চীনে ১০৩ কেজি এবং ভারতে ৭৯ কেজি চালের ভাত খায়। আর আমরা খাই ১৮৩ কেজি চালের ভাত। আমাদের খাদ্য গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য থাকে কী করে মুখরোচক উপকরণ মিশিয়ে উদরপূর্তি করে ভাত খাওয়া যায়। আমাদের দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রতিদিন মাথাপিছু ৩৯৭ গ্রাম চালের ভাত অথচ আমরা খাই ৫০৪ গ্রামেরও বেশী। অন্যদিকে, আমাদের শাক-সব্জির চাহিদা প্রতিদিন মাথাপিছু ২১৩ গ্রাম অথচ আমরা খাই মাত্র ৫৩ গ্রাম। এক্ষেত্রে শুধু শাক-সব্জির অভাব বা দারিদ্রতা নয়, আমাদের সচেতনতার অভাবই প্রধানত দায়ী।

পুষ্টিকর ভাল খাদ্য বলতে আমরা মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বিদেশী জাতের শাক-সব্জি ও ফলমূল ইত্যাদি দামী খাবারকেই বুঝে থাকি যা একবারেই সঠিক নয়। আমরা যেদিন ভাল খাবারের আয়োজন করি সেখানে মাছ, কয়েক ধরণের মাংস, ডিম, দুধ বা দই এসবকিছু একসাথে খেয়ে উদর ঠেসে পূর্ণ করি যা একদিকে অর্থের অপচয় অন্যদিকে তেমনি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই আমরা মনে করে থাকি যে, বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের পক্ষে এসব খাবার কিনে খাওয়া সম্ভব নয় তাই তারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। প্রকৃত প্রস্তাবে, পুষ্টিকর খাদ্য বা ক্রয় ক্ষমতার অভাব নয় বরং পুষ্টি সম্পর্কে আমাদের চরম অজ্ঞতা ও অসচেতনতা এবং মিথ্যা আভিজাত্যের ভড়ংই এদেশের মানুষের পুষ্টিহীনতার প্রধান কারণ। খাদ্য সাহায্যের জন্য বিদেশীদের কাছে ভিক্ষা মাগতে আমাদের লজ্জাবোধ হয়না কিন্তু কচুর মত অত্যন্ত পুষ্টিকর শাক খেলে আমাদের মান-সন্মান থাকে না। বিভিন্ন প্রকার কচু ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে থানকুনি, তেলাকুচা, পিপুল, আমরুল, সজনে পাতা, বথুয়া, পুনর্ণভা, শান্তি শাক, নটে শাক, হেলেঞ্চা, গনোরি, কলমি, গ্যাটকল ইত্যাদি অসংখ্য শাক-সব্জি পাওয়া যায় যেগুলো চাষ করতে হয়না এবং এসব শাক-সব্জিতে কোন প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক সার বা কীটনাশকও থাকে না। অথচ পুষ্টি মানের দিক থেকে যেকোন দামী শাক-সব্জি থেকে এগুলো কোন অংশে কম নয়। তদুপরি এগুলোর রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। অথচ, আজ এদেশের মানুষের ভিটামিনের অভাব দূর করে অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ধানের মধ্যে ভিটামিন-এ ঢুকিয়ে আমাদের ভিটামিনের অভাব দূর করার এক হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে ‘গোল্ডেন রাইস’ তৈরি করা হচ্ছে। গোল্ডেন রাইসের ভাত খেয়ে যদি ভিটামিন-এ এর অভাব দূর করতে হয় তবে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে প্রায় ৭.৫ কেজি চালের ভাত খেতে হবে তাও যদি শরীর সবটা হজম করতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম গোল্ডেন রাইস থেকে মাত্র ৩০ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন বা ভিটামিন-এ পাওয়া যাবে। অথচ, আমাদের দেশী জাতের লাল চালেও এর চেয়ে আনেক বেশি বিটাক্যারোটিন আছে যেসব ধান আজ বিলুপ্তির পথে। বনে-বাদাড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা ১০০ গ্রাম হেলেঞ্চা শাকে ১৩৭০০ মাইক্রোগ্রাম, থানকুনি শাকে ১৩১০০ মাইক্রোগ্রাম, কলমী শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম, কালোকচু শাকে ১২০০০ মাইক্রোগ্রাম এবং সবুজকচু শাকে ১০২৭৮ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন আছে। যেসব গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে গোল্ডেন রাইস তৈরি করা হচ্ছে তাদের আশেপাশে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এরূপ অসংখ্য খাদ্যবস্তু রয়েছে যা অসচেতনতার জন্য মানুষ খায়না।

অনুরূপভাবে আতা, শরিফা, বেল, কদবেল, পেয়ারা, আমড়া, কামরাঙ্গা, কাঠাল, পেপে, জাম, জামরুল, সফেদা, আমলকি, তেতুল, কুল, ডালিম ইত্যাদি বহু ধরণের দেশী ফল পুষ্টিমানের বিচারে কমলা, আপেল, আঙ্গুর, বেদানা ইত্যাদি যেকোন বিদেশী ফল থেকে কোন অংশেই কম নয়। তা ছাড়া এসব বিদেশী ফলমূল সংরক্ষণে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করা হয় যা আমরা সবাই জানি। অথচ আমরা আভিজাত্যের মিথ্যা অহংকার দেখাতে গিয়ে এসব দেশী ফলগুলোকে হেলাফেলা করি যা একবারে মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আজ এরূপ মিথ্যা অহংকারভরা মুর্খতা আমাদের মন-মগজে চেপে বসেছে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে অযথাই হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, তুলে দিচ্ছে কোম্পানির হাতে। কাজেই আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষের পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া।

খাদ্যের ঘাতক রূপ এবং খাদ্য নিরাপত্তা

যে খাদ্য আমাদেরকে সুস্থ্য রাখবে, আমাদের জীবন বাঁচাবে সে খাদ্যই আজ আমাদের নানারকম রোগ-ব্যাধি ও প্রাণনাশের বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেহের পুষ্টির চাহিদা মিটানোর জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক-সব্জি ও ফলমূলসহ সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত— জরুরী। কিন্তু আমরা খাদ্য গ্রহণের নামে প্রতিদিন জেনে বা না জেনে বিষ সেবন করে চলেছি। কারণ, শাক-সব্জি ও ফলমূলসহ এসব খাদ্যে উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মিশানো হচ্ছে নানাবিধ বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য। আধুনিক জাতের উচ্চফলনশীল, হাইব্রিড ও জিএম শাক-সব্জিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদন করতে গিয়ে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি। খাদ্যের সাথে এসবই আমাদের দেহে ঢুকছে। আবার, এসব শাকসব্জি ও ফলমূল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ এবং ফলমূল পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বাইড ও ইথারেলসহ নানাবিধ বিষাক্ত পদার্থ। মাছ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য শাকসব্জি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রঞ্জক দ্রব্য। ফলে, একদিকে যেমন আমাদের দেহে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি দেখা দিচ্ছে অন্যদিকে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কালও হ্রাস পাচ্ছে। আজ আমরা বাধ্য হচ্ছি বাবা বা মা হয়ে প্রাণপ্রিয় সন্তানের মুখে স্বহস্থে বিষ তুলে দিতে-এর চেয়ে অসহায় অবস্থা আর কী হতে পারে!

পানির বাণিজ্যিকীকরণ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আরেক হুমকি 

খাদ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি। তাই, খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করাও জরুরী। অথচ, নিরাপদ পানির ক্রমবর্ধমান সংকট আজ সারাবিশ্বে কোটি কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। চিন্তাবিদদের এই আশংকা মোটেই অমূলক নয় যে, পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে তা হবে পানি নিয়েই। প্রকৃতির পানিকে দুষিত করে বিত্তশালীরা এখন মিনারেল ওয়াটারের দিকে ঝুঁকছে। আগামী দিনে পানিই হবে মহামূল্যবান পণ্য। এই গরীব দেশেই পানি আজ দুধের দামকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ পেটের দায়ে নিজের গাভীর দুধ নিজেই খেতে পারেনা সে উচ্চমূল্যে পানি কিনে খেতে পারবে এমনটা ভাবাই অবান্তর। অথচ বাস্তবে তাই ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমানে আর্সেনিক দুষণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে যে পানি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত খাচ্ছে। দুষিত পানি পান করে ধুকে ধুকে মরা অথবা পানিবিহীন মরা অর্থাৎ মৃত্যুই যেন আমাদের নিশ্চিত পরিণতি।

পানি সংকট এখন জলবায়ুগত ও রাজনৈতিক ইস্যু। বিজ্ঞানীদের ধারণা বিশ্বব্যাপী পানি স্বল্পতার শতকরা ২০ ভাগের জন্য দায়ী হবে জলবায়ু পরিবর্তন। বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই নিরাপদ পানির মারাতœক সংকট দেখা দিবে। নিরাপদ পানি স্বল্পতার আর একটি প্রধান কারণ পরিবেশ দুষণ। কারণ, প্রতিবছর দুই মিলিয়ন টন শিল্পবর্জ্য ও রাসায়নিক দ্রব্য, মানববর্জ্য, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পানিতে মিশছে (ইউএনডব্লিওএফপি ২০০৩)। গরীবরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ, উন্নয়নশীল দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই এই দুষিত পানি ব্যবহার করছে।

বর্তমানে পানি ব্যবসায়ী কোম্পানীগুলো বিশ্বের মাত্র ৫% জনসংখ্যার পানির চাহিদা মেটাচ্ছে আর তাতেই মাত্র চারটি বৃহৎ কোম্পানির ২০০১ সালের মোট আয় ছিল ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই সারা বিশ্বের পানিখাত বেসরকারীকরণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বহুজাতিক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। উন্নয়নশীল দেশসমূহের পানি নীতিকে বেসরকারীকরণের অনুকূল করার জন্য ঋণের সাথে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়ে এসব সংস্থা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। আর সেবাখাত উদারীকরণ চুক্তির (গ্যাটস) মাধ্যমে পানিখাত বেসরকারীকরণের সকল বাধা দূর করছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর চাপে মোজাম্বিক, বেনিন, নাইজার, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, ক্যামেরন এবং কেনিয়াসহ বেশকিছু দেশ ইতোমধ্যেই তাদের পানিখাত বেসরকারীকরণ করতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই, এ ব্যাপারে সময়মত সাবধান হওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

আশু করণীয়

আজ এদেশের কৃষি ও কৃষকের এরূপ সংকট মোকাবেলা করা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যার কারিগরি কৌশল হবে জৈব কৃষি চর্চা। কিন্তু বাংলাদেশের মত একটি জনবহুল দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া জৈব কৃষির পক্ষে আদৌ সম্ভব কি-না তা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে অনেকের মাঝেই যথেষ্ট সন্দেহ লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে, গত ৩-৫ মে ২০০৭ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ““Organic Agriculture and Food Security”” শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞদের অভিব্যক্তি প্রনিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে যে, জৈব কৃষি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। বিজ্ঞানী Badgley et. al. 2007;  Halberg et. al. 2006; সাম্প্রতিককালে একটি তাত্ত্বিক মডেল দিয়েছেন যাতে দেখানো হয়েছে যে, এই মডেলের ব্যবহার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বর্তমানের মোট আবাদী জমির পরিমান ও ফলন না বাড়িয়েও জৈব কৃষির মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিদিন ২৬৪০ থেকে ৪৩৮০ কিলোক্যালরি খাদ্য যোগান দেওয়া সম্ভব।

জৈব কৃষি চর্চার মাধ্যমে এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় – এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তারা প্রকৃতপক্ষে চলমান ভোগবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটেই এমনটি করেন। যেমন: রোজার শিক্ষা হল সংযম বা ভোগকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাই যদি হয় তবে সঙ্গত কারণেই রমজান মাসে ভোগ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, রমজান মাসে আমাদের ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। অথচ দ্রব্যমূল্য নিয়ে হৈচৈ করার চেয়ে  আমাদের ভোগ নিয়ন্ত্রণ করা অধিক জরুরী।

অন্যদিকে, আমরা জানি, উদ্ভিদই কেবল নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে। কাজেই এই বিশ্বভ্রহ্মান্ডের সকল জীবই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এখন যে পোকামাকড় এই উদ্ভিদ (মাঠ ফসল, ফলজ ও বনজ বৃক্ষ ইত্যাদি) থেকে খাদ্য শিকলে খাদ্য সরবরাহের কাজটি করে তাকে শক্রু জ্ঞান করে কীটনাশক প্রয়োগ করে ধ্বংস করার ফলে গোটা খাদ্য-জাল বিঘিœত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বিশ্বভ্রহ্মান্ডের জীববৈচিত্র্য। কাজেই, ফসল রক্ষার প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করছে তা একমাত্র মানুষের ভোগের জন্যই নয়। কাজেই, স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রকৃতপক্ষে একটি দর্শন যা সাদামাটাভাবে ফসলের ফলন বা পরিমানগত উৎপাদন দিয়ে বিচার করলে চলবে না।

তা ছাড়া, জৈব কৃষি চর্চায় ফসলের ফলন কমবে সে ধারণাও অমূলক। আজকে যারা জৈব কৃষিকে অসম্ভব মনে করছেন তারা আসলে বর্তমান প্রচলিত কৃষির ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও সংকটের প্রেক্ষাপটেই এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন। গত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে রাসায়নিক কৃষি চর্চার ফলে আমাদের মাটি, পরিবেশ, ইকো-সিস্টেম এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার যে রূপান্তর ঘটেছে সেখানে শুধু টনের হিসেবে জৈব সার প্রয়োগ করেই রাতারাতি ফলাফল প্রত্যাশা করাটাই অযৌক্তিক। এজন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও ফসলের ইকোসিস্টেম পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জৈব কৃষি চর্চায় উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে ফসলের সার্বিক ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার উপর। মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, ফসল ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, পোকা-মাকড় ও অন্যান্য বালাই ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজগুলো দক্ষতার সাথে করতে পারলে জৈব কৃষিতে শুধু স্থায়িত্বশীল ফলনই নিশ্চিত হবেনা, উৎপাদনশীলতা এবং সার্বিক লাভও বৃদ্ধি পাবে। আর এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বান্তবায়ন করা।

কৃষি বাজেটে ক্ষুদ্র কৃষক  ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের  সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরী

কৃষি বাজেটে ক্ষুদ্র কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরী

কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম


জাতীয় বাজেট একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দলিল যাতে একদিকে যেমন দেশের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা ও পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটে অন্যদিকে এর প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক প্রভাব জাতীয় এবং ব্যক্তি জীবনের সর্বত্রই পড়ে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সোপানে পদার্পন করা বাংলাদেশের জন্য জাতীয় বাজেট নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা তাই অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আমরা জানি, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি, তৈরি পোশাক, আর র‌্যামিট্যন্সের উপর দাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথ পাড়ি দিচ্ছে। অন্য খাতগুলোর তুলনায় জিডিপিতে কৃষিখাতের ক্রমহ্রাসমান অবদান সত্তে¡ও বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষির অবদান এখনও সর্বাধিক। বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে এখনো বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা কোন না কোন ভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) এর হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমমক্তির ৪০.৪ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত আছে যারা দেশের পিছিয়েপড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ এবং যাদের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কৃষির উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। কিন্তু প্রতিবছর জাতীয় বাজেটের আকার লম্ফ দিয়ে বাড়লেও তাতে কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাত সমূহের বরাদ্ধ ক্রমহ্রাসমান যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

দেশের অর্থনীতিতে করোনাজনিত ব্যাপক অভিঘাতের মধ্যে বিগত ২০২০-’২১ এবং ২০২১-’২২ এই দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হলেও এবারের বাজেট ঘোষণা করোনামুক্ত পরিবেশেই হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু করোনার অভিঘাত এখনও ব্যাপকভাবে বিরাজমান। তদুপরি, মরার উপর খাড়ার ঘা রূপে আবিভর্‚ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন কিংবা রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধ যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশসহ সারাবিশে^ই ব্যাপকতর হচ্ছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রভাব দেখা দিচ্ছে বিশ^ খাদ্য বাজারে। এমনিতেই খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবন অতিষ্ট। এমতাবস্থায়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তথা সম্ভাব্য খাদ্য সংকট বিবেচনায় আসন্ন বাজেটে কৃষিখাত বাড়তি মনোযোগ দাবী করে। কারণ, সকল সংকটকালে কৃষিই আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে ভ‚মিকা রেখে চলেছে। বহু গবেষণা ও নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুসারে করোনাকালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও বেশিরভাগ মানুষের আয় কমেছে, বেড়েছে দারিদ্র। লকডাউনকালে তৈরি পোষাকসহ রপ্তানি খাত, র‌্যমিট্যান্স আয়, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র যখন চরম মন্দা নেমে এসে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের অর্থনীতির চাকা, যখন দেশের শিল্প ও সেবাখাত থেকে কাজ হারিয়ে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্য থেকেও প্রচুর সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে কৃষির উপর বাড়তি চাপ নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল কৃষিখাত তখন দেশের অর্থনীতির ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিল। করোনাকালে একদিকে মহামারীতে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা অন্যদিকে চরম খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের আতঙ্কের মধ্যে একমাত্র আশার প্রদীপ জাগিয়ে রেখেছিল দেশের কৃষিখাত।

সঙ্গত কারণেই বিগত বছরগুলোর বাজেট বক্তৃতাসহ সকল অর্থনৈতিক দলিল এবং কেতাবি আলোচনায় কৃষিখাত এখনও নীতি নির্ধারক মহলে দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবেই বিবেচিত হতে দেখা যায়। কারণ, দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে কৃষির গুরুত্ব কম করে দেখার কোন সুযোগ নেই। অথচ বিগত বছরগুলোর বাজেট পর্যালোচনা করলে এক হতাশাজনক চিত্রই ফুটে উঠে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৯৪ হাজার কোটি টাকা যা ২০২১-২২ অর্থ বছরে বেড়ে দাড়িয়েছে ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাতের অংশ ছিল ১০.৯% যা চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে মাত্র ৫.৩ শতাংশে (লেখচিত্র-১ ও ২) নেমে এসেছে যার অবস্থান বাজেটের ১৫টি খাতের মধ্যে নবম। কাজেই, মুখে বা কেতাবে যাই বলা বা লেখা হউক না কেন জাতীয় বাজেটে কৃষিখাত বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত থেকেছে ক্ষুদ্র চাষীর (ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক একসাথে) স্বার্থ যারা কৃষক জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৯৬ ভাগ (লেখচিত্র-৩)।

অবশ্য এমন উপেক্ষার হয়ত সঙ্গত কারণও আছে। কারণ, এই শ্রেনীর কৃষকেরা অনেকটা প্রাচীনকালের দাসেদের মত কৃষিতে শ্রম দিয়ে গেলেও বিনিময়ে তাঁদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি খুব সামান্যই। তাদের অধিকার নিয়ে দরকষাকষি করার মত কোন সংগঠন নেই, নেতৃত্ব নেই যেমনটা আমরা দেখি ব্যবসায়িদের বেলায়। যেমন, করোনা লকডাউনকালে ব্যসায়িদের জন্য সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করলেও প্রথমদিকে কৃষকেরা ছিল সম্পূর্ণই উপেক্ষিত যদিও লকডাউনের অভিঘাত কৃষকদের উপর যথেষ্টই পড়েছিল। অসংখ্য কৃষক সব্জি বিক্রী করতে না পারায় ক্ষেতেই নষ্ট হতে দেখা গেছে। বিপুল সংখ্যক পোল্ট্রি ও লেয়ার খামারি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। পরপর দু’টি কোরবানি ঈদে গরুর দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখো কৃষক। অতপর সোশাল মিডিয়া, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াসহ নানান মহলের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত ৫০০০ কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করলেও তার তেমন কোন সুফল ক্ষুদ্র কৃষকের ঘরে যায়নি। অথচ দেশের প্রধান খাদ্য যোগানদাতা হলেও অদ্যাবধি, তাঁরা দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সিংহভাগের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাঁরাই সর্বাধিক খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে থাকে। দিনভর প্রাণান্ত পরিশ্রম করে, উচ্চমূল্যে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তি ক্রয় করে, সকল প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা কাধে নিয়ে তারা যে ফসল ফলায়, দিনের পর দিন তার লাভজনক মূল্য না পাওয়ায় দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইলেও তাদের উন্নয়নের স্বপ্ন মাথাকুড়ে মরে। অন্যদিকে, দিনদিন কৃষির যে রূপান্তর পরলক্ষিত হচ্ছে তাতে এঁদের ব্যাপক অংশ ফিবছর কৃষি থেকে বিতারিত হয়ে দাসত্বের রূপ বদলে গ্রামবাসি থেকে বস্তিবাসীতে পরিণত হচ্ছে। জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এরূপ বৈষম্য দূরীকরণ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা হলেও জ্ঞাত বা অজ্ঞাত কারণে সেদিকটা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, বর্তমান সরকার কর্তৃক ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রণীত নির্বাচন মেনিফেস্টু এবং ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরবর্তী বাজেট থেকেই কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের বিকাশকে আগ্রাধিকার দেয় যা বেশ আশা জাগিয়েছিল। কারণ, জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক শীর্ষে থাকা গ্রামপ্রধান এবং কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জন্য কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং এসএমই খাতের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য নিরাপত্তাকেও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যার সুফল হিসেবে দেশ আজ খাদ্যে (যদিও মূলত দানাজাতীয় খাদ্যে এবং এখনও আমদানি নির্ভরতা আছে) স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং দেশে ফসল, ফল ও মৎস্যসহ কৃষি উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ^ব্যাংকের চাপে গৃহীত ভ্রান্ত নীতির ফলস্বরূপ দেশের মৃতপ্রায় পাটখাতের পূণরুজ্জীবনে বর্তমান সরকার বেশকিছু ভাল পদক্ষেপ নিয়েছিল। দেশের কৃষির স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে “একটি বাড়ি একটি খামার” ও “সমন্বিত কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি প্রকল্প”-এর মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে “বাংলাদেশ কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্লান (সিআইপি ২০০৯) প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। সরকারের এসব উদ্যোগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য হলেও প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের অভাবে সেগুলো যথেষ্ট পরিমাণ সুফল দিতে পারেনি।

এটা অনস্বীকার্য যে, সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষির বাণিজ্যিকায়নের নীতির ফলেই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এমন সাফল্য এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এরূপ সাফল্যের পিছনে কৃষকের প্রাণান্ত পরিশ্রম এবং অসামান্য অবদানকে অনেকসময় গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়না। তাছাড়া, সরকারি এসব নীতি কৃষিবান্ধব বলা হলেও কতটা কৃষকবান্ধব সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ, সমস্ত সরকারি নীতি ও পরিকল্পনার সুফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িদের ঘরে উঠতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে যাদের মূখ্য অবদান সেই ক্ষুদ্র কৃষক ক্রমাগতভাবে তার উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের ব্যবসায়ি মহল এবং বৈদেশিক দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর পরামর্শে বা চাপে গৃহীত নীতির (যেমন, ভর্তুকী দিতে বারণ করা এবং মুক্ত বাজার নীতি অনুসরণে বাধ্য করা যদিও তারা নিজেরাই তা করেনা) ফলে অবাধ বানিজ্যের প্রতিযোগীতায় ক্ষুদ্র কৃষকেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন বাড়লেও উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষক কৃষি থেকে কদাচিৎ লাভ পায়। সুখবর হচ্ছে গত দুই বছর যাবৎ উৎপাদন মৌসুমেও কৃষকরা ধানের ভালো দাম পেয়েছে। অবশ্য কৃষকদের এই সামান্য লাভের খেসারত দিতে হয়েছে দরিদ্র ভোক্তাদেরকেই। কারণ, চালের বাজার এখন আকাশচুম্বি যা ধানের বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে কৃষির সামগ্রিক নীতি ও পরিকল্পনায় কৃষির বাণিজ্যিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নকল্পে খামার ভিত্তিক চাষাবাদকে উৎসাহিত করেছে যেমন: পোল্ট্রি খামার, মৎস্য খামার, দুগ্ধ খামার ইত্যাদি। বিদেশি ও হাইব্রিড জাত নির্ভর এরূপ খামারভিত্তিক চাষাবাদে (ইংরেজিতে যাকে মনোকালচার বলা হয়) বিপন্ন হচ্ছে দেশের হাজার বছরের স্থায়িত্বশীল, সমন্বিত এবং জৈব কৃষি। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র এবং ইকোসিস্টেম যা আমাদের জলবায়ু সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে তুলছে। বিপন্ন হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য। আজ আমাদের ক্রমবর্ধমান ও অপরিসীম ক্ষুধা মিটাতে গিয়ে যে কৃষিকে আমরা খোরপোশের কৃষি বা সাবসিস্টেন্স ফার্মিং আখ্যা দিয়ে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি তার খেসারত নিশ্চয় একদিন আমাদেরকে দিতে হবে যদিও সেদিন হয়ত করণীয়টা খুব বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। যাহোক, এরূপ বাণিজ্যিক কৃষির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা। একদিকে জলবায়ু সহনশীল ও স্থায়িত্বশীল কৃষির কথা বলা হলেও “হাই ইনপুট, হাই আউটপুট” কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কৃষি অর্থনীতির “ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি” বিবেচনায় নিলে এরূপ কৃষি স্বল্পমেয়াদে বেশি উৎপাদনশীল মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্বশীল নয়। কারণ, কৃষি উৎপাদন উপকরণ (যেমন: রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, হরমোন, ভিটামিন ইত্যাদি)-এর ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করার ফলে একটা পর্যায় পর্যন্ত উৎপাদন বাড়লেও একসময় স্থিতাবস্থায় পৌছানোর পর প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষি আর কৃষকের জন্য লাভজনক থাকেনা। এমন কৃষি ব্যবস্থায় কৃষি উপকরণ সরবরাহকারি কোম্পানি এবং ব্যবসায়িরা ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও খোদ কৃষক লাভবান হয় না।

অন্যদিকে, বাণিজ্যিক কৃষিতে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার কোথাও খোদ কৃষকের কোন নিয়ন্ত্রণ দূরে থাকুক সামান্য প্রভাবটুকুও দেখা যায় না। একমাত্র কৃষি ছাড়া অন্য সকল নিত্যভোগ্য এমনকি বিলাসপণ্যের মূল্যও উৎপাদক স্বয়ং কিংবা সরকার-উৎপাদক মিলে নির্ধারণ করলেও কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষকের কণামাত্র ভ‚মিকা থাকেনা। অথচ আজ আমরা যে কৃষি দেখছি সেটা মূলত শিল্পকৃষি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগ্রিকালচার) যদিও এটিই সম্ভবত একমাত্র শিল্প যেখানে উৎপাদক মালিক না হয়ে মূলত শ্রমিকের ভ‚মিকা পালন করে থাকে। কৃষির প্রাণপঙ্ক হলো বীজ যা আজ কোম্পানি-ব্যবসায়িদের নিয়ন্ত্রণে। সারের উৎপাদন ও আমদানি বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বালাইনাশকের বাজার পুরোপুরি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে পোল্ট্রির বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রায় কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত। খাদ্যপণ্যের প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি বৃহৎ অটো রাইসমিলের আগ্রাসনে লক্ষ লক্ষ চাতালকল, যেখানে বিপুল পরিমাণ নারীরা কাজ করতো, আজ ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। এর ফল আমরা কি দেখছি? খাদ্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আজ খোদ সরকারের হাতেও নেই। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা বৃহৎ বা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত হলে তা কত ভয়াবহ হতে পারে তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে এই বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। অমর্ত্য সেন আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন কোম্পানি-ব্যবসায়িরা কিভাবে মুনাফার লোভে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতেও কুন্ঠিত হয়না।

কৃষির স্থায়িত্বশীলতা এবং ক্ষুদ্র কৃষকের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কৃষি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকাল বুঝার জন্য দেশের পোল্ট্রি খাতকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যায়। এদেশে কয়েক দশক আগে বিদেশি প্রজাতি নির্ভর পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র খামারিদের হাত ধরে যারা ম‚লত ৫০, ১০০ বা ২০০ মুরগীর ক্ষুদ্র খামার গড়ে তুলেছিল। তখন তা তাঁদের জন্য লাভজনকই ছিল। কিন্তু খাদ্য, ঔষধপত্র এবং অন্যান্য উপকরণের মূল্য এবং রোগব্যাধিসহ নানাবিধ সমস্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলাতে না পেরে তারা আজ বিলীন হয়ে গেছে। এরপর ক্রমেই মাঝারি উদ্যোক্তারা পোল্ট্রি শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারাও আজ টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। ক্রমেই দেশের পোল্ট্রি শিল্প সিপি বাংলাদেশ, নিউ হোপ-এর মত দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানির কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে। একইভাবে দেশের মৎস্যখাত এবং শস্যখাতও ক্রমশ কৃষকের হাত থেকে সরে গিয়ে দেশি-বিদেশি কোম্পানি কিংবা পুঁজিপতি কৃষি উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাচ্ছে আর প্রকৃত কৃষকেরা হয় কৃষিশ্রমিকে অথবা গ্রামীণ অকৃষি পেশা কিংবা শহরে নির্মাণ শ্রমিক কিংবা ভ্যান-রিক্সা-অটো চালকে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশ তার খাদ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ দেশি-বিদেশি কোম্পানির কুক্ষিগত হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুকির মধ্যে পতিত হতে যাচ্ছে। বস্তুত আমরা এখন তথাকথিত উন্নত দেশের কৃষির মডেল অনুসরণ করছি যা হাজার হাজার ডলার ভর্তুকী দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণেই দেড়-দুই দশকের ব্যবধানে দেশের পোল্ট্রি চাষীদেরকে এখন টিকে থাকার জন্য ভর্তুকী দাবি করতে হচ্ছে। ভর্তুকী না দিয়ে কৃষিকে কৃষকের জন্য লাভজনক করতে গেলে খাদ্যের দাম দরিদ্র ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ফলে, খাদ্যের যথেষ্ট যোগান থাকা সত্তে¡ও দরিদ্র মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। কিন্তু, বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ-এর চাপে কিংবা নিজেদের উদাসীনতায় গত এক দশকে কৃষিতে প্রকৃত ভর্তুকীর পরিমান ৬০০০-৯০০০ কোটি টাকার মধ্যে উঠানামা করছে (লেখচিত্র-৪) যদিও এই সময়ে বাজেটের আকার বেড়েছে ছয়গুণেরও বেশি। অথচ সরকারের সর্বোচ্চ মহলের কথাবার্তায় বুঝা যায় যে সরকার ভর্তুকী দিতে দিতে এখনি হাফিয়ে উঠেছে।

এটা সত্য যে, বর্তমানে যতসংখ্যক মানুষ কৃষিতে আছে তাদেরকে কৃষিতে রেখে সবার অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। কাজেই কৃষি থেকে অনেক মানুষ বিতারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা কৃষিতে থেকে যাবে কিংবা আগামী প্রজন্মের যারা কৃষিতে আসবে তাদের জন্য আকর্ষনীয় এবং সন্মানীয় পেশা হিসেবে কৃষিকে উপস্থাপন করতে না পারলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন তথা খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমশ আরও নাজুক অবস্থায় উপনীত হবে। কাজেই কৃষিকে কৃষকের জন্য লাভজনক করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত কৃষকেরা কৃষিতে আসতে চাইবেনা। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে কৃষিকে কৃষকের জন্য লাভজনক করাটা অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল ব্যাপার বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কেবল খাদ্য উৎপাদন বাড়ালেই যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না তেমনি কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও নিশ্চিত হয় না যদি না কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়। কিন্তু বিগত বাজেটগুলোতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবে ‘কৃষক বিপণন দল’ ও ‘কৃষক ক্লাব’ গঠন এবং গ্রোয়ার্স মার্কেট স্থাপনের যে সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে তা প্রকৃতপ্রস্তাবে কতটা সফল তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। কৃষির ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণের ফলে এবং ক্রুটিপূর্ণ বর্তমান মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক যা উৎপাদন করে তার লভ্যাংশটুকু লুটেপুটে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা যেখানে কৃষক তার উৎপাদন ব্যয়টাও উঠাতে পারে না। অন্যদিকে, ভর্তুকী বা ঋণ হিসেবে যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও লুটেপুটে নেয় একশ্রেণীর সুবিধাভোগীরা। কাজেই, শুধু কিছু গ্রোয়ার্স মার্কেট নির্মাণ করে কিংবা রাসায়নিক সারে কিছু ভর্তুকী দিয়েই এই জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বর্তমান বাজার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার যার কোন দিকনির্দেশনা বিগত বাজেটগুলোতে পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হলেও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা আজও সুদুর পরাহত। কারণ, খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার কিছুটা কমেছে বলে দাবী করা হলেও দেশের কৃষিতে এখনও প্রায় ৪০ লাখ টন রাসায়নিক সার ও প্রায় ৩৭ হাজার টন রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে । পক্ষান্তরে, মানুষ আজ পেট পুরে খেতে পারলেও “পুষ্টিহীনতাজনিত গুপ্ত ক্ষুধা (হিডেন হাঙ্গার)”-এ ভ‚গছে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ। আর বিষাক্ত খাবার খেয়ে বাড়ছে রোগব্যাধি, বিপন্ন হচ্ছে মানবস্বাস্থ্য। সরকার একটি জৈবকৃষি নীতি প্রণয়ন করলেও তা বাস্তবায়নের তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনা। দেশে আজও জৈব খাদ্যের কোন মানদন্ড প্রবর্তন করা হয়নি যা প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। দেশে একটি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও খাদ্যে বিষাক্ততা ও ভেজাল রোধে খাদ্যমান পরীক্ষা, প্রত্যয়ন এবং পরিবীক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং সক্ষমতা সৃষ্টির যথেষ্ট উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যত “না খেয়ে মরার চেয়ে খেয়ে মরাই ভালো” নীতিতে বিশ^াসী হয়ে ক্রমেই আমরা এক অনিশ্চিত এবং ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায় বলেই দেশে নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ক্রমবর্ধমান এই চাহিদার যোগান দিতে সারা দেশে প্রচুর সংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিরাপদ খাদ্য ভ্যালু-চেইন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে যা সরকার ঘোষিত ”এসএমই” উন্নয়নের একটা চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।

এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত এদেশের প্রান্তিক কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেবল বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানির হাতে সব ছেড়ে না দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের স্বার্থে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করা এবং সে অনুযায়ী জলবায়ু সহনশীল স্থায়িত্বশীল কৃষি পূণঃপ্রতিষ্ঠায় সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি, খাদ্য বাজারকে সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে রাখতে খাদ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেশনের কুক্ষিগত হতে না দিয়ে ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন উদ্যোগকে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। এর সুদূরপ্রসারী সুফল শুধু খাদ্য ব্যবস্থাতেই আসবে না, এতে ব্যাপক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। এজন্য বর্তমান কৃষির কাঠামোগত সংস্কার অত্যাবশ্যক।

জাতীয় কৃষিবাজেটে ক্ষুদ্র কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ১৫ দফা সুপারিশ:
১. জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্থায়িত্বশীল খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থে মাটির স্থায়িত্বশীল উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধিসহ জলবায়ু সহিঞ্চু স্থায়িত্বশীল কৃষি (ঈষরসধঃব জবংরষরবহঃ ঝঁংঃধরহধনষব অমৎরপঁষঃঁৎব-ঈজঝঅ) চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জলবায়ুসহিঞ্চু স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চার কৌশল ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণখাত এবং গবেষণাখাতে বরাদ্দ রাখা।

২. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য চলমান উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার সংস্কার সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এজন্য ’দাউদকান্দি মডেলে’ কৃষকদের ‘উৎপাদন ও বিপণন উদ্যোগ’ গড়ে তোলা। কৃষকের শিক্ষিত বেকার সন্তানদেরকে কাজে লাগিয়ে এসএমই আকারে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে “শস্য গুদাম ঋণ প্রকল্প”কে পূণরুজ্জীবিত করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ‘শস্য সংরক্ষণ ঋণ’ চালু করা।

৩. কৃষিপণ্যের আগাম মূল্য নির্ধারণে সরকার-উৎপাদক-ভোক্তা সমন্বয়ে মূল্য কমিশন গঠন করা। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের জন্য সুদবিহীন বা স্বল্পসুদে মৌসুমভিত্তিক কৃষিঋণ সহজলভ্য করা এবং নারী কৃষকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে ঋণসহ সকল সরকারি সেবা ও প্রণোদনায় নারী কৃষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

৪. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত “লাঙ্গল যার জমি তার” নীতির ভিত্তিতে দেশের ভূমি মালিকানা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা। এজন্য “ল্যান্ড ব্যাংকিং” ব্যবস্থা চালু করে অনুপস্থিত ভ‚মিমালিকদের কাছ থেকে জমি “ল্যান্ড ব্যাংকে” জমা নিয়ে তা প্রকৃত ক্ষুদ্র কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজলভ্য করা। পাশাপাশি, ভূমি জরিপ আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাইজেশন, ভ‚মি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও ভূমি সংস্কারে সরকারের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

৫. দেশের মৃতপ্রায় নদীগুলোকে বাঁচাতে এবং নদীর পানিভিত্তিক সেচ ব্যবস্থাকে পূণরুজ্জীবিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রহণ করা। পাশাপাশি, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়সহ সকল সকল জলাশয়ে প্রকৃত মৎস্যজীবিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত “জাল যার জলা তার” নীতির আশু বাস্তবায়ন করা।

৬. সার, বীজ, সেচকাজে ভর্তুকী প্রদানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীল স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রযুক্তি তথা জৈব সার, বালাইনাশক, আইপিএম-এর মত জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তিসম্প্রসারণে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও ভর্তুকী প্রদান এবং এই ভর্তুকির সুবিধা যাতে সরাসরি নারী কৃষকসহ প্রকৃত কৃষকরা পায় তার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারী কৃষি শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় সেবা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও জামানতবিহীন ঋণ প্রদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান রাখা এবং নারীবান্ধব কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।

৭. স্বাধীন ও শক্তিশালী কৃষক সংগঠন তৈরির মাধ্যমে কৃষি সংশ্লিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রকৃত কৃষকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।

৮. কৃষি বাজারসমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাজারে প্রকৃত কৃষকদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম হ্রাস এবং রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ প্রহণ করা।

৯. সরকারীভাবে ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ডিলারের কাছে কৃষকেরা যাতে সরাসরি ধান কিংবা কৃষকদের সহযোগি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ তাদের প্রক্রিয়াকৃত চাল বিক্রি করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। ধান বা চালের সঠিক মূল্য নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং ধানের দাম সরাসরি কৃষকের বা সহযোগি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করা।

১০. দেশীয় গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া এবং হাস-মুরগীর বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনে সরকারি সেবা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, বিদ্যমান পোল্ট্রি শিল্প ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা বৃদ্ধি করা।

১১. জাটকা মাছ নিধন রোধসহ সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীদের দুর্যোগজনিত পুনর্বাসন কর্মসুচিতে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। ’দাউদকান্দি মডেলে’ হাওড়-বাওড়, বিলাঞ্চলে পরিকল্পিত মৎস চাষে উৎসাহিত করতে মৎসজীবীদের প্রণোদনা ও সক্ষমতা বাড়ানো। ইজারাকৃত মরা নদী ও বিলের পানি শুকিয়ে মাছ আহরণের ফলে ধীরে ধীরে মা মাছ ধ্বংস করে ফেলার প্রবণতা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১২. বীজসহ সকল প্রকার কৃষি উপকরণের বাণিজ্য একচেটিয়াভাবে কোম্পানির হাতে ছেড়ে না দিয়ে বৃহদাংশ বিএডিসির হাতে রাখার জন্য সংস্থাটিকে আরও শক্তিশালী করা।

১৩. জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ইকোসিস্টেমভিত্তিক অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বীজ ও কৌলিক সম্পদ সংরক্ষণে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা ও উদ্যোগ বৃদ্ধি করা।

১৪. মেধাপাচার রোধ করে গবেষণা কার্যক্রম আরও জোড়দার করার জন্য কৃষি গবেষণা ও কৃষি শিক্ষায় বরাদ্ধ বৃদ্ধি করা।

১৫. যে কোনো ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগ-ব্যাধি ও পোকামাকড় কর্তৃক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী, দক্ষ ও কার্যকর ’স্যাটেলাইট-বেজড ডিজিটাল সার্ভিলেন্স ও ফোরকাস্টিং ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের শস্য বীমার আওতায় আনা।

—0—

https://samakal.com/opinion/article/2205113557/

Effects of food price hike on poverty and right to food and nutrition of the low-income people in Bangladesh

Effects of food price hike on poverty and right to food and nutrition of the low-income people in Bangladesh

The price spike of essential foodstuff exists as a dominant and unsolvable problem in Bangladesh decade after decade. Continuous, unprecedented, and excessive rise in the price level of essential foodstuffs is highly detrimental especially to the low-income[1] poor people for their socio-economic interest, both in terms of current wellbeing and future economic development. The real disposable personal income of the poor household and consequently their spending capacity is significantly affected by the shock of price hikes.

The present study was undertaken to understand the effects of price hikes on ‘RTFN’ of the low-income people of Bangladesh as well as reveal the root causes of such price hikes and find out the possible solutions

A total of 438 poor people from 24 low-income professional groups from 19 districts of Bangladesh were randomly interviewed by using the Survey Monkey tool to collect primary data for this study. The secondary data were analyzed and a good number of literatures were reviewed for understanding the trend, root causes, and solution to the problem of price hikes.

The survey data shows that the monthly family income of 24% of the respondents was below BDT 3,000 which was 4% before the COVID-19 pandemic while only 1% of the respondents had an income higher than BDT 10,000 which was 27% before the pandemic that indicates their level of income much below of the national per capita average income (BDT 15,988; HIES, 2016). The family income of the rest of the respondents (69%) ranged between BDT3,000-10,000.

The respondents of the study noticed that the prices of almost all of the major food items went beyond their purchasing power since the middle of the year 2020 when the economic shock of COVID-19 also caused a drastic reduction in their income. During the previous three months of the survey, the staple and most essential foodstuffs such as Rice, Onion, Potato, and vegetables went beyond their purchasing power as opined by 86%, 94%, 91%, and 81% of the respondents respectively. On the other hand, 62% of the respondents had an opinion that the prices of Dal viz. Lentil, Mung bean, etc., and 55% of the respondents opined that the other food items such as fish, meat, egg, and milk, which are the major sources of protein for the poor people, were also too high to afford them. In such a situation only 5% of the respondents could manage to purchase the same amount of food that they could purchase before the price hike while the rest 95% of the respondents had to purchase a little less (32%) and much less (63%) amount compared to the normal price situation.

About 99% of the respondent opined that they had to cut expenditures for other basic needs either often (65%) or sometimes (34%) due to the price hike. Most of the households had to adjust their increased food cost by cutting costs of other basic needs such as clothing (77%), treatment costs (56%), education costs (40%), and another cost (73%).

In order to meet the extra expenditures for food due to price hikes, the households have often to take loans from microcredit NGOs or local money lenders with high rates of interest. It was found from the survey that 52% of the households had to take loans during the last month may be due to price hikes. The average amount of loan was BDT22,076 which ranged between BDT3,500-50,000. Thus the food price hike throws the poor people under a huge burden of debt.

About 93% of the respondents said that they could take three meals a day before the price hike which is reduced to 60% due to the price hike. On the contrary, before the price hike, only 5% of the respondents used to take two meals a day which was increased to 40% due to the price hike. About 35% of the respondents had to spend a day without any food sometimes while 20% of the respondents said that often they had to spend a day with an empty stomach which indicates their worse situation of accessibility to food.

Open Market Sale (OMS) run by the TCB seems to be a major instrument for the government in managing food accessibility for the poor people as well as controlling the price hike. But from the survey, it was frustratingly found that 78% of the respondents didn’t buy any food from OMS within the previous month of the study despite running the OMS at that time which indicates the lower effectiveness of the OMS service in ensuring the benefit of the program for the poor people.

In response to the query about the reasons for not buying food from OMS the highest 25% of the respondents said that they didn’t know the place where the OMS sales take place while the second-highest 21% of the respondents said that the supply in the OMS was not adequate compared to the demand, so food was not available to them.

As per the analysis in this study, the major causes for the unprecedented price hike in Bangladesh are unpredictable production loss due to the natural disasters; creation of artificial supply scarcity by the traders; the failure of market regulatory bodies due to lack of enough capacity & policy instruments, corruption or other vested interest; lack of authentic demand and supply data to prepare appropriate production and import plan; panic purchase by the consumers etc.

Formation of price commission, strengthening the capacity of TCB, Efficient supply management by managing domestic production and import, and strengthening coordination mechanism among the relevant government institutions are necessary for keeping the prices stable while rationing of essential foodstuff for the poor could be a good option to increase access to food for the poor not only for the price hike period but also ensuring the realization of their RTFN sustainably.

But, it is interesting to note that though too small but still 2% of the respondents opined that there is no responsibility of the government in combating food scarcity and price hikes while 19% of the respondents do not know whether the government has any role to play through the government is constitutionally responsible for ensuring the food for all as a basic need of every citizen. Therefore, the government seems to handle such a crucial issue of price hike in a very relaxed mode as there is no legal obligation in absence of a right to food law in Bangladesh to respect, protect and fulfill such important basic human rights of the people in general and poor & hungry people in particular.

[1] Low-income group: The people having a monthly HH income lower than the national average HH income of BDT15,988 according to HIES, 2016 have been considered a low-income group for the study. The people who are mainly living from hand to mouth, marginal farmers, low-paid labor, daily wage earners, floating people who earn from doing small business on the street, maidservants,s, etc. especially living in the urban slums being migrated from the rural areas are considered as a low-income group for the study.