খাদ্য নিরাপত্তা শুধু ক্ষুধা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সহজলভ্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য প্রয়োজনীয় দুষণমুক্ত খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তাই হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। অর্থাৎ একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক এবং অন্য কোন দুষণ থেকে মুক্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য পাবে। অন্যদিকে, খাদ্য শুধু একটি পণ্য নয় বরং এটি কোন একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি তথা জীবনাচারের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তাকে অনেকে একটি স্থিতিশীল খাদ্য উৎপাদন ও সুষম বন্টন ব্যবস্থা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি একটি শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পৃক্ত বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। এরূপ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের (যেমন: কৃষি জমি, বীজ, সার, পানি, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, জ্ঞান ইত্যাদি) উপর উৎপাদকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারকে নিশ্চিত করবে। অথচ আজকাল বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে কেবল দানাদার খাদ্যশস্যের সহজলভ্যতাকেই বুঝানো হচ্ছে। শুধু দানাদার খাদ্য দিয়ে যেমন মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় তেমনি বর্তমান রাসায়নিক কৃষির মাধ্যমে বিষমুক্ত খাদ্যের যোগান দেওয়াও অসম্ভব। পক্ষান্তরে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে, বর্তমান কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিজমি, বীজ, সেচের পানি, কৃষকের নিজস্ব জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অন্যান্য উপকরণ ইত্যাদি সবই আজ কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। প্রকারান্তরে গোটা কৃষি ব্যবস্থাই আজ কৃষকের হাতছাড়া যাচ্ছে যা শুধু কৃষকেরই নয় গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

কৃষি খাদ্যের বাণিজ্যিকীকরণ কার স্বার্থে

খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য এসবই মানুষের মৌলিক অধিকার। ধনী-গরীব নির্বিশেষে এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার মত ন্যুনতম পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ খাদ্য ও পানি পাওয়ার অধিকার আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অথচ প্রায় ৬০০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ পৃথিবীর ১০০ কোটির বেশি মানুষই তাদের খাদ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। তদুপরি, আজ খাদ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। খাদ্যের উপর কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে কোম্পানির মুনাফার অনন্ত ক্ষুধার আগুনে কোটি মানুষের খেয়ে বাঁচার অধিকার যে দগ্ধ হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

খাদ্য প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান। আর মানুষ প্রকৃতিরই সন্তান। সকল যুগেই এই বিশ্বের সকল মানুষ এবং অন্য সকল প্রাণির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রকৃতির মধ্যেই ছিল, প্রকৃতির মধ্যেই আছে। কিন্তু খাদ্যের অসম বন্টন ব্যবস্থার কারণেই সকল দেশে সকল যুগে বিপুল সংখ্যক মানুষ খাদ্য থেকে বঞ্চিত থেকেছে। একসময় মানুষ কোনরূপ উৎপাদন ছাড়াই প্রকৃতি থেকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতো। কিন্তু জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির কারণে মানুষকে খাদ্য উৎপাদন শুরু করতে হয়েছে এবং কালক্রমে তা বাণিজ্যের পণ্য হয়ে উঠেছে। আগে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই অধিকাংশ খাদ্য উৎপাদিত ও ক্রয়-বিক্রয় হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে খাদ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে খাদ্য শুধু নিছক বাণিজ্যের পণ্য নয় বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিরই একটি বড় নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। কৃষিপ্রধান দেশ না হয়েও খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে উত্তরের ধনী দেশগুলো। আর এ কাজে মূল ভূমিকা পালন করছে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সংস্করণ সেসব দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। যেহেতু কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন তাই খাদ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণভার এসব বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বন্টন পরিস্থিতি

এদেশে খাদ্য বলতে শুধু দানাজাতীয় খাদ্যকেই (চাল ও গম) হিসেবের মধ্যে ধরা হয় যা একটি চরম ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, দানাদার খাদ্যশস্য মানুষের প্রধান খাদ্য হলেও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে মানবদেহের পুষ্টির জন্য অত্যাবশ্যক সকল খাদ্যকেই বিবেচনায় নেওয়া জরুরী। তদুপরি, দেশের দানাজাতীয় খাদ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিসংখ্যানগত তথ্য নিয়েও মারাতœক বিভ্রাট লক্ষ করা যায় যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। প্রথমতঃ হালনাগাদ তথ্যের প্রাপ্যতা বিশেষ করে খাদ্য চাহিদাগত তথ্য মোটেও সহজলভ্য নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইট এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের ওয়েবসাইটের কোথাও খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদাগতÍ কোন তথ্য সহজলভ্য নয় যা এদেশের পরিকল্পনা প্রণয়নে দৈন্যদশার চিত্রই ফুটে উঠে। দ্বিতীয়তঃ যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় সেখানে কোন একটি উৎসের তথ্যের সাথে অপর কোন উৎসের তথ্যের ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তৃতীয়তঃ নির্দিষ্ট বছরের জনসংখ্যা এবং মাথাপিছু খাদ্যের চাহিদা থেকে দেশের মোট খাদ্য চাহিদা হিসাব করা হয়। কিন্তু, জনসংখ্যা ও মাথাপিছু খাদ্য চাহিদা নিয়েও রয়েছে বিরাট তথ্য বিভ্রাট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ২০১০ সালে দেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬০ লক্ষ যদিও অনেকের মতে এটা ১৫ কোটি, কারও মতে ১৬ কোটি। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আদর্শ মান অনুসারে মাথাপিছু দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রতিদিন ৩৯৭ গ্রাম এবং প্রকৃত গ্রহণ ৫০০ গ্রাম। পক্ষান্তরে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসেবমতে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু ৫০৪ গ্রাম (যদি মোট ২৪০০ কিলোক্যালরির ৭৫% দানাদার খাদ্য থেকে পেতে হয়) দানাদার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে যদিও কোন কোন হিসাব মতে এই পরিমাণ আরও অনেক বেশি। এখন আমরা যদি দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি এবং মাথাপিছু দানাদার খাদ্যের চাহিদা ৫০৪ গ্রাম ধরি তবে ২০০৯-১০ অর্থ বছরের জন্য দেশের খাদ্য চাহিদা দাড়ায় ২৯৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অথচ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১০ অনুসারে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল ৩৬৯ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ব থাকার কথা। অথচ ঐ বছরেই আরও প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য আমদানী করা হয়েছে এবং বিদেশী সাহায্য হিসেবে এসেছে আরও ৬০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য। অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে দানাদার খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল সর্বমোট ৩৯৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এই পরিমাণ খাদ্য যদি বাংলাদেশের মানুষ খেয়ে থাকে তবে প্রত্যেক মানুষ প্রতিদিন ৬৭৪ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করেছে যা থেকে প্রত্যেকে ২৪০৬ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়ার কথা যেখানে দারিদ্রসীমা হল ২১২২ কিলোক্যালরি !!! এই হিসাব যদি সত্য হয় তবে বাংলাদেশের দারিদ্র সত্যি সত্যিই যাদুঘরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তবুও পরিসংখ্যানের হিসাবে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৪০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। খাদ্যের অসম বন্টন ব্যবস্থাই এর মূল কারণ। সুতরাং এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, খাদ্য থাকলেই সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। কাজেই এ মুহুর্তে যেকোন প্রকারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষযুক্ত দানাদার খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে বন্টন ব্যবস্থাকে ক্রুটিমুক্ত করা এবং শস্য বহুমুখীকরণের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপরোক্ত হিসাব যদি সঠিক হয় তবে আগামী ৩০-৩৫ বছর উৎপাদন না বাড়লেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

আমাদের খাদ্যাভ্যাস খাদ্য নিরাপত্তা

আমাদের খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত, অবৈজ্ঞানিক ও হাজারো ভুল অভ্যাসে ঠাসা। যদিও খাদ্য গ্রহণের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা, কিন্তু এ দেশের মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে একেবারেই উদরপূর্তি ও রসনা তৃপ্তিকে প্রাধান্য দিয়ে। পুষ্টি সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবে যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এদেশের মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, শিক্ষিত এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও পুষ্টি জ্ঞান ও পুষ্টি সচেতনতার অভাব লক্ষণীয়।

আমরা ভেতো বাঙ্গালি, খাদ্য বলতে শুধু ভাতকেই বুঝে থাকি। বার্মা ও ভিয়েতনামের পর আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাতখেকো জাতি। অন্যান্য দেশ, যেখানে ভাত প্রধান খাদ্য, সেখানেও মানুষ ভাত বেশি খায় তবে আমাদের থেকে অনেক কম। ইন্দেনেশিয়ায় একজন লোক বছরে গড়ে ১৫২ কেজি, ফিলিপাইনে ১১০ কেজি, চীনে ১০৩ কেজি এবং ভারতে ৭৯ কেজি চালের ভাত খায়। আর আমরা খাই ১৮৩ কেজি চালের ভাত। আমাদের খাদ্য গ্রহণের প্রধান লক্ষ্য থাকে কী করে মুখরোচক উপকরণ মিশিয়ে উদরপূর্তি করে ভাত খাওয়া যায়। আমাদের দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রতিদিন মাথাপিছু ৩৯৭ গ্রাম চালের ভাত অথচ আমরা খাই ৫০৪ গ্রামেরও বেশী। অন্যদিকে, আমাদের শাক-সব্জির চাহিদা প্রতিদিন মাথাপিছু ২১৩ গ্রাম অথচ আমরা খাই মাত্র ৫৩ গ্রাম। এক্ষেত্রে শুধু শাক-সব্জির অভাব বা দারিদ্রতা নয়, আমাদের সচেতনতার অভাবই প্রধানত দায়ী।

পুষ্টিকর ভাল খাদ্য বলতে আমরা মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বিদেশী জাতের শাক-সব্জি ও ফলমূল ইত্যাদি দামী খাবারকেই বুঝে থাকি যা একবারেই সঠিক নয়। আমরা যেদিন ভাল খাবারের আয়োজন করি সেখানে মাছ, কয়েক ধরণের মাংস, ডিম, দুধ বা দই এসবকিছু একসাথে খেয়ে উদর ঠেসে পূর্ণ করি যা একদিকে অর্থের অপচয় অন্যদিকে তেমনি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই আমরা মনে করে থাকি যে, বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের পক্ষে এসব খাবার কিনে খাওয়া সম্ভব নয় তাই তারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। প্রকৃত প্রস্তাবে, পুষ্টিকর খাদ্য বা ক্রয় ক্ষমতার অভাব নয় বরং পুষ্টি সম্পর্কে আমাদের চরম অজ্ঞতা ও অসচেতনতা এবং মিথ্যা আভিজাত্যের ভড়ংই এদেশের মানুষের পুষ্টিহীনতার প্রধান কারণ। খাদ্য সাহায্যের জন্য বিদেশীদের কাছে ভিক্ষা মাগতে আমাদের লজ্জাবোধ হয়না কিন্তু কচুর মত অত্যন্ত পুষ্টিকর শাক খেলে আমাদের মান-সন্মান থাকে না। বিভিন্ন প্রকার কচু ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে থানকুনি, তেলাকুচা, পিপুল, আমরুল, সজনে পাতা, বথুয়া, পুনর্ণভা, শান্তি শাক, নটে শাক, হেলেঞ্চা, গনোরি, কলমি, গ্যাটকল ইত্যাদি অসংখ্য শাক-সব্জি পাওয়া যায় যেগুলো চাষ করতে হয়না এবং এসব শাক-সব্জিতে কোন প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক সার বা কীটনাশকও থাকে না। অথচ পুষ্টি মানের দিক থেকে যেকোন দামী শাক-সব্জি থেকে এগুলো কোন অংশে কম নয়। তদুপরি এগুলোর রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। অথচ, আজ এদেশের মানুষের ভিটামিনের অভাব দূর করে অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ধানের মধ্যে ভিটামিন-এ ঢুকিয়ে আমাদের ভিটামিনের অভাব দূর করার এক হাস্যকর যুক্তি দেখিয়ে ‘গোল্ডেন রাইস’ তৈরি করা হচ্ছে। গোল্ডেন রাইসের ভাত খেয়ে যদি ভিটামিন-এ এর অভাব দূর করতে হয় তবে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক গড়ে প্রায় ৭.৫ কেজি চালের ভাত খেতে হবে তাও যদি শরীর সবটা হজম করতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম গোল্ডেন রাইস থেকে মাত্র ৩০ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন বা ভিটামিন-এ পাওয়া যাবে। অথচ, আমাদের দেশী জাতের লাল চালেও এর চেয়ে আনেক বেশি বিটাক্যারোটিন আছে যেসব ধান আজ বিলুপ্তির পথে। বনে-বাদাড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা ১০০ গ্রাম হেলেঞ্চা শাকে ১৩৭০০ মাইক্রোগ্রাম, থানকুনি শাকে ১৩১০০ মাইক্রোগ্রাম, কলমী শাকে ১০৭৪০ মাইক্রোগ্রাম, কালোকচু শাকে ১২০০০ মাইক্রোগ্রাম এবং সবুজকচু শাকে ১০২৭৮ মাইক্রোগ্রাম বিটাক্যারোটিন আছে। যেসব গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে গোল্ডেন রাইস তৈরি করা হচ্ছে তাদের আশেপাশে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এরূপ অসংখ্য খাদ্যবস্তু রয়েছে যা অসচেতনতার জন্য মানুষ খায়না।

অনুরূপভাবে আতা, শরিফা, বেল, কদবেল, পেয়ারা, আমড়া, কামরাঙ্গা, কাঠাল, পেপে, জাম, জামরুল, সফেদা, আমলকি, তেতুল, কুল, ডালিম ইত্যাদি বহু ধরণের দেশী ফল পুষ্টিমানের বিচারে কমলা, আপেল, আঙ্গুর, বেদানা ইত্যাদি যেকোন বিদেশী ফল থেকে কোন অংশেই কম নয়। তা ছাড়া এসব বিদেশী ফলমূল সংরক্ষণে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করা হয় যা আমরা সবাই জানি। অথচ আমরা আভিজাত্যের মিথ্যা অহংকার দেখাতে গিয়ে এসব দেশী ফলগুলোকে হেলাফেলা করি যা একবারে মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আজ এরূপ মিথ্যা অহংকারভরা মুর্খতা আমাদের মন-মগজে চেপে বসেছে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে অযথাই হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, তুলে দিচ্ছে কোম্পানির হাতে। কাজেই আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষের পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া।

খাদ্যের ঘাতক রূপ এবং খাদ্য নিরাপত্তা

যে খাদ্য আমাদেরকে সুস্থ্য রাখবে, আমাদের জীবন বাঁচাবে সে খাদ্যই আজ আমাদের নানারকম রোগ-ব্যাধি ও প্রাণনাশের বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেহের পুষ্টির চাহিদা মিটানোর জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক-সব্জি ও ফলমূলসহ সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত— জরুরী। কিন্তু আমরা খাদ্য গ্রহণের নামে প্রতিদিন জেনে বা না জেনে বিষ সেবন করে চলেছি। কারণ, শাক-সব্জি ও ফলমূলসহ এসব খাদ্যে উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মিশানো হচ্ছে নানাবিধ বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য। আধুনিক জাতের উচ্চফলনশীল, হাইব্রিড ও জিএম শাক-সব্জিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদন করতে গিয়ে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি। খাদ্যের সাথে এসবই আমাদের দেহে ঢুকছে। আবার, এসব শাকসব্জি ও ফলমূল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ এবং ফলমূল পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বাইড ও ইথারেলসহ নানাবিধ বিষাক্ত পদার্থ। মাছ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য শাকসব্জি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রঞ্জক দ্রব্য। ফলে, একদিকে যেমন আমাদের দেহে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি দেখা দিচ্ছে অন্যদিকে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কালও হ্রাস পাচ্ছে। আজ আমরা বাধ্য হচ্ছি বাবা বা মা হয়ে প্রাণপ্রিয় সন্তানের মুখে স্বহস্থে বিষ তুলে দিতে-এর চেয়ে অসহায় অবস্থা আর কী হতে পারে!

পানির বাণিজ্যিকীকরণ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আরেক হুমকি 

খাদ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি। তাই, খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করাও জরুরী। অথচ, নিরাপদ পানির ক্রমবর্ধমান সংকট আজ সারাবিশ্বে কোটি কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। চিন্তাবিদদের এই আশংকা মোটেই অমূলক নয় যে, পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে তা হবে পানি নিয়েই। প্রকৃতির পানিকে দুষিত করে বিত্তশালীরা এখন মিনারেল ওয়াটারের দিকে ঝুঁকছে। আগামী দিনে পানিই হবে মহামূল্যবান পণ্য। এই গরীব দেশেই পানি আজ দুধের দামকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ পেটের দায়ে নিজের গাভীর দুধ নিজেই খেতে পারেনা সে উচ্চমূল্যে পানি কিনে খেতে পারবে এমনটা ভাবাই অবান্তর। অথচ বাস্তবে তাই ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমানে আর্সেনিক দুষণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে যে পানি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত খাচ্ছে। দুষিত পানি পান করে ধুকে ধুকে মরা অথবা পানিবিহীন মরা অর্থাৎ মৃত্যুই যেন আমাদের নিশ্চিত পরিণতি।

পানি সংকট এখন জলবায়ুগত ও রাজনৈতিক ইস্যু। বিজ্ঞানীদের ধারণা বিশ্বব্যাপী পানি স্বল্পতার শতকরা ২০ ভাগের জন্য দায়ী হবে জলবায়ু পরিবর্তন। বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই নিরাপদ পানির মারাতœক সংকট দেখা দিবে। নিরাপদ পানি স্বল্পতার আর একটি প্রধান কারণ পরিবেশ দুষণ। কারণ, প্রতিবছর দুই মিলিয়ন টন শিল্পবর্জ্য ও রাসায়নিক দ্রব্য, মানববর্জ্য, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পানিতে মিশছে (ইউএনডব্লিওএফপি ২০০৩)। গরীবরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ, উন্নয়নশীল দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই এই দুষিত পানি ব্যবহার করছে।

বর্তমানে পানি ব্যবসায়ী কোম্পানীগুলো বিশ্বের মাত্র ৫% জনসংখ্যার পানির চাহিদা মেটাচ্ছে আর তাতেই মাত্র চারটি বৃহৎ কোম্পানির ২০০১ সালের মোট আয় ছিল ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই সারা বিশ্বের পানিখাত বেসরকারীকরণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বহুজাতিক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। উন্নয়নশীল দেশসমূহের পানি নীতিকে বেসরকারীকরণের অনুকূল করার জন্য ঋণের সাথে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়ে এসব সংস্থা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। আর সেবাখাত উদারীকরণ চুক্তির (গ্যাটস) মাধ্যমে পানিখাত বেসরকারীকরণের সকল বাধা দূর করছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর চাপে মোজাম্বিক, বেনিন, নাইজার, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, ক্যামেরন এবং কেনিয়াসহ বেশকিছু দেশ ইতোমধ্যেই তাদের পানিখাত বেসরকারীকরণ করতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই, এ ব্যাপারে সময়মত সাবধান হওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

আশু করণীয়

আজ এদেশের কৃষি ও কৃষকের এরূপ সংকট মোকাবেলা করা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যার কারিগরি কৌশল হবে জৈব কৃষি চর্চা। কিন্তু বাংলাদেশের মত একটি জনবহুল দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া জৈব কৃষির পক্ষে আদৌ সম্ভব কি-না তা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে অনেকের মাঝেই যথেষ্ট সন্দেহ লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে, গত ৩-৫ মে ২০০৭ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ““Organic Agriculture and Food Security”” শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞদের অভিব্যক্তি প্রনিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে যে, জৈব কৃষি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। বিজ্ঞানী Badgley et. al. 2007;  Halberg et. al. 2006; সাম্প্রতিককালে একটি তাত্ত্বিক মডেল দিয়েছেন যাতে দেখানো হয়েছে যে, এই মডেলের ব্যবহার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বর্তমানের মোট আবাদী জমির পরিমান ও ফলন না বাড়িয়েও জৈব কৃষির মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিদিন ২৬৪০ থেকে ৪৩৮০ কিলোক্যালরি খাদ্য যোগান দেওয়া সম্ভব।

জৈব কৃষি চর্চার মাধ্যমে এদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় – এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তারা প্রকৃতপক্ষে চলমান ভোগবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটেই এমনটি করেন। যেমন: রোজার শিক্ষা হল সংযম বা ভোগকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাই যদি হয় তবে সঙ্গত কারণেই রমজান মাসে ভোগ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, রমজান মাসে আমাদের ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। অথচ দ্রব্যমূল্য নিয়ে হৈচৈ করার চেয়ে  আমাদের ভোগ নিয়ন্ত্রণ করা অধিক জরুরী।

অন্যদিকে, আমরা জানি, উদ্ভিদই কেবল নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে। কাজেই এই বিশ্বভ্রহ্মান্ডের সকল জীবই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এখন যে পোকামাকড় এই উদ্ভিদ (মাঠ ফসল, ফলজ ও বনজ বৃক্ষ ইত্যাদি) থেকে খাদ্য শিকলে খাদ্য সরবরাহের কাজটি করে তাকে শক্রু জ্ঞান করে কীটনাশক প্রয়োগ করে ধ্বংস করার ফলে গোটা খাদ্য-জাল বিঘিœত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে বিশ্বভ্রহ্মান্ডের জীববৈচিত্র্য। কাজেই, ফসল রক্ষার প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করছে তা একমাত্র মানুষের ভোগের জন্যই নয়। কাজেই, স্থায়িত্বশীল কৃষি প্রকৃতপক্ষে একটি দর্শন যা সাদামাটাভাবে ফসলের ফলন বা পরিমানগত উৎপাদন দিয়ে বিচার করলে চলবে না।

তা ছাড়া, জৈব কৃষি চর্চায় ফসলের ফলন কমবে সে ধারণাও অমূলক। আজকে যারা জৈব কৃষিকে অসম্ভব মনে করছেন তারা আসলে বর্তমান প্রচলিত কৃষির ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও সংকটের প্রেক্ষাপটেই এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন। গত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে রাসায়নিক কৃষি চর্চার ফলে আমাদের মাটি, পরিবেশ, ইকো-সিস্টেম এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার যে রূপান্তর ঘটেছে সেখানে শুধু টনের হিসেবে জৈব সার প্রয়োগ করেই রাতারাতি ফলাফল প্রত্যাশা করাটাই অযৌক্তিক। এজন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও ফসলের ইকোসিস্টেম পুণঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জৈব কৃষি চর্চায় উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে ফসলের সার্বিক ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার উপর। মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, ফসল ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, পোকা-মাকড় ও অন্যান্য বালাই ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজগুলো দক্ষতার সাথে করতে পারলে জৈব কৃষিতে শুধু স্থায়িত্বশীল ফলনই নিশ্চিত হবেনা, উৎপাদনশীলতা এবং সার্বিক লাভও বৃদ্ধি পাবে। আর এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বান্তবায়ন করা।