সাতসকালে বাচ্চা বয়সী ছেলেমেয়েসহ এক কর্ষণজীবী নেমেছেন জমি কর্ষণে। ভূট্টার বীজ ফেলে তিন বছর বয়সী ছেলেকে মইয়ে বসিয়ে জমি সমান করছিলেন তিনি। চলতিপথে তাঁদের দেখে শৈশব স্মৃতি জাগরিত হলো। বাইক থামিয়ে ছবি তুললাম। কাজ থামিয়ে উনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে এই কৃষকের জীবনের গল্পটা ইচ্ছে থাকলেও শোনা হয়নি। চলতি পথে আমারও সময়ের অভাব ছিল। অবশ্য সেটা যে খুব দরকারি ছিল তাও নয়। কারণ, কৃষক পরিবারের গল্পগুলো প্রায় এক এবং অভিন্ন। কৃষক পরিবারের সন্তান, কৃষিবিজ্ঞানের ছাত্র এবং প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে কৃষকদের সাথে কাজ করার সুবাধে এমন শতশত গল্প জানা। ছেলেটার স্কুলে যাবার বয়স হয়নি এখনও তাই জিজ্ঞেসও করা হয়নি। মেয়েটার বয়স দশ কী এগার হবে। তাই শুধু জানতে চাইলাম মেয়েটা স্কুলে যায় কিনা। উত্তরে হ্যা সূচক জবাব দিলেও অনুমান করতে কষ্ট হয়না যে পড়াশুনা খুব বেশিদূর এগুবেনা। এক কমিউনিটি মিটিং-এ নারী শিক্ষার ব্যাপারে জানতে চাইলে অনেকে হতাশাভরে বলেছিলেন, “লেখাপড়া শিখিয়ে কি লাভ হবে, গরীবের চাকরি হয়না কারণ ঘুষ দিতে পারেনা”। বলাবাহুল্য, বাল্যবিবাহ রোধে গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় অনেক সাফল্য এলেও এই প্রকট সমস্যাটা সমাজ থেকে দূরীভূত হওয়া দূরে থাকুক করোনার কারণে আরও পশ্চাতপদ হয়েছে।
আমার সঙ্গী ছিলেন ড. ভল্কার কাশ নামের একজন জার্মান ভদ্রলোক। বয়স বাহাত্তর। উনার জন্ম জার্মানির এক কৃষক পরিবারে। অটো থামিয়ে আমাকে নামতে দেখে উনিও নেমে এলেন। আগ্রহভরে দেখলেন এবং উনার বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। উনার শৈশবের স্মৃতি প্রায় সত্তর বছরের পুরনো যখন সবুজ বিপ্লবের সূচনাকাল চলছে। উনার কথা থেকে জানা গেলো যে সেসময় জার্মানির পারিবারিক কৃষিও প্রায় আমাদের এখনকার কৃষির মতই ছিল। সেসময় পারিবারিক কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ছোয়া সবে লাগতে শুরু করেছে। উনিও কিভাবে শৈশবে পারিবারিক কৃষির সাথে যুক্ত ছিলেন সেসব স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন। আমিও চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর আগেকার শৈশবে ফিরে গেলাম যখন ধান, পাট, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, পাকা মরিচ, সরিষা, শাকসব্জীসহ নানান ফসল মাড়াই করার কাজে আমিও মনের আনন্দেই যুক্ত হতাম। মইয়ে চড়া, ধান মলন দেওয়া – এগুলো ছিল খুব মজার কাজ। শখ করে কয়েকবার গরুর লাঙ্গল চালানোর দীক্ষাও নিতে চেয়েছি। কিন্তু এর জন্য একটু বেশিই কসরত প্রয়োজন ছিলো বিধায় বেশিদূর এগুনো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাশে অবশ্য ট্রাক্টর চালানো শিখতে হয়েছিলো। আমাদের পারিবারিক কৃষিটা এমনই ছিল যা এখনো অনেকটাই বিরাজমান। কিন্তু ড. কাশের ছোটবেলার পারিবারিক কৃষি আর এখনকার পারিবারিক কৃষির মধ্যে বিস্তর ফারাক।
উল্লেখ্য যে, এই মূহুর্তে বিশ্বে জাতিসংঘ ঘোষিত পারিবারিক-কৃষি-দশক চলছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৯-২০২৮ সাল পর্যন্ত পারিবারিক কৃষি দশক ঘোষনা করেছে যার লক্ষ্য হল একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে পারিবারিক কৃষক হওয়ার অর্থ কী তা নিয়ে নতুন করে আলোকপাত করা এবং ক্ষুধা নির্মূলে এবং ভবিষ্যত খাদ্য ব্যবস্থার রূপায়নে পারিবারিক কৃষি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আগের চেয়ে বেশি করে তুলে ধরা। এফএওর মতে পারিবারিক কৃষি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জীবিকার উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় টেকসই উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। পারিবারিক কৃষকগণ তাঁদের প্রজ্ঞা এবং পৃথিবীর মাটি ও প্রকৃতির প্রতি আন্তরিক যত্নশীলতার মাধ্যমে আমাদের কৃষির ইতিবাচক রূপান্তরের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন যা আমাদের ক্ষুধামুক্তি, আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিস্থাপক পৃথিবী বিনির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
যাহোক, এই দৃশ্য দেখার পর ড. ভল্কার কাশের কাছে প্রশ্ন রাখলাম যে তিনি এটাকে শিশুশ্রম হিসেবে দেখেন কিনা। উত্তরে তিনি একটা মজার বিশ্লেষণ দিলেন যা আমার খুবই পছন্দ হলো। তিনি বললেন, “দেখো এটা এক অর্থে শিশু শ্রম বটে তবে এটাকে তুমি একজন পিতার শিশু দেখাশুনার কাজ হিসেবেও দেখতে পার। তুমি ভেবে দেখ যে, এসময় এই শিশুটির দেখাশুনার জন্য একজন লোক লাগত। হয়ত ওর মাকেই তা করতে হত। কিন্তু এখানে মইয়ের উপর বসে থেকে সে বেশ মজাই পাচ্ছে। আর এই মজার মাধ্যমে প্রকারান্তরে সে তার পিতার কাজে সাহায্যও করছে যা এক ধরণের উইন-উইন সিচুয়েশন”।
বিশ্লেষণটা চমৎকার লাগলো। ঠিকইতো। প্রথমে এটাকে আমার কাছে অমানবিক শিশুশ্রম বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ভল্কারের কথায় চিন্তার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। মন পড়ে ছোটবেলায় আমরা কৃষক পরিবারে যে কাজগুলো করতাম সেগুলো বেশ মজা করেই করতাম। করতে না বললেও স্বেচ্ছায় করতাম। একদিকে একঘেয়ে মুখস্ত বিদ্যা গলাধকরণের মত অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক কাজ (যা এখন আমাদের শিশুদের একমাত্র করণীয়) থেকে মুক্তি আর অন্যদিকে, মাটি আর প্রকৃতির সাথে ফসলের মাঠে কাজ করার আনন্দ – মূলত এই দুই কারণে অনেকসময় অনাহুত হয়েও শ্রেফ মনের আনন্দে কাজে যোগ দিতাম। এখন আমরা জানি প্রতিদিন শারিরীক শ্রম সুস্বাস্থ্যের জন্য কতটা জরুরী। ইদানিং বয়ষ্ক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ কিংবা ডায়াবেটিস রোগীরা যেমন নিষ্ফল হন্টন কিংবা শারিরীক পরিশ্রমের কসরত করেন তা না করে বাল্যকাল থেকে উৎপাদনশীল শারীরিক শ্রমের অভ্যাস করাগেলে গেলে দেহ ও মন উভয়ের ক্ষুধাই মেটানো অনেকাংশেই সম্ভব।
ঠিক এই কাজটাই মাটি এনজিওর ইকো-স্কুলে শিশুদের শেখানোর এবং চর্চায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রেও শিশু-কিশোর-যুবকদের নিয়ে আদর্শ গ্রাম বিনির্মানে ঠিক এই চিন্তাটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। স্কুল পর্যায়ে পুষ্টি বাগান করার কাজে ছাত্রছাত্রীদেরকে যুক্ত করার মাধ্যমে এই কাজটি সহজেই করা যায়। পাশাপাশি, গ্রাম পর্যায়ে বসতভিটায় সব্জি, ফল ও ফুলবাগান এবং শহর পর্যায়ে ছাদবাগান কিংবা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের খোলা জায়গায় পুষ্টিবাগান করা এবং বৃক্ষরোপন ছেলেমেয়েদের পাঠ্যক্রমের অংশ করা এবং তা একাডেমিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে এই জরুরী চিন্তার সফল বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
যাহোক, জার্মানির পটেটো হলিডের গল্পটা বলে এ লেখার ইতি টানা যাক। ড. ভল্কার কাশের বাল্যকালে জমি থেকে গোলআলু তোলার কাজে পরিবারকে সহায়তা করতে এক সপ্তাহের মৌসুমী ছুটি দেওয়া হত যা “পটেটো হলিডে” নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শহর-গ্রাম সকল স্কুলই এসময় বন্ধ থাকত। সব শিশুরাই যে আলু তোলার কাজ করত এমন নয়, অন্য কাজও করত। মূলত তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই ছুটি চালু হয়েছিল। প্রথমত শ্রমিক সংকটের সেকালে কৃষকদের কাজে সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে শিশুদেরকে উৎসাহিত করা। এবং তৃতীয়ত প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে কর্মক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করা। কৃষির রূপান্তর এবং যান্ত্রিকীকরণের কারণে পটেটো হলিডের উপযোগিতা এখন আর না থাকলেও ছুটিটা এখনও বহাল আছে। পরিকল্পিতভাবে শৈশব থেকে শিশুদেরকে কৃষির উপযুক্ত কাজগুলোর সাথে আমাদের শিশুদেরকে যুক্ত করার মাধ্যমে শুধু শিশুদেরই নয় দেশেরও বহুমূখী কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
#family #farming
#পারিবারিক #কৃষি