ভূমিকা
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ভোক্তাদের কাছে মাত্র কয়েকটি জৈবপণ্য বিক্রির ছোট্ট একটি দোকান দিয়ে” হানসালিম” নামে যে সাপ্লাই চেইনের যাত্রা শুরু হয়েছিল সাড়ে তিন দশকের ব্যবধানে তা আজ দক্ষিণ কোরিয়ায় জৈব কৃষক এবং ভোক্তাদের সর্ববৃহৎ ফেডারেশনে পরিণত হয়েছে। শুধু কোরিয়তেই নয়, এটি আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জৈব ভোক্তা সমবায় যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ এবং এটি বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রি করে থাকে।
হানসালিম মডেলের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এটি কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে সরাসরি এবং কার্যকর যোগসূত্র স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। কৃষককেরা তাঁদের উৎপাদিত জৈব খাদ্যপণ্য হানসালিম বিক্রয়-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌছে দেয়। হানসালিম মডেল মূলত কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যেখানে কৃষক যেমন ভোক্তার স্বাস্থ্যের দ্বায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নিয়েছে তেমনি ভোক্তাও গ্রহণ করেছে কৃষকের জীবন-জীবিকার দ্বায়িত্বভার।
হানসালিম মডেলের অন্তর্ভূক্ত কৃষক এবং ভোক্তার রয়েছে অভিন্ন এক লক্ষ্য – শুধু একা নয় সবাই মিলে ভালো থাকা। কেবল নিজেদের জীবন নয়, এই পৃথিবী ও প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচাতে তাঁদের রয়েছে সম্মিলিত প্রচেষ্টা যা তাঁরা শুধু কথায় নয় তাঁদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে এর প্রতিফলন ঘটায়। আজকাল অনেকে জৈব কৃষিকে শুধু অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে দেখে থাকে। কিন্তু হানসালিম পরিবারের কাছে জৈব কৃষি হলো শুধু কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা নয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে দায়িত্বশীল সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমও বটে।
সৃষ্টির প্রেক্ষাপট
১৯৮৬ সালের কথা। সেসময় সারাবিশ্বের মত দক্ষিণ কোরিয়াতেও মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ন্ত্রিত খোলা বাজার ব্যবস্থার এক উত্তাল ঢেউ লেগেছিল যার প্রভাবে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়েই চরম বিপাকের মধ্যে নিপতিত হয়। পাশাপাশি, বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি গ্রহণের ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিলুপ্তির শঙ্কার মুখোমখি হয়। একদিকে যেমন কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে থাকে অন্যদিকে, রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক দ্বারা উৎপাদিত ও আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দৌরাত্মে ভোক্তাগণও দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিপন্নতার কবলে পড়ে মানবস্বাস্থ্য। দেশজ কৃষির স্থলে তথাকথিত আধুনিক কৃষি প্রবর্তনের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পরিবেশ। অবস্থাটা ঠিক যেন আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে হুবহু মিলে যায়। এমনি এক পরিস্থিতিতে মি. পার্ক জাই ইল নামক একজন সমাজকর্মী যিনি হানসালিমের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন তিনি সিউলে ”হানসালিম সংসান” নামে ছোট একটি দোকান খুলেন যেখানে তিনি বিষমুক্ত চাল, তিলের তেল, উর্বর ডিম, মাল্টিগ্রেইন (বেশ কয়টি দানাদার খাদ্যের মিশ্রণে তৈরি এক ধরণের খাবার) ইত্যাদি হাতেগোনা কয়েকটি পণ্যের বিক্রয় শুরু করেন। ভোক্তাগণ ক্রমশ এই দোকানের নিরাপদ পণ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলে ১৯৮৮ সালে গড়ে উঠে হানসালিম ভোক্তা সমবায়। এরপর ক্রমাগতভাবে এই সমবায়ের প্রসার ঘটতে থাকে যা আজও সমান তালে অগ্রসরমান।
প্রসার ও প্রভাব
হানসালিমের প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ কোরিয়ায় জৈব কৃষির উন্নয়ন এবং জৈব কৃষি সমবায় সম্পসারণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয় এটা কোরিয়ার অন্যান্য সমবায়ের জন্য অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছে যেখানে বর্তমানে চারটি বৃহৎ কোঅপারিটেভ কোরিয়ার জৈব পণ্যের বাজারের প্রায় ৩০% দখল করে আছে। হানসালিমের সদস্যদের দ্বারাই সমষ্টিগত উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাত্র ১০০ জন কর্মচারি ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল সাপ্লাই চেইন পরিচালনা করছে। কর্মী সংগঠন তিনটি নীতিতে পরিচালিত হয় – ১) একত্রে বিনিয়োগ, ২) একত্রে কাজ করা এবং ৩) একত্রে ব্যবস্থাপনা করা।
হানসালিমের কর্মীগণ কৃষির প্রকৃত মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্দি করতে এবং কৃষির স্থায়িত্বশীলতার জন্য জৈব কৃষি চর্চায় কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি, তারা এটা উপলব্ধি করেছিলো যে, বিদ্যমান খাদ্য ব্যবস্থায় কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের নানাবিধ সমস্যা এবং সংকট সমাধানে মধ্যস্বত্বভোগি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী। এরূপ চিন্তা থেকেই তারা কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে একটি বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় যেখানে সাপ্লাই চেইন-এর ব্যবস্থাপনাগত ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে কৃষককে সর্বোচ্চ পরিমাণ লভ্যাংশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
কর্মপদ্ধতি
ভোক্তাগণই হানসালিমের প্রকৃত মালিক, অন্যান্য কোম্পানির মত শ্রেফ তথাকথিত “প্রিয় গ্রাহক” নন। উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠা নিবিঢ় হৃদ্ধতাপূর্ণ স্থায়ি এক সুসম্পর্কই হানসালিমের মূল চালিকাশক্তি এবং সকল সাফল্যে মূলমন্ত্র। সদস্যদের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত একটি পরিচালনা পরিষদ প্রতিষ্ঠানের সকল নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করে থাকে। সারাদেশের ২০টি স্থানীয় হানসালিম একইভাবে পরিচালিত হয়। পণ্যের আদর্শ গুণমান নির্ধারণ, পণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নতুন পণ্য নির্বাচন থেকে শুরু করে নানান সামাজিক বিষয়ে হানসালিমের নীতিগত অবস্থান নির্ধারণ করা পর্যন্ত সকল সিদ্ধান্তই এই পরিচালনা পরিষদ গ্রহন করে থাকে। সদস্যগণ হানসালিমের বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে উৎপাদন এলাকা পরিদর্শন করে, বাস্তব অবস্থা যাচাই করে এবং উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে তথ্য ও মতামতের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। উৎপাদক এবং ভোক্তা মিলে একটি অংশগ্রহনমূলক নিশ্চয়তা পদ্ধতি অনুসরণ করে সকল পণ্যের গুণমানের নিশ্চয়তা বিধান করে থাকে।
হানসালিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সারাদেশে এর ৫০০টিরও বেশি গ্রামভিত্তিক এবং অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মৌলিক অঙ্গসংগঠন আছে। এসব অঙ্গসংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত উৎপাদক, কর্মী এবং ভোক্তা একসাথে বসে প্রতি নতুন বছরের শুরুতে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বছরব্যাপি কোন পণ্য কতটুকু উৎপাদন করা হবে, কে কে উৎপাদন করবে, কোথায় কোথায় উৎপাদন করবে এবং তার দাম কত হবে এসবকিছুই এই পরিকল্পনা সভায় ঠিক করা হয়। ফলে, হানসালিম সদস্যগণ সারাবছর পূর্বনির্ধারিত দামেই পণ্য পেয়ে থাকে। বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে বা কমে গেলেও হানসালিম পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে। ফলে, এখানে কৃষক বা ভোক্তা কারও ঠকে যাওয়া বা জিতে যাওয়ার কোন বিষয় এখানে থাকেনা।
হানসালিম কর্তৃক পরিচালিত সাপ্লাই চেইনের পরিচালন ব্যয় যেমন: কর্মীদের জন্য ব্যয়, পরিবহন ও বিতরণ ব্যয়, বিজ্ঞাপন ব্যয়, সাংগঠনিক ব্যয়, সমবায়ভূক্ত এবং সমাজের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সেবা ও অন্যান্য দরকারী সহযোহিতার জন্য ব্যয় ইত্যাদি সকল ব্যয় নির্বাহের জন্য পণ্য বিক্রয় থেকে মোট লাভের ২৪% রেখে বাকী ৭৬% উৎপাদকদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়।
পণ্যের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি
পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের সন্তুষ্টি এবং উভয়ের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার বিষয়গুলো সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় যাতে পরবর্তী প্রজন্ম একটি নিরাপদ জীবন লাভ করতে পারে। হানসালিমের নিজস্ব দাম নির্ধারণ পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কৃষক ও ভোক্তা মিলে নিজেরাই পণ্যের উৎপাদন খরচ এবং ন্যয়সঙ্গত লাভ রেখে ভোক্তার জন্য ফসলের দাম নির্ধারণ করে দেয় যার সাথে বাজারে বিদ্যমান দামের সম্পর্ক থাকেনা। এক্ষেত্রে কার্যত ফসল চাষের আগেই সম্ভাব্য উৎপাদন খরচ এবং কৃষকের ন্যায্য লাভ নিশ্চিত করে উৎপাদক সমিতি নিজেরাই ফসলের দাম ঠিক করে থাকে। ফলে, কৃষকের জন্য ফসল চাষ থেকে লাভজনক মূল্য পাওয়ার গ্যারান্টি থাকে।
জৈব উপায়ে উৎপাদিত হওয়ার কারণে কখনো কখনো হানসালিমের পণ্যের দাম বাজারের চলতি দামের চেয়ে বেশি হয়। কারণ, জৈব খাদ্যপণ্য উৎপাদনে শ্রম বেশি লাগে এবং রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, হরমোন ইত্যাদি প্রয়োগ করে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে ফলনও কম হতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষির স্থায়িত্বশীলতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভোক্তাগণ এই উৎপাদন পদ্ধতিকেই উৎসাহিত করে থাকে এবং কৃষককে বাড়তি দাম দিতে কার্পণ্য করেনা। সচেতনতার কারণে সদস্যগণ জানে যে, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিলে এবং এই মুক্ত বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে লাগামহীনভাবে বাড়ে এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা যেভাবে ভোক্তার পকেট কাটে সেই তুলনায় হানসালিমের পণ্যের দাম বরং বাজারের চেয়ে কমই থাকে।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উৎপাদন পর্যায়ে বর্ধিত ঝুকি মোকাবিলা এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোন কারণে কৃষকের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাতে দাম বাড়াতে না হয় এবং কৃষকদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায় তাই ২০১৫ সালে দুটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১) মূল্য স্থিতিশীলীকরণ তহবিল এবং ২) উৎপাদন স্থিতিশীলীকরণ তহবিল।
হানসালিমের পণ্যসম্ভার
হানসালিম শুধু জৈব খাদ্যপণ্য সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং এটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যই সরবরাহ করে থাকে। এই সাপ্লাই চেইন এখন প্রায় ১৯০০ প্রকার পণ্য সরবরাহে কাজ করে যার মধ্যে রয়েছে দানাশস্য, শাক-সব্জি, মাছ, প্রাণিজ খাদ্য, সামুদ্রিক খাদ্য, বাদাম ইত্যাদি, প্রক্রিয়াকৃত খাদ্য যেমন: দুগ্ধজাত খাবার, জ্যাম, জ্যালি, সস, টসু, নুড্যুলস, স্ন্যাকস ইত্যাদি। এছাড়াও পণ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রবিবেশসম্মত প্রসাধন সামগ্রী এবং বই। হানসালিম পণ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তারা কোন আমদানিকৃত পণ্য বিক্রয় করেনা।
হানসালিম পণ্যের গুণমান
জৈব উৎপাদনের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের পাশাপাশি ব্যয়বহুল তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন বৃদ্ধি পেয়েছে। হানসালিমকে তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেটের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয় না। বিপরীতে তারা নিজস্ব কনজিউমার সার্টিফিকেশন সিস্টেম গড়ে তুলেছে। এই সিস্টেমের উদ্দেশ্য হল হানসালিম পণ্যগুলির একটি বিস্তৃত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং উৎপাদককে আরও স্বাধীন ও দায়িত্বশীল করে তোলা এবং উৎপাদন এলাকা এবং পণ্যগুলির সম্পর্কে গ্রাহকদের ধারণা ও আস্থা সৃষ্টি করা। এই ব্যবস্থায় ভোক্তাগণ নিয়মিতভাবে কৃষকদের খামার পরিদর্শন করে একদিকে যেমন খাদ্যের গুণমান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় অন্যদিকে তেমনি কৃষকের জীবনযাত্রার নানান সমস্যা সম্পর্কেও খোজ-খবর করে, তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশভাগী হয়। এভাবেই কৃষক এবং ভোক্তার মধ্যে গড়ে উঠে এক সুদৃঢ় আত্মিক সুসম্পর্ক।
হানসালিম তাদের পণ্যের গুণগত আদর্শমান বা স্যান্ডার্ড তারা নিজেরাই ঠিক করে থাকে। তাদের পণ্যের স্যান্ডার্ডের মধ্যে রয়েছে ১) সম্পূর্ণরূপে রাসায়িক সার ও বালাইনাশক মুক্ত, ২) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দেশীয় পণ্য ৩) টাটকা ও মৌসুমি শাক-সব্জি ও ফলমূল, ৪) জিএমও মুক্ত, ৫) কোনপ্রকার এডিটিভস ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত, ৬) কৃত্রিম রঞ্জক, ফ্ল্যাভার ও মিষ্টিকারক দ্রব্য (যেমন: স্যাকারিন) ইত্যাদি থেকে মুক্ত, ৭) এন্টিবায়োটিক মুক্ত, ৮) কৃত্রিম হরমোন ও ভিটামিন মুক্ত। নিয়মিতভাবে খাদ্যপণ্যে বালাইনাশকের অবশেষ, হেভিমেটালের উপস্থিতি, অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি ইত্যাদি পরীক্ষা এবং জাপানের ফুকোশিমা পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে সংঘটিত দুর্ঘটনার পর থেকে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষাও করা হয়। হানসালিম পণ্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্যাকেটের গায়ে খাদ্যের উৎস্য লিপিবদ্ধ করা হয় যাতে খাদ্যদ্রব্যের অতিক্রান্ত দূরত্ব নির্ণয় করা যায় এবং স্থানীয় পণ্য যাতে স্থানীয় বা সবচেয়ে নিকটস্থ হানসালিম বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রয় হয় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় যেন খাদ্যের কার্বন ফুটপ্রিন্ট সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে।
উপসংহার
প্রায় সাড়ে তিন দশকের সাফল্যজনক পথচলায় হানসালিম সমবায় মডেল একদিকে যেমন ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান দিতে পেরেছে অন্যদিকে তেমনি কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতেও সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ধ্বংসাত্মক বর্তমান উন্নয়ন মডেলের বাইরে গিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি শান্তিময় সহাবস্থান নিশ্চিত করার এক স্থায়িত্বশীল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সর্বোপরি, মুক্তবাজারের প্রবল স্রোত মোকাবিলা করে সাফল্যের সাথে তার বিষ্ময়কর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পেরেছে যা আগ্রহী এবং চিন্তাশীল ও অনুসন্ধিৎসু মানুষদের জন্য এক অনুসরনীয় ও অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
শহীদুল ইসলাম, কৃষিবিদ ও কৃষি উন্নয়ন গবেষক
shahid.bd1172@gmail.com