বাংলাদেশের মত দেশে জৈব কৃষির মত প্রায় অসম্ভব এক কাজের পিছনে প্রায় পুরো কর্মজীবনটা ব্যয় করে ফেললাম। অর্জন বা সফলতার খাতায় আশাব্যঞ্জক খুব বেশি কিছু যুক্ত না হলেও অভিজ্ঞতার ঝুলিটা মুটেও ফেলনা নয়। যদিও অভিজ্ঞতার সবটুকু এখনো কাজে লাগানো যায়নি। এর পিছনে বহুবিদ কারণ রয়েছে। প্রথম ও প্রধান কারণটি হলো গত কয়েক দশক ধরে রাসায়নিক কৃষির চর্চার ফলে আমাদের মাটি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে সেখান থেকে জৈব কৃষিতে ফেরাটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এটা মূলত একটা টেকনিক্যাল কারণ। আরেকটা প্রধান আর্থসামাজিক কারণ হচ্ছে – আমাদের স্বল্প এবং ক্রমহ্রাসমান জমিতে ক্রমবর্ধমান মানুষের বর্তমান খাদ্যচাহিদা মিটাতে হলে বর্তমান রাসায়নিক কৃষির কোন বিকল্প নেই বলেই নীতি-নির্ধারক-মহলসহ দেশের বেশিরভাগ মানুষের এমনকি খোদ কৃষকেরও বদ্ধমূল ধারণা। আপাতদৃষ্টিতে এই ধারণা হয়ত পুরোপুরি অমূলক নয়। জৈব কৃষি বাস্তবায়নে শ্রীলংকার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে যদিও এক্ষেত্রে শ্রীলংকান পন্থা মুটেও বাস্তবসম্মত ছিলনা। জৈব কৃষি চর্চার বাস্তবায়ন যতই কঠিন হউক না কেন তাই বলে মাটি, পরিবেশ, মানবস্বাস্থ্য ইত্যাদি সবকিছুকে হুমকিতে ফেলে আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত খাদ্য চাহিদা মিটাতে হবে সেটা মেনে নিতে মন সায় দেয়না বলেই এই অসম্ভবের পিছে নিরন্তর ছুটে চলা।

আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা যে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। আমাদের সুষম পুষ্টির জন্য একজন মানুষের দৈনিক কতটুকু শর্করা প্রয়োজন সেটা জানা খুব জরুরি। কিন্তু আমরা কয়জন তা জেনেবুঝে খাদ্য গ্রহণ করি? একজন প্যুর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২০০০-২২০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি দরকার হয় তার ৪৫-৬৫% শর্করা থেকে আসতে হবে। তার মানে হলো, সর্বোচ্চ পরিমাণটা ধরা হলেও শর্করা থেকে আসতে হবে ১৪৩০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি। আবার ১ গ্রাম শর্করা সমান ৪ কিলোক্যালোরি শক্তি। অর্থাৎ ১৪৩০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পেতে হলে প্রায় ৩৫৮ গ্রামের মত শর্করা জাতীয় খাদ্য লাগবে। চালে শর্করা থাকে ৮০% এবং সে হিসেবে শর্করার পুরোটাই চাল থেকে পেতে চাইলে আমাদের প্রতিজনের প্রতিদিন চাল লাগে ৪৪৮ গ্রামের মত। কিন্তু আমরা শুধু ভাতই খাইনা আলু, বিস্কুট, চিনি, চিড়া-মুড়ি এমনকি শাকসব্জী ও ফলমূলও খাই যেখান থেকেও শর্করা পেয়ে থাকি। জাতিসংঘের WHO/FAO এর হিসেব অনুযায়ী আমাদের ভাত গ্রহণ করা উচিত সর্বোচ্চ ৪০০ গ্রাম। বাকি ক্যালরি আসবে গম, গোলআলু এবং অন্যান্য খাবার থেকে। তার মানে, আমাদের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে চাল লাগে মুটামুটি ২.৫ কোটি টন বা তার একটু বেশি যেখানে ২০২১ সালে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩.৭৬ কোটি টন।

তদুপরি আমাদেরকে প্রতিবছরই চাল আমদানি করতে হয়। চালের উচ্চমূল্যসহ নানান সংকটতো লেগেই আছে। অন্যদিকে, খাদ্য নিরাপত্তার সংঙা থেকে আমরা জানি যে, তিনবেলা পেটপুরে পোলাও-মাংস-বিরিয়ানি খেলেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়না যদি না সেই খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয় এবং মানবদেহের পুষ্টি চাহিদা মিটাতে সক্ষম হয়। কাজেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ এসব সংকট মোকাবিলায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের বিবেচনায় মানুষের পুষ্টিজ্ঞান ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত ছিল। অথচ এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে চালের উৎপাদন বৃদ্ধিকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমারা আমাদের কৃষি ও খাদ্যববস্থাকে প্রতিনিয়ত বিপন্ন করে চলেছি।

আমি কর্মজীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি যতজন কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানির মুখোমুখি হয়েছি তাঁদের বেশিরভাগেরই কথা হচ্ছে জৈব কৃষি আমাদের জন্য বিলাসিতা। কারণ, আমাদের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ক্ষুধার অন্ন যোগান দেওয়া। চ্যালেঞ্জ যেখানে, গবেষণার প্রয়োজন এবং উদ্ভাবনের সুযোগও সেখানে। কৃষি ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে যে বিষয়টা আমাকে সর্বাধিক ভাবিয়ে তুলে সেটা হচ্ছে আমাদের মাটির বেহাল অবস্থা। এককালের “খাটি সোনার চেয়েও খাটি আমার দেশের মাটি” আজ প্রাণহীন মৃত মাটিতে পরিণত হয়ে গেছে। কারণ, জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ। একটি সুস্থ ও সজীব মাটিতে কমপক্ষে ৫% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন যা আমাদের অধিকাংশ মাটিতে ১% এরও নীচে নেমে গেছে। ফসলের অত্যাবশ্যক ১৭টি পুষ্টি উপাদানের যে ১৩ টি উপাদান মাটি থেকে আসে তার ৬-৭ টির ঘাটতি ইতোমধ্যে আমাদের মাটিতে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে যেগুলো ত্রমবর্ধমান হারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে পূরণ করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় যখন মাটি জৈবপদার্থশূণ্য হয়ে পড়বে তখন তা মৃত মাটিতে পরিণত হবে। তখন এই মাটিতে ১৩ প্রকার রাসায়নিক সার দিয়েও ফসল ফলানো সম্ভব হবেনা। কারণ এই সারকে ফসলের জন্য গ্রহণোপযোগি করতেও জৈব পদার্থ অত্যাবশ্যক।

এটা হচ্ছে আমাদের সংকটের একটা দিক। অন্যদিকে আছে রাসায়নিক বালাইনাশক যা ফসল রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক বালাই দমন ব্যবস্থায় পোকাকে পেস্ট বা শত্রুজ্ঞান করে হত্যা করা হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এই পোকারাও এই ইকোসিস্টেমের অংশ। এই ইকোসিস্টেমই জীবজগতের চালিকাশক্তি। বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য একে একটি রেডিওর সাউন্ডসিস্টেমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। রেডিওর সাউন্ড সিস্টেমের কোথাও কোন একটি আইসি নষ্ট হলে যেমন গোটা রেডিওটাই বিকল হয়ে পড়ে তেমনি আমরা যাকে পেস্ট বা বালাই বলি সেগুলো না থাকলে ইকোসিস্টেমও বিকল হয়ে পড়ে। আমাদের ইকোসিস্টেমের খাদ্য-শিকল অক্ষুণ্ণ রাখতে পোকামাকড় অত্যাবশ্যক। কারণ, এই পৃথিবীতে একমাত্র সবুজ উদ্ভিদই নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করতে পারে যেখানে মানুষসহ বাকী সকল প্রাণিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। এই খাদ্যকে ইকোসিস্টেমে পৌছে দিতে এই পোকামাকড়ই হলো প্রাথমিক পোষক। অবশ্য সমাজের দুষ্টু মানুষদের মত ক্ষতিকর পেস্টকে দমন করতে হবে, নির্মূল নয়। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম অক্ষুন্ন থাকলে হয় এমনিতেই দমন হয় নয়তো কিছু প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে খুব সহজেই দমন করা সম্ভব হয়।

এই সিস্টেমের আরেকটি কম্পোনেন্ট হলো ম্যাক্রো ও মাইক্রোক্লাইমেট যার সাথে আলো-বাতাসসহ জলবায়ুগত নানান উপাদান জড়িত। এই উপাদানগুলোর অন্যতম হলো সূর্যের আলো যা পৃথিবীর সকল শক্তির আদি উৎস। এই শক্তিই খাদ্যের মাধ্যমে সমগ্র জীবজগতে সঞ্চারিত হয়। সৌরজগতের অংশ হিসেবে অন্যান্য গ্রহ এবং পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চন্দ্রসহ অন্যান্য মহাজাগতিক শক্তিগুলোর প্রভাবও থাকতে পারে যা নিয়ে পূর্বে আমার তেমন কোন ধারণা ছিলোনা যা বায়োডায়নামিক এগ্রিকালচারের অন্যতম অনুসঙ্গ। এদিক থেকে বায়োডাইনামিক এগ্রিকালচারকে অনেকে সাইন্টিফিকের চেয়েও স্পিরিচুয়াল বলতেই বেশি আগ্রহী। কসমোলজি বিজ্ঞানের বিরাট এক শাখা হলেও কসমিক ফোর্সের সাথে জীবজগতের নিবিড় যোগাযোগ সম্পর্কে খুব বেশি গবেষণা আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

জৈব কৃষি, পারমাকালচার, রিজেনারেটিভ এগ্রিকালচার, ইকোলজিক্যাল এগ্রিকালচার, জিরোবাজেট ন্যাচারাল ফার্মি, স্থায়িত্বশীল কৃষি, বায়োডাইমানিক এগ্রিকালচার (বিডি) ইত্যাদি নানা নামে যেসব কৃষিচর্চা আছে তার মূলমন্ত্রই হচ্ছে এই প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমটাকে ঠিক রেখে ফসল উৎপাদন করা। জৈব কৃষি নিয়ে এতদিন কাজ করতে গিয়ে এই ইকোসিস্টেমটাকে সারিয়ে তোলা বা পুণপ্রতিষ্ঠার উপায় অনুসন্ধান করেছি। কিন্তু বায়োডাইনামিক কৃষিতে এসব টেকনিক্যাল ও প্রাকৃতিক বিষয়ের সাথে একটি অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ও আছে যা সম্পর্কে এশিয়া-প্যাসিফিক বায়োডাইনামিক কনফারেন্সে এসে আরও গভীরভাবে জানা গেলো।

বিডি এগ্রিকালচারের অন্যতম মূল কথা হচ্ছে কসমিক ফোর্সের সাথে এই পৃথিবীর কৃষি-ইকোসিস্টেমের যে যোগসূত্র এবং ব্যালেন্স থাকা দরকার সেটা পূণঃপ্রতিষ্ঠা করা। মালয়াশিয়ার পাহাং রাজ্যের রাউব শহরে মালয়েশিয়া ডিমেটার এসোসিয়েশন(এমডিএ)-এর আয়োজনে ২০-২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই সম্মিলনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৮টি দেশের প্রায় ১৫০ জন মানুষ অংশগ্রহন করে। মাটি বাংলাদেশ থেকে আমরা পাঁচ সদস্যের একটি দল অংশ নিয়েছিলাম। আশা করি এখান থেকে লব্ধ শিখন এবং অভিজ্ঞতাগুলো আগামিকত বেশ কাজে দিবে।