ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি ছয় টাকা বাড়ানোর ফলে কৃষকের দুর্ভোগ আরেক দফা বৃদ্ধি পেল। এমন বজ্রাঘাতের রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ্ব বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখি তখন মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে ডিজেল ও কেরোসিনের দামও রাতারাতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হলো। মাত্র কয়েক মাস আগে গেলো বছরের নভেম্বরে ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছিল। তার মানে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে ডিজেলের দাম প্রায় দিগুন করা হলো। অথচ সেচকাজে এই ডিজেল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। কিছুদিন আগে বিদ্যুতের দামও যথেষ্ট বেড়েছে যা সেচের দাম বাড়িয়েছে। যতই সমন্বয়ের কথা থাকুক বিশ্ব বাজারে দাম কমলেও এই দাম যে আর কমবেনা সেটা বলার জন্য জ্যোতিষ হওয়া লাগেনা। কাজেই চলতি আমনে যেমন-তেমন আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কতটা বাড়ে আর ধানের দামই বা কেমন পায় সেটাই দেখার বিষয়। যাহোক, এই লেখার প্রসঙ্গটা একটু ভিন্ন।

সারের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, দাম বৃদ্ধির ফলে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমবে। কিন্তু সত্যি তা কমবে কিনা তা নিয়ে খোদ কৃষিমন্ত্রীও নিশ্চিত নন। কারণ, কৃষকের সাধারণ  প্রত্যাশা হলো তাঁর ফসলের সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া। আর কৃষক এতদিন ধরে জেনে এসেছে যে, বেশি ফলন পেতে হলে পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার লাগবে, ভালো বীজ লাগবে,  এবং পোকামাকড় ও রোগব্যাধির হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে হলে  ছিটাতে হবে রাসায়নিক বালাইনাশক। কাজেই যতই দাম বাড়ুক না কেন বাকীতে বেশি দাম দিয়ে, উচ্চসূদে ধারদেনা করে কিংবা অসময়ে কমদামে গরু-ছাগল এমনকি ঘটিবাটি বেচে হলেও কৃষক সারসহ এসব উৎপাদন উপকরণ কিনবেই। এ কারণেই সারের জন্য কৃষককে গুলি খেয়ে মারা যেতেও আমরা দেখেছি।

তবে কৃষক যদি আশ্বস্ত হন যে ইউরিয়া কম দিলেও ফলন কমবেনা তবে হয়ত এর ব্যবহার কিছুটা হলেও কমতে পারে। অবশ্য এজন্য কৃষককে হাতেকলমে তা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। হঠাৎ করে সারের দাম বাড়িয়ে দিলেই কৃষক সার কেনা কমিয়ে দেবে এটা বিশ্বাস করার বাস্তবসম্মত কোন কারণ নেই। বাস্তবতা এই যে, ইতিপূর্বে সারের ব্যবহার কমানোর জন্য বা সুষম সার ব্যবহারকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক গৃহীত নানাবিধ পদক্ষেপ যেমন: সুষম সার ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, সার ব্যবহারের অনলাইন ও অফলাইন নির্দেশিকা, মাটি পরীক্ষা করে সার ব্যবহারের সুপারিশ প্রদান, ইউরিয়ার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ‘লিফ কালার চার্ট’ প্রবর্তন ইত্যাদি সকল প্রচেষ্টা খুব বেশি সফল হয়নি। যেমন অসফল হয়েছে পেস্টিসাইড ব্যবহার কমানোর জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) প্রশিক্ষণ, আইপিএম মাঠ স্কুল এবং আইপিএম ক্লাব গঠনসহ নানান কার্যক্রম। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বর্তমানের কৃষি অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর যা দেশের বেশিরভাগ নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত কৃষকের পক্ষে হজম করা খুবই কঠিন।

একথা সত্য যে শুধু ইউরিয়া নয়, কোন সারেরই সুষম ব্যবহার এদেশে হয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সার সম্পর্কে কৃষকদের অজ্ঞতা। বালাইনাশকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। একসময় যে বীজ ছিল কৃষকের নিজস্ব সম্পদ এবং শুধু বীজ সম্বন্ধেই নয় গোটা কৃষির সকল জ্ঞান ছিল কৃষকের নিজস্ব তার সবই এখন কৃষকের হাতছাড়া। এখন কৃষকের পরামর্শদাতার স্থান দখল করেছে অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত ডিলার বা ব্যবসায়িগণ যাদের প্রধান লক্ষ্য মুনাফা করা। বেশি বেশি বীজ-সার-বালাইনাশক বিক্রী করতে পারলে শুধু মুনাফা বা কমিশনই নয় ডিলারদের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া হয় বিশেষ পুরষ্কার কিংবা বিদেশ ভ্রমণসহ নানান উপহার ও প্রণোদনা। সুতরাং ডিলার কৃষককে কী ধরণের পরামর্শ দিবে তা সহজেই অনুমেয়।

কাজেই সারের দাম বাড়িয়ে হয়ত আমদানি কমানো যাবে এবং তাতে কিছু ডলারও বাচানো যাবে কিন্তু অধিক সার ব্যবহার করা থেকে কৃষককে নিবৃত করা যাবে বলে মনে হয়না। আমদানি কমলে এবং বাজারে সারের সংকট সৃষ্টি হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এক্ষেত্রে মুনাফাখোর সুযোগসন্ধানি ব্যবসায়িরা ঝোপ বুঝে কোপ মারবে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রীর ঘটনা অতীতে বহুবার দেখা গেছে যার কোন প্রতিকার কৃষক পায়নি। ফলস্বরূপ, ফসলের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে এবং ধান থেকে কৃষকের লাভ আরও কমবে কিংবা লোকসান বাড়বে। এমনিতেই ধানচাষ থেকে কৃষকের তেমন কিছু লাভ হয়না বরং লোকসানই হয়। তবুও কৃষক ধান চাষ করে মূলত নিজের পরিবারের খাদ্য চাহিদা মিটানোর দায় থেকে কিংবা অনন্যোপায় হয়ে। কারণ, আমন মৌসুমে বৃষ্টির কারণে এবং বোরো মৌসুমে সেচের ব্লকে ধান ছাড়া অন্য কোন ফসল চাষ করা সম্ভব হয়না। একসময় কৃষকের জন্য বর্ষা মৌসুমের বিকল্প ফসল ছিল সোনালী আঁশ খ্যাত পাট যা চাষ করলে এখন কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাড়ায়।

বহু গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসায়নিক সারের সাথে জৈব সার মিশিয়ে প্রয়োগ করা হলে ফসলের ফলন শুধুমাত্র রাসায়নিক সারে চাষের তুলনায় বাড়ে। অন্যদিকে, গত কয়েক দশকে ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে আমাদের মাটির উর্বরা শক্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে। দেশের অধিকাংশ জমির জৈব পদার্থের পরিমাণ শতকরা এক শতাংশ বা তার নীচে নেমে এসেছে যা একটি আদর্শ উর্বর মাটিতে শতকরা পাঁচ শতাংশ থাকা আবশ্যক। জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ যার অভাবে মাটি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে। এই নিষ্প্রাণ মাটি আমাদের অনাগত প্রজন্মের খাদ্যের যোগান কিভাবে দিবে সেটা নিয়ে ভাববার এখনি সময়।

নানাবিধ কারণে কৃষক এখন মাঠে জৈবসার ব্যবহার করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। প্রধানতম কারণটি হচ্ছে চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন ও যান্ত্রিকীকরণ। পক্ষান্তরে, জৈবসার উৎপাদন ও ব্যবহার কঠিন এবং শ্রমসাধ্য । অনেকেই গোবরের মত জৈব উপকরণের অপ্রতুলতার কথা বলে থাকেন। একথা সত্য যে আগের দিনের মত জৈব উপকরণ এখন আর নেই। কিন্তু এই প্রশ্ন তোলার আগে আমাদের ভাবতে হবে, যতটুকু আছে সেটুকুই আমরা ব্যবহার করছি কিনা। যেকোন গ্রামে গেলেই দেখা যাবে প্রচুর পরিমাণ জৈব পদার্থ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। কচুরিপানা মূল্যবান জৈবসার না হয়ে বোরো ধানের জমিতে কৃষকের জন্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। একবার জনৈক বর্গাচাষীর সাথে কথা বলে জেনেছিলাম যে তার আধা একর বোরো জমির কচুরিপানা পরিষ্কার করতে প্রায় বারো হাজার টাকা লেগেছিলো। ক’দিন আগে এক টিভি রিপোর্টে দেখলাম কচুরিপানা হাওড় এলাকায় কৃষকদের গলার ফাঁস হয়ে দাড়িয়েছে। অথচ এই কচুরিপানাকে পরিকল্পিতভাবে যান্ত্রিক উপায়ে জৈবসারে রূপান্তরিত করে জমিতে দিতে পারলে সমস্যা সম্পদে রূপান্তরিত হবে। তেমনিভাবে শহুরে জৈব আবর্জনাকেও এমন সম্পদে রূপান্তরিত করা যায়। এসব নিয়ে কিছু কিছু গবেষণা এবং উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল। তদুপরি, মূলত যথেষ্ট চাহিদার অভাবে বাণিজ্যিকভাবে তেমন লাভজনক না হওয়ায় এমন অনেক উদ্যোগই মুখ থুবরে পড়েছে। এখানেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীতা গভীরভাবে অনুভূত হয়। সরকারি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মত এটাকেও এক অত্যাবশ্যক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা শুধু নয়, জনস্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্যও অতীব জরুরী। সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক মহল বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবেন বলে প্রত্যাশা রইল।

শহীদুল ইসলাম

কৃষিবিদ ও কৃষি উন্নয়ন গবেষক

https://samakal.com/opinion/article/2208128566/