বাংলাদেশে অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি একটি প্রকট এবং অনেকটা সমাধানহীন সমস্যা হিসেবে যুগের পর যুগ বিরাজমান। অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন-আয়ের দরিদ্র মানুষের দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক অবস্থা তথা বর্তমান কল্যাণ এবং ভবিষ্যত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে মারাত্মক অন্তরায়। মূল্যবৃদ্ধির ফলে দরিদ্র মানুষের প্রকৃত ব্যয়যোগ্য আয় এবং ব্যয় করার সক্ষমতা দুটোই ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় তা শুধু দারিদ্র বৃদ্ধি বা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেনা বরং মানুষের প্রায় সকল মৌলিক অধিকারের উপভোগক করাকে বাধাগ্রস্ত করে।

নিম্ন-আয়ের মানুষের দারিদ্র এবং খাদ্য ও পুষ্টি অধিকারের ওপর খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির এরূপ প্রভাব নিরূপণসহ খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ এবং সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে দেখার উদ্দেশ্যে ‘খানি বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দেশের ১৯টি জেলার ২৪ ধরণের নিম্ন-আয়ের পেশার প্রতিনিধিত্বকারী ৪৩৮ জন মানুষের ওপর জনপ্রিয় অনলাইন জরিপ টুলস ’সার্ভে মানকি’ ব্যবহার করে একটি জরিপ পরিচালিত হয়।

পেশাগুলো হলো- কৃষক, ঝুমচাষি, জেলে, কামার, কুমার, সুতার, মুচি, নাপিত, সুইপার, গৃহকর্মী, চা-বিক্রেতা, দর্জি, কৃষিশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, পরিবহণশ্রমিক, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, হকার, ভ্যানচালক, রিকশাচালক, অটোচালক, গাড়ীর ড্রাইভার, মেকানিক এবং হোটেলবয়।

উল্লেখ্য যে, ১৯ টি জেলায় ১৯ জন স্বেচ্ছাসেবক অনলাইন সার্ভে ফরম পুরণে উওরদাতাদেরকে সরেজমিনে সহায়তা করার মাধ্যমে জরিপকার্য সম্পন্ন করেছেন। তাছাড়া, গবেষক কর্তৃক দেশের খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি, কারণ এবং প্রতিকার নির্ণয়ে বেশকিছু সরকারি জরিপ, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগসমূহের অনলাইন ও অফলাইন প্রকাশনা এবং গবেষণাপত্রও পর্যালোচনা করা হয়েছে।

আরও উল্লেখ্য যে, কাকতালীয়ভাবে গবেষণার সময়টা ছিল করোনা মহামারীর কাল যখন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে চরম অর্থনৈতিক স্থবিরতা বিরাজমান ছিল এবং যার বিরূপ প্রভাব নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে। পাশাপাশি, উক্ত সময়ে চাল-ডাল-পেঁয়াজ ও শাক-সব্জিসহ অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যেরও আকাশচুম্বি মূল্য লক্ষ্য করা গেছে। কাজেই, নিম্ন-আয়ের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র এবং খাদ্য ও পুষ্টি অধিকারের ওপর খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সম্যক উপলব্দি করার ক্ষেত্রে এই গবেষণাকর্মটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমাদের বিশ্বাস।

জরীপ তথ্য থেকে দেখা যায় যে, ২৪% পরিবারের মাসিক আয় ৩,০০০টাকার কম যেখানে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার আগে মাত্র ৪% পরিবারের মাসিক আয় ৩,০০০টাকার কম ছিল। অন্যদিকে, গবেষণাকালে মাত্র ১% পরিবারের মাসিক আয় ১০,০০০টাকার বেশি ছিল যেখানে করোনার আগে ২৭% পরিবারের মাসিক আয় ছিল ১০,০০০টাকার বেশি ছিল। গবেষণাকালে বাকী ৬৯% পরিবারের মাসিক আয় ৩,০০০-১০,০০০ টাকার মধ্যে ছিল যা ২০১৬ সালে পরিচালিত ’খানা আয় ও ব্যয় জরীপ’ অনুসারে গড় জাতীয় আয় (১৫,৯৮৮ টাকা)-এর চেয়ে বেশ কম।

অন্যদিকে, আয় অনেক কমে গেলেও জরীপের উত্তরদাতাদের মতে ২০২০-এর মধ্যভাগের পর থেকেই বেশিরভাগ খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক বাড়তে থাকে। জরীপের ৮৬%, ৯৪%, ৯১% এবং ৮১% উত্তরদাতার মতে জরীপকালের তিনমাস আগের সময়টাতে যথাক্রমে চাল, পেঁয়াজ, আলু এবং শাকসব্জির মত অত্যাবশ্যক এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যগুলোর দাম ছিলো তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অন্যদিকে, শতকরা ৬২% উত্তরদাতার মতে উক্ত সময়ে ডালজাতীয় খাদ্য যেমন: মসুর, খেসারী এবং ৫৫% উত্তরদাতার মতে প্রোটিনজাতীয় খাদ্য যেমন: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি খাদ্যগুলোর দামও তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এমতাবস্থায়, পরিবারগুলোর মধ্যে মাত্র ৫% তাদের খাদ্য ক্রয়ের আগের পরিমাণ ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবং বাকী ৯৫% পরিবারকে হয় ’কম’ পরিমাণে (৩২% উত্তরদাতা) অথবা ’অনেক কম’ পরিমাণে (৬৩% উত্তরদাতা) খাদ্যদ্রব্য কিনতে বাধ্য হতে হয়েছে।

মূল্য বৃদ্ধির ফলে শুধু যে খাদ্য কম কিনতে হয়েছে তাই নয়, ৯৯% উত্তরদাতার মতে তাদেরকে ’প্রায়শই’ (৬৫% উত্তরদাতা) অথবা ’কখনো কখনো’ (৩৪% উত্তরদাতা) অন্যান্য মৌলিক চাহিদা বাবদ ব্যয় কমিয়ে খাদ্যদ্রব্য কিনতে হয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭৭% পরিবারকে কাপড়বাবদ ব্যয়, ৫৬% পরিবারকে চিকিৎসা ব্যয়, ৪০% পরিবারকে শিক্ষা ব্যয় এবং ৭৩% পরিবারকে অন্যান্য ব্যয় কমাতে বাধ্য হতে হয়েছে।

খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে শুধু খাদ্য এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদার ব্যয় কমানোতেই মানুষগুলোর দুর্ভোগের শেষ হয়নি বরং বর্ধিত আর্থিক চাহিদা মেটাতে তাদেরকে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা কিংবা মহাজন থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে সেই ব্যয় মেটাতে হয়েছে। সার্ভে থেকে দেখা যায় যে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ৫২% পরিবার ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে যার গড় পরিমাণ ছিল ২২,০৭৬ টাকা এবং ঋণের পরিমাণের ব্যাপ্তি ছিল সর্বনিম্ন ৩৫,০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০,০০০টাকা।

জরীপ তথ্য অনুসারে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবারগুলোর দৈনিক খাদ্যগ্রহণের পরিমাণও তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে যায়। খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির আগে যেখানে ৯৩% পরিবার দিনে তিনবেলা খেতে পারতেন মূল্য বৃদ্ধির পর তা ৬০%-এ নেমে আসে। পক্ষান্তরে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির আগে মাত্র ৫% পরিবার দিনে দুইবার খাদ্য গ্রহণ করত যা খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে বেড়ে ৪০%-এ উন্নীত হয়। জরীপ তথ্য থেকে আরও দেখা যায় যে, প্রায় ৩৫% পরিবারকে ’মাঝেমধ্যেই’ না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে যেখানে ২০% পরিবারকে ‘প্রায়শই’ না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে।

দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্যদ্রব্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কর্তৃক পরিচালিত ’খোলাবাজারে বিক্রয়’ বা ’ওএমএস’ কার্যক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বা অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু জরীপ থেকে হতাশাজনকভাবে দেখা যায় যে, উত্তরদাতা পরিবারগুলোর মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগই অনেক খাদ্যসংকটে থাকা সত্ত্বেও সার্ভেকালীন সময়ের পূর্ববর্তী মাসে কার্যক্রম চালু থাকা সত্ত্বেও ওএমএস থেকে কোন খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারেনি যা এই কার্যক্রমের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ওএমএস থেকে খাদ্যদ্রব্য না কেনার কারণ হিসেবে এক-চতুর্থাংশ উত্তরদাতাই জানান যে, কোথায় এবং কখন খোলাবাজারে চাল বিক্রী হয় তাই তাদের অজানা থেকে যায়। তাছাড়া, তারা জনতে পারলেও বিক্রয়কেন্দ্রগুলো অনেক দূরে থাকে, ফলে সময় এবং টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে লম্বা লাইনে দাড়িয়ে প্রায় গোটা দিন ব্যয় করে খাদ্য কিনতে হয় যা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর জন্য খুবই কঠিন। উপরন্তু বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় অনেক সময় তাদেরকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হয় এবং খাদ্যের মান নিয়েও তাদের অভিযোগ রয়েছে।

সার্ভে এবং বিভিন্ন গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ এবং গবেষকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অনুসারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়া; মধ্যস্বত্বভোগী খাদ্য ব্যবসায়িদের কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করা; বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠানিক দূর্বলতা ও ব্যর্থতা; দুর্ণীতি এবং কায়েমি স্বার্থ; খাদ্য দাহিদা ও যোগানের নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে সঠিক উৎপাদন ও আমদানি পরিকল্পনার অভাব; ভোক্তা কর্তৃক আতঙ্কিত ক্রয় ইত্যাদি।

একটি জাতীয় ”দাম কমিশন” গঠন করা, টিসিবি-কে আরও দক্ষ ও কার্যকরী করা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং আমদানী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, মধ্যস্বত্বভোগী ও অবৈধ মজুদদারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় শক্তিশালীকরণসহ নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিনিয়ত খাদ্য সংকটে ভোক্তভোগী মানুষগুলো এরূপ খাদ্য সংকটকে তাদের নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে। সংখ্যায় অত্যন্ত কম হলেও ২% উত্তরদাতা মনে করে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছুই করার নেই এবং ১৯% উত্তরদতার মতে সরকারের করনীয় সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। এই তথ্য প্রমাণ করে যে, এখনও অনেক মানুষ খাদ্যকে তাদের অধিকার হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত নয়। যার ফলে, সকল সরকারও এমন একটি অতীব জরুরী বিষয়কে দায়সারাভাবে মোকাবিলা করে থাকে। এর প্রধান কারণ হিসেবে দেশে একটি ”খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার আইন”-এর অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করা যায় যা কিনা রাষ্ট্রের সকল নাগরিক বিশেষ করে দরিদ্র নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে খাদ্য ও পুষ্টির অধিকারকে গ্রাহ্য করা, সুরক্ষা দেওয়া এবং সর্বোপরি পূরণ করার আইনি বাধ্যবাধকতা দিবে।

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মানদন্ডে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিওএফপি ২০২০) তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং প্রায় ১.১ কোটি মানুষ তীব্র ক্ষুধা নিয়ে দিনাতিপাত করে থাকে। দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী মোট ৫৫ লক্ষ শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভোগে থাকে ।
২০১৯ সালে দি ইকোনোমিস্ট গ্রুপের ইনটিলিজেন্ট ইউনিট একটি গবেষণার মাধ্যমে ১১৩ টি দেশের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা, এবং নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে একটি ’গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স -২০১৯’ প্রণয়ন করে। উক্ত সূচকে ১১৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম (স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৫৩.২) যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি মানদন্ডে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ দেশের মধ্যে ১০৭তম (স্কোর ১০০এর মধ্যে মাত্র ৩০.৬) যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।

তবুও আশার কথা হচ্ছে, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তের দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে যদিও প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান হারে চাল আমদানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ আমাদেরকে এই মজার তথ্য দেয় যে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লক্ষ টন চাল উৎপাদিত হয় এবং দানাদার খাদ্যের চাহিদার তুলনায় প্রায় ১.৫ কোটি টন খাদ্য উদ্বৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও সেবছর প্রায় ৫৭ লক্ষ টন চাল আমদানি করা হয় ।

অপ্রত্যাশিত হলেও বাস্তবতা এই যে, চাল ছাড়া অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোন নির্ভরযোগ্য ও হালনাগাদ চাহিদা নিরূপণ চর্চা করা হয় বলে জানা যায়না। তদুপরি, চালের চাহিদার ক্ষেত্রে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায় তার যথার্থতা নিয়েও গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের সঠিক তথ্য ছাড়া কোন দেশের পক্ষেই মূল্য সম্পর্কে আগাম ধারণা করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায়, অসদুপায় অবলম্বন এবং কারসাজির মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল অপচেষ্টা দূর করা অসম্ভব ব্যাপার। (ইসলাম, এস. ও মুক্তা, জেড. এইচ. ২০১১) ।

উপর্যুপরি প্রকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ, রাসায়নিক সারের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরা শক্তির হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফসলের রোগব্যাধি বৃদ্ধি, কৃষিজমির ক্রমহ্রাস, জৈবজ্বালানী ও প্রাণিখাদ্য হিসেবে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি কারণগুলো এদেশের খাদ্য উৎপাদন অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী। এরূপ অস্থিতিশীল উৎপাদন অভ্যন্তরীণ খাদ্য স্থায়িত্বকে বিঘ্নিত করে যা দরিদ্র মানুষের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে।

সুপারিশমালা:
কোন নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের চাহিদা মুটামুটি স্থিতিশীল থাকার কথা। কাজেই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দক্ষ সরবরাহ ব্যবস্থাপনাই খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক বলে ধরে নেওয়া যায়। শক্তিশালী নীতি ও প্রতিষ্ঠানিক অস্ত্র/ইন্সট্রুমেন্ট/কাঠামো এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা দক্ষ সরবরাহ বা বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণ সরবরাহ বা বন্টন ব্যবস্থাপনার জন্য অতীব জরুরী।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশে খাদ্য-চাহিদা ও যোগানের নির্ভরযোগ্য তথ্যের মারাত্মক অভাব লক্ষ করা যায়। অধিকন্তু দেশের খাদ্য উৎপাদন অনেকাংশে জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল যা হালে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা অতীব জরুরী। এমতাবস্থায়, অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।

১. অবিলম্বে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক গৃহীত খাদ্য অধিকার গাইডলাইন (আরটিএফজি), ভূমি-জলা-বনভূমির দ্বায়িত্বশীল শাসন সংক্রান্ত ভলান্টারি গাইডলাইন (ভিজিজিটি), দায়িত্বশীল কৃষি বিনিয়োগ নীতিমালা (আরএআই)- ইত্যাদির আলোকে একটি ”খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার” আইন প্রণয়ন করা যা দরিদ্র মানুষের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও বেশি দায়িত্বশীল করে তুলবে।

২. ক্ষুদ্র খাদ্য উৎপাদকদের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি পরিবেশসম্মত ও উৎপাদকবান্ধব খাদ্য-ব্যবস্থা গড়ে তুলার লক্ষ্যে চিরায়ত ও দেশীয় খাদ্য-ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শণ ও গুরুত্ব প্রদান করা।

৩. ক্ষুদ্র উৎপাদকদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে এসএসএফ গাইডলাইন ও সিএফএস-আরএআই নীতিমালা -এর আলোকে ক্ষুদ্র উৎপাদকদের স্বার্থ সংরক্ষণপূর্বক বাণিজ্যিক কৃষিতে টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা।

৪. নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য চাল, ডাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদি অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যগুলো রেশনের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য করা।

৫. অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে একটি ”দাম কমিশন” গঠন করা।

৬. ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

৭. খোলাবাজারে খাদ্য বিক্রয় (ওএমএস) কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে টিসিবিকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করা।

৮. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসল উৎপাদন ব্যহত করতে পারে এমন প্রকৃতিক দুর্যোগসমূহের আগাম বার্তা প্রদান কার্যক্রম শক্তিশালীকর।

৯. সঠিকভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও যোগান নিরূপন সাপেক্ষে খাদ্য ঘাটতি পূরণে যথাসমযে সঠিক পরিমাণে খাদ্য আমদানির ব্যবস্থা করা।

১০. আন্তর্জাতিক খাদ্য বাজারকে তীক্ষ্ণ মনিটরিং-এর আওতায় এনে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের আগাম তথ্য সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১১. বেআইনি মজুদদারী, কালোবাজারি, খাদ্য-বাজার-সিন্ডিকেট, ভেজাল ইত্যাদি রোধে আইনশৃংখলা বাহিনী ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১২. খাদ্য উৎপাদন, বিপণন, আমদানি-রপ্তানী বাণিজ্য, মূল্য নির্ধারণ, চাহিদা ও যোগান নিরূপণ ইত্যাদি কাজে জড়িত সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন করা।

—-০—