কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশের সীমিত পরিমান আবাদী জমি থেকে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, নিজে খেয়ে না খেয়ে, ১৬ কোটি মানুষের মুখে নিরন্তর অন্ন তুলে দিচ্ছে যারা সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের যেন অন্ত নেই। পেটে ভাত নেই, পরনের কাপড় নেই, মাথা গুজার ঠাই নেই, ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ ও লেখাপড়া শেখানোর অর্থ নেই – এমনি হাজারও সমস্যার সাথে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে চলমান সার সংকট। সারতো কোন বিলাস দ্রব্য নয় যে, এর চাহিদা মেটানোর দায় কোন ভাবে এড়িয়ে গেলেই হল। তাছাড়া, এটা শুধু কৃষকের একার সমস্যাই নয়, সারা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও এর সাথে জড়িত। অথচ এই সারের দাবীতে কৃষকের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে চলমান এই দূর্ভোগ থেকে কৃষকের যেন মুক্তি নেই।

অথচ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সারতো কৃষক চায়না। বরং প্রকৃত সত্য এই যে, প্রয়োজনীয় পরিমান সার কেনার সাধ্যও কৃষকের নেই। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বা মাঠের ফসল কম দামে আগাম বিক্রী করে দিয়ে বা খাদ্য ও বীজ হিসেবে ঘরে সঞ্চিত শস্য বিক্রী করে বা ধার-কর্জ করে বহুকষ্টে কৃষক সার কেনার অর্থ জোগাড় করে। তবু কেন এই সংকট, এর কি সমাধান আদৌ নেই! তাছাড়া এ সংকটতো নতুন নয়। বিগত সরকারগুলো বোধগম্য কারণেই এই সংকট সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন করেনি। কারণ তাদের চেলা চামুন্ডারা এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে পকেট ভারি করার ধান্দা করেছে। কিন্তু বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলেও কেন একই চিত্র দেখা যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীদের মত বর্তমান মাননীয় শিল্প উপদেষ্টাও এই সংকটকেই অস্বীকার করে সমস্ত দায়ভার অবলীলায় নন্দঘোষ কৃষকের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছেন। মুক-বধির কৃষকের হয়ত এটাই নিয়তি!!!

ভাবতে অবাক লাগে এই সারই একসময় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে কৃষককে দেওয়া হয়েছে। বোকা কৃষক (!) তখন এই সার নিতে চায়নি। নানান ছলে ও কৌশলে বোকা কৃষককে এই সার, কীটনাশক, সেচ ও অন্যান্য ব্যয়বহুল কৃষি উপকরণগুলো ব্যবহারে অভ্যস্থ করা হয়েছে। বাহ্যিক উপকরণবিহীন যে স্থায়িত্বশীল ও স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা এতকাল কৃষকরা চর্চা করে আসছিল তা ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিয়ে বর্তমানের যে বাণিজ্যিক চাষ-ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানকে সমৃদ্ধ করলেও সেটা যে কৃষকের জন্য আহামরি কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি, চলমান সার সংকট তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বরং সুপরিকল্পিতভাবে এমন এক দুর্ভেদ্য ব্যবসার জালে কৃষককে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যে জাল ছিড়ে বেরোনোর আর কোন পথই যেন খোলা নেই। বেঁচে থাকতে হলে ফসল ফলাতে হবে, আর ফসল ফলাতে হলে উচ্চমূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক, ডিজেল ইত্যাদি কিনতেই হবে। এই নিশ্চিত মুনাফার নিশ্চিন্ত ব্যবসায় দিনে দিনে ফুলেফেঁপে উঠছে দেশী-বিদেশী কোম্পানি আর রক্তচোষা মধ্যস্বত্বভোগীরা। দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনকে দ্বিগুনের বেশি বৃদ্ধি করেও অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে কৃষককেই। একদিকে কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী মুনাফাখোর অক্টোপাসের শোষণ আর অন্যদিকে ঘামঝরানো শ্রমে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের উদ্বৃত্ব মূল্যের মধ্যস্বত্বভোগী কর্তৃক লুন্ঠন – এই দ্বিমুখী শোষণের ও লুন্ঠন শিকার হয়ে কৃষকের আজ ত্রাহি মদুসদন দশা।

রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতই বর্তমান সরকারও বারবার বলে চলেছে যে, দেশে চাহিদার তুলনায় সার মজুদের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশের সার কারখানাগুলো উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জনে সবসময় ব্যর্থ। বর্তমানে বিসিআইসি’র বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) অধীনস্ত ৭ টি সার কারখানা (৬ টি ইউরিয়া ও ১ টি টিএসপি কারখানা) থেকে ২০০৪-০৫ সালে ৪২.৫ লাখ মে.টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত হয় ২২.৪৩ মে.টন এবং আমদানি করা হয় ১৬.৩৫ লাখ মে. টন অর্থাৎ মোট মজুদ ৩৮.৭৮ লাখ মে.টন যা চাহিদার তুলনায় কম। ২০০৫-০৬ সালে দেশের কারখানাগুলোতে প্রায় ১৯.২৬ লাখ মে.টন সার উৎপাদিত হয় যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ মে.টন কম। এখানে লক্ষনীয় যে, সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সংকট সত্ত্বেও ১৯৯৫-৯৬ সালের পর থেকে সারের উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান যা দেশের সার সংকটকে ভবিষ্যতে আরও তীব্র করে তোলার ইঙ্গিত বহন করে। কারণ, বহুল কথিত মুক্তবাজারে সারের মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ, যে ইউরিয়া ও ফসফেট সারের সংকট সবচেয়ে তীব্র সে দুটি সারই বাংলাদেশে তৈরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইউরিয়া তৈরির কাাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস আমাদের রয়েছে। অথচ, গ্যাস রপ্তানি নিয়ে যতটা মাথা ঘামানো হয়েছে এই গ্যাস ব্যবহার করে ইউরিয়া সার উৎপাদন করার ক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও হয়নি। তা যদি হত তবে হয়ত সার সংকট এতটা তীব্র আকার ধারণ করতনা। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের বস্তাপ্রতি মূল্য যেখানে প্রায় ৮০০ টাকা সেখানে এদেশের কারখানায় তার উৎপাদন খরচ পড়ে মাত্র ৪০০ টাকা। অথচ অজ্ঞাত কারণে উচ্চহারে ভর্তুকী দিয়ে সার আমদানির প্রতিই আমাদের নীতিনির্ধারক মহলের অধিক ঝোঁক লক্ষ করা যায়।

অন্যদিকে, সারের ক্রমবর্ধমান আমদানী নির্ভরতাও সার সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। ১৯৯৫-৯৬ সাল পর্যন্ত সার আমদানী সীমিত আকারে থাকলেও বর্তমানে তা অত্যন্ত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসময়কালে সারের আমদানী দ্বিগুনেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সার আমদানির ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান যা সার সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে সারের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চরম অস্থিতিশীলতা, আমদানির পরিমান নির্ধারণে সিদ্ধান্তহীনতা ও দীর্ঘসুত্রিতা, এলসি’র ক্লিয়ারেন্স সময়মত না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্দর সমস্যার কারণে শিপমেন্ট সময়মত না হওয়া, আমদানিকারক নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছতা, কিছু অসাধু আমলা ও আমদানিকারকদের যোগসাজসে আমদানি কোটায় কারচুপি ইত্যাদি। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের অস্থিতিশীলতা এবং সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিপরায়নতার সুযোগ নিয়ে আমদানিকারক ও ডিলাররা সারের মূল্য ইচ্ছামত বাড়িযে দেয়। গত তিন বছর ধরে যে টিএসপি সারের মূল্য বস্তাপ্রতি ৬৫০-৭৮৫ টাকা ছিল এ মাসেই তা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে দাড়িয়েছে ১২০০-১৫০০ টাকা। হঠাৎ করে এরূপ মূল্য বৃদ্ধির কোন যৌক্তিক কারণ ছিলনা। ডিলাররা তাদের নামে বরাদ্দকৃত সব সার কৃষকের মাঝে বিতরণ না করে বেশি দামে বাইরে বিক্রী করে দেয়। খুচরা বিক্রেতারা এই সার কিনে নিয়ে ইচ্ছেমত উচ্চমূল্যে বিক্রী করে। ডিলারের কাছ থেকে সার না পেয়ে কৃষকরা উচ্চমূল্যে এই সার কিনতে বাধ্য হয়। ৩০০ টাকা দামের এক বস্তা ইউরিয়া সার কৃষককে ৭০০-৮০০ টাকা দামেও কিনতে হচ্ছে।

ভেজাল ও নিন্মমানের সার আমদানি আরেকটি মারাত্মক সমস্যা যা কৃষকের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। শিল্পবর্জ্যকেও সার হিসেবে আমদানির অনেক নজির এদেশে আছে। যেমনঃ ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি শিল্পবর্জ্যকে পটাশ সার হিসেবে আমদানি করা হয়। এ সার মাটিতে দিলে ফসল পুড়ে যেতে দেখা গেছে যাতে প্রচুর কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেসময় এটি নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি ও নানা মহল থেকে উঠা প্রতিবাদের মুখে আমদানি বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে চীন থেকে একটি শিল্পবর্জ্যকে ডিফিউজড ম্যাগনেশিয়াম ফসফেট সার নামে আমদানি ও বাজারজাত করা হয়। এ সার জমিতে প্রয়োগ করার পর ৬ মাসেরও অধিক সময় ধরে পাথরের মত অবিকৃত থাকতে দেখা গেছে। এটি নিয়েও তখন ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে এর আমদানি বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার।

চলমান সার সংকটের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চাহিদা নিরূপন ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে বেশকিছু পদ্ধতিগত ক্রটিকে দায়ি করা যায়। জরিপের মাধ্যমে সারের চাহিদা নিরূপিত হলেও এ জরিপের যথার্থতা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ এই জরিপের মাধ্যমে প্রাক্কলিত চাহিদা ও বাস্তব চাহিদার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বিরাজ করে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই চাহিদার তুলনায় বরাদ্দের পরিমান কম থাকে। উদাহরণস্বরূপ: ২০০৭-০৮ সালে ঝিনাইদহ জেলার ৫৯,০০০ মে. টন সারের চাহিদার বিপরীতে বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৫৫,৫৫০ মে. টন। অন্যদিকে বরাদ্ধ থেকেও কম পরিমানে সার সরবরাহ করা হয়। যেমনঃ ২০০৬-০৭ সালে ঝিনাইদহ জেলার জন্য বরাদ্দকৃত ৫৫,০০০ মে. টন সারের বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ৫২,০০০ মে. টন। ২০০৫-০৬ সালে দেশে ইউরিয়া সারের মোট বরাদ্দ ২৮ লাখ মে. টনের বিপরীতে সরবরাহ করা হয় মাত্র ২৫ লাখ মে. টন। সার বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুর্ণীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

ফ্যাক্টরী থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে সার পৌছানো পর্যন্ত মনিটরিং ব্যবস্থা জোড়ালো ও কার্যকরী নয়। পাশাপাশি কর্তব্য পালনে অবহেলা, ঘুষ, দুর্ণীতি, অনিয়মও এজন্য কম দায়ী নয়। বাস্তবে দেখা যায়, ডিলারের গোদামে সার না থাকলেও চোরাকারবারি ব্যবসায়ীদের কাছে সারের অভাব নেই। চোরাকারবারিরা ৩০০ টাকার সার ৭০০-৮০০ টাকা দরে কৃষকের কাছে বিক্রী করছে প্রকাশ্য দিবালোকে। কৃষক দিনের পর দিন জরুরী কাজ ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকেও সার না পেয়ে চোরা কারবারির কাছ থেকে অতি উচ্চমূল্যে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। সার মনিটরিং কমিটি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে তারা এ কাজ দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে দুনীতির বিরূদ্ধে জেহাদ ঘোষনাকারী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও।

পূর্বে বিসিআইসি অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকে শতশত খুচরা বিক্রেতা সার সংগ্রহ করত ও প্রতিযোগিতামূলক দামে তা কৃষকের কাছে বিক্রী করত। কিন্তু বর্তমানে সার বিতরণের একমাত্র এজেন্ট হল এসব ডিলাররা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কিছুসংখ্যক প্রতিনিধির মাধ্যমে সার বিতরণ করলেও এসব প্রতিনিধি নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ফলে এসব ডিলাররা একচেটিয়াভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। পূর্বের খুচরা বিক্রেতারা ছিল মূলতঃ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী কিন্তু ডিলারদের এসব প্রতিনিধি সাধারণতঃ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী নয়। কাজেই একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ক্রেতাদের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতাও এদের নেই। খুচরা বিক্রেতারা কৃষককে মৌসুমে বাকীতে সার দিত কিন্তু এরা তা দেয়না। ফলে, গরীব কৃষকের পক্ষে সার কেনা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ গরীব কৃষকের পক্ষে নগদ টাকা জোগাড় করা কঠিন।

বর্তমান ডিলারশিপ ব্যবস্থায গুটিকয় ডিলারদের একচেটিয়া মুনাফা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষান্তরে, লাখ লাথ খুচরা বিক্রেতার ব্যবসা বন্ধ হওয়ার ফলে তাদের উপার্জনের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে যা তাদের জীবন জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, এই শূন্যতা পূরণ করছে একশ্রেণীর মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী যারা কালোবাজার থেকে সার সংগ্রহ কওে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রী করছে। আর এই কালোবাজারে সার আসছে ডিলারদের কাছ থেকেই। চলমান জরুরী অবস্থা এবং সার বিতরণ ব্যবস্থায় যৌথ বাহিনীর পূর্ন নিয়ন্ত্রণ সত্বেও ডিলারদের এরূপ দৌরাত্ব প্রমাণ করে যে, গুটিকয় ডিলারদের মাধ্যমে সার বিতরণ ব্যবস্থা সমস্যা আরও বাড়াবে বৈ কমাবে না। বর্তমান বিতরণ ব্যবস্থায় জেলা ও উপজেলাভিত্তিক সারের যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা অন্য জেলা ও উপজেলায় স্থানান্তর নিষিদ্ধ। ফলে, দেখা যায় কোথাও সার উদ্বৃত্ব থাকছে আবার কোথাও সারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই উদ্বৃত সার কালোবাজারিদের হাতে চলে যাচ্ছে।

এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিশেষকরে বড় কৃষক ও অনুপস্থিত কৃষকরা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে সাধারণতঃ তাদের প্রাপ্য সারের চেয়ে অনেক বেশি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরু মৌসুমের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সার একসাথে মজুত করে ফেলে। ফলে, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র কৃষকরাই সাধারণতঃ সার থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাদের জমির পরিমান খুবই কম জমির পরিমান খুবই কম তাদের পক্ষে সার সংগ্রহ করা সবচেয়ে কঠিন। ডিলাররা যেহেতু প্রভাবশালী সুতরাং তাদের সার পাওয়া না পাওয়া ডিলারের মর্জির উপর নির্ভর করে। ফলে প্রায়শঃই দেখা যায় যে, কৃষক ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে থেকে সার সংগ্রহ করে খুচরা বিক্রেতাদের হাতে তুলে দিয়ে সেই সার বেশী মূল্যে বাকীতে কিনে নিয়ে যায়। কারণ, নগদে সার কেনার মত টাকা কৃষকের হাতে থাকেনা।

অন্যদিকে, সারের মূল্য কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার নামে যে ভর্তুকী দেওয়া হয় তার সুফলও কৃষকের কাছে পৌছায় না। এবছর (২০০৭ সাল) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিবস্তা ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ৪০০ টাকা যা সরকার বিক্রী করে ২৪০ টাকায়। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি প্রায় ১৬০ টাকা (টন প্রতি ৩২০০ টাকা) ভর্তুকী দেওয়া হয়। অন্যদিকে, আমদানিকৃত ইউরিয়া সারে বস্তাপ্রতি ৫৬০ টাকা (টন প্রতি ১১২০০ টাকা) ভর্তুকী দেওয়া হয় যাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সারের সমান দরে বিক্রী করা যায়। অথচ সে সার কৃষককে ৭০০-৮০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়েও আমদানিকারকরা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে এরূপ ঘটনার খবর পত্রপত্রিকায় প্রচুর দেখা গেছে। অর্থাৎ ভর্তুকীর সুফল পাচ্ছে মূলতঃ আমদানিকারক ও ডিলাররা।

যাহোক, সার বিতরণের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ দূর করার জন্য সরকার সম্প্রতি কার্ড সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ গ্রহন করেছে। কিন্তু যেভাবে এই সিস্টেমটি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে কিছু সুবিধা হয়ত পাওয়া যাবে তবে অনেক অসুবিধাও সৃষ্টি হবে। যেমনঃ এতে সার বিতরণ ব্যবস্থা আরও জটিল হবে। কারণ, অশিক্ষিত কৃষকের পক্ষে সঠিক তথ্য সরবরাহ ও সংরক্ষণ করা সহজ হবেনা। ডিলারের কাজ বেড়ে যাবে। কার্ড হারানো, নতুন কার্ড ইস্যু ইত্যাদি জটিলতা বাড়বে। তাছাড়া, এসব কাজ করতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার দাপ্তরিক কাজ বেড়ে যাবে ফলে তাদের দেয় সেবার মান বর্তমানের চেয়েও কমে যাবে। ফসল চাষের হিসাব সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ফসল চাষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে কৃষক সমস্যায় পড়বে।

সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু সুপারিশ

১.    জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ সার সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করা।

২.   দেশে সারের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করা। পাশাপাশি পুরাতন কারখানাগুলোর অত্যন্ত পুরনো ও ক্রটিপূর্ণ যন্ত্রপাতিগুলো প্রতিস্থাপন ও সময়মত মেরামতের উদ্যোগ গ্রহন করা।

৩.   সারের চাহিদা নিরূপন সঠিকভাবে করার জন্য সঠিকভাবে জরিপকাজ পরিচালনা করা।

৪.   প্রত্যেক জেলায় সরকারী গোদামে সরকারী উদ্যোগে সার এনে সেখান থেকে খুচরা ডিলারের মাধ্যমে সার বিক্রীর ব্যবস্থা করা যাতে মাঝখানে আর কোন হাত না থাকে।

৫.   প্রত্যেক গ্রামে সৎ ও দক্ষ ব্যবসায়িদের নিয়ে ৮/১০ জন ডিলারের একটি প্যানেল তৈরি করা যারা বছরানুক্রমে সার সরবরাহ করবে। ডিলারশীপের জন্য সিকিউরিটি মানির পরিমান আরও কমানো যাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ডিলারশীপ পেতে পারে।

৬.   খুচরা ডিলারদের সার সংগ্রহ ও বিতরণ ব্যবস্থা কঠোরভাবে মনিটরিং করা এবং কোন অনিয়মের জন্য তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

৭.   খোলা বাজারে সারের খুচরা বিক্রয় ব্যবস্থা চালু করা যাতে কৃষক প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে হাতের কাছে সার পায়। তবে, পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থাও জোড়দার করা আবশ্যক।

৮.   সারের উৎপাদন ও আমদানি থেকে শুরু করে কৃষকের হাতে পৌছানো পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থা জোড়দার করা।

৯.   তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবিলায় সারের পর্যাপ্ত মজুদসহ প্রত্যেক জেলায় অন্ততঃ একটি করে বাফার গুদাম স্থাপন করা প্রয়োজন।

১০.  সারে দেয় ভর্তুকী সরাসরি কৃষকের হাতে পৌছানোর ব্যবস্থা করা এবং জৈব সারে ভর্তুকী দেওয়া।

১১.  কার্ড পদ্ধতি যেটা চালু করা হচ্ছে সেটি আরও সময় নিয়ে এবং সঠিকভাবে জরিপকার্য সমাধা করে নিয়ে তারপর করা।

পরিশেষে বলতে হয়, ডিলারদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন’-এর দৌরাত্ব ও সিন্ডিকেশন সার সংকট সমাধানের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। এদের দৌরাত্বের কারণে ডিলারের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিলার নিয়োগের একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও সরকার ব্যর্থ হয়। সরকারী প্রজ্ঞাপনে শর্ত ছিল ১. ডিলারকে ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। ২. ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিলারের গোদাম থাকতে হবে এবং সেই গোদামে সার সংরক্ষণ ও সেখান থেকে বিতরণ করতে হবে। এসব শর্ত কার্যকরভাবে পালিত হলে সার সংকট ও কৃষকদের হয়রানি অনেকটাই লাঘব হতে পারত। কিন্তু উচ্চ আদালতে মামলা করে এ আদেশ স্থগিত করে দেওয়া হয় এবং এতেই সরকার বিষয়টি চেপে যায়। অথচ সরকার পুরাতন প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন করে ডিলার নিয়োগ দিতে পারত। আসলে, সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং ঘুষ ও দুর্নীতিই এরূপ ব্যর্থতার জন্য প্রধানতঃ দায়ী। কাজেই, সারের চলমান সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাসহ একটি কৃষক-বান্ধব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং তার সফল বাস্তবায়ন।

শহীদুল ইসলাম 

কৃষিবিদ ও কৃষি উন্নয়ন গবেষক

shahid.bd1172@gmail.com

ফটোক্রেডিট: প্রথমআলো